২৯ অক্টোবর ২০১৯, মঙ্গলবার, ১২:১১

ভুয়া এলসি ও ঋণ জালিয়াতি করে অর্থ পাচার: রাঘববোয়ালরা এখনও অধরা

দুর্নীতি ও ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল অঙ্কের অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) রিপোর্ট অনুযায়ী, গত দশ বছরে দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।

এর বড় অংশই পাচার হয় ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে এবং যার বেশিরভাগ দুর্নীতির টাকা। এসব টাকার বড় অংশ গেছে ভুয়া এলসির মাধ্যমে।

নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে ব্যাংকের প্রভাবশালী কয়েকজন পরিচালক। যাদের মধ্যে শুধু একজনই নিয়ে গেছেন প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। এরা শুধু নিজেদের টাকা পাচার করেই ক্ষান্ত হননি, কমিশন নিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অন্যদের টাকাও নির্বিঘ্নে পাচার করছেন।

এ ছাড়া ব্যাংকের বেশ কয়েকজন পরিচালক নিজের ব্যাংক থেকে ভুয়া নামে ঋণ তুলে নিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ সরিয়ে ফেলেছেন। মূলত এ চক্রটিই অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি ব্যাংকিং খাতকে রক্তশূন্য করে ফেলেছে।

দুর্নীতিবিরোধী চলমান অভিযান শুরু হওয়ার পর যুগান্তরের কাছে বিভিন্নভাবে এ ধরনের বিস্তর অভিযোগ আসতে থাকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকের সূত্রগুলো জানিয়েছে, সবচেয়ে দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংকিং চ্যানেলে।

অথচ এর সঙ্গে জড়িত গডফাদাররা এখনও অধরা। যাদের আদৌ ধরা হবে বলেও মনে হচ্ছে না। তারা বলেন, ব্যাংকিং সেক্টরের রাঘববোয়ালদের ধরতে না পারলে এ অভিযান কার্যত ব্যর্থ হবে।

সূত্রগুলো দাবি করছে, গত ১০ বছরে ব্যাংকের বড় অঙ্কের এলসি এবং খেলাপি হয়ে তামাদি হয়ে যাওয়া বড় ঋণগুলো সুনির্দিষ্ট ফমুর্লার ভিত্তিতে তদন্ত করলে ব্যাংকিং সেক্টরের রাঘববোয়ালদের মুখোশ খুলে যাবে। বিদেশে বিনিয়োগের জন্য অর্থ নিয়ে যাওয়ার অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও তারা কীভাবে বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ গড়ে তুলেছেন, তাও বেরিয়ে আসবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সোমবার যুগান্তরকে বলেন, সরকার ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে; কিন্তু ব্যাংকংসহ পুরো আর্থিক খাত বড় ক্যাসিনো হয়ে গেছে। এখানে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ও জালিয়াতি হচ্ছে।

দীর্ঘদিন থেকে প্রভাবশালী ঋণগৃহীতা ও ঋণখেলাপিরা ব্যাংক চালাচ্ছে। এই প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে না পারলে ব্যাংকিং খাত উদ্ধার করা সম্ভব হবে না।

তার মতে, এই সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণ হয়েছে।

এ কারণে আমি মনে করি, ব্যাংকিং খাতেও বড় অভিযান চালাতে হবে। এই সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়ার মতো বড় ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে। না হলে, এটি অন্য কারও পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন থেকে আমরা বলে আসছি- বাংলাদেশ ব্যাংককে উপেক্ষা করে প্রভাবশালী ঋণগৃহীতা ও ঋণখেলাপিরা ব্যাংক চালাচ্ছে।

কিন্তু সেটি সরকার আমলে নেয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) একই কথা বলেছে। এতেও কিছু হবে না। কারণ যারা ব্যবস্থা নেবেন তারাও প্রভাবশালী ঋণখেলাপিদের গ্রুপের সদস্য।

দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলেই টাকা পাচার হচ্ছে, তা নয়। মূলত দুর্নীতি হচ্ছে, কিন্তু বিচার হচ্ছে না- এ কারণেই টাকা পাচার বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কারা পাচার করছে, তা জানা সত্ত্বেও কোনো অ্যাকশন নেয়া হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তেমন কোনো তৎপরতা নেই।

যেভাবে পাচার হয় : সূত্রগুলো জানায়, দেশ থেকে নানাভাবে টাকা পাচার হয়। তবে বড় অঙ্কের অর্থ পাচার হচ্ছে ভুয়া এলসি খুলে। প্রভাবশালী ব্যাংক মালিক হওয়া ছাড়া এটি কারও পক্ষে সম্ভব নয়।

পাচারকারি হোতা নিজেই প্রথমে মালিকানাধীন ব্যাংকে ভুয়া এলসি খোলেন। মালিক বা পরিচালক হওয়ার কারণে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সেটি যাচাই-বাছাইয়ের চিন্তাও করেন না। এরপর ব্যাংকিং চ্যানেলে যথানিয়মে এ সংক্রান্ত ডকুমেন্ট চলে যায় বিদেশস্থ সংশ্লিষ্ট নেগোশিয়েটিভ ব্যাংকে।

একই সঙ্গে এলসির অনুলিপি অনলাইন পদ্ধতিতে অটোমেটিক বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত সার্ভারে এন্ট্রি হবে। নিয়মানুযায়ী এলসি ওপেনিং ব্যাংকের ডকুমেন্ট ওই দেশের সংশ্লিষ্ট রফতানিকারক ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে পণ্য জাহাজীকরণের কাজ সম্পন্ন করবে।

জাহাজীকরণ বা শিপিং শেষ হলে এ সংক্রান্ত ডকুমেন্ট ওই ব্যাংকে পুনরায় জমা দেবে। এরপর নেগোশিয়েটিভ ব্যাংক ডকুমেন্টটি এলসি ওপেনিং ব্যাংকে পাঠাবে। এটি আসার পর এলসির শর্ত অনুযায়ী রফতানিকারকের টাকা পরিশোধ করা হয়। একই সঙ্গে বিষয়টি আমদানিকারককে ই-মেইল দিয়েও অবহিত করে থাকে রফতানিকারক।

এরপর আমদানিকারক এলসি ওপেনিং ব্যাংক থেকে জাহাজীকরণের ডকুমেন্ট তুলে বন্দর থেকে পণ্য খালাসের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। এলসির বর্ণনার সঙ্গে আমদানি করা পণ্যের সবদিক থেকে মিল আছে কি না, সেটি পরীক্ষা করে কাস্টমস পণ্য ছাড় করার অনুমতি দিয়ে থাকে।

পণ্য রিলিজ সংক্রান্ত কাস্টমস সনদের ৩টি কপির মধ্যে একটি দেয়া হয় আমদানিকারককে, একটি যায় এলসি ওপেনিং ব্যাংকে, অপরটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে। প্রতিটি এলসি ওপেন করার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য দেশে আনা হয়েছে কি না, সেটি আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা নিয়মিত যাচাই করে থাকে।

যাচাইয়ে সত্যতা পেলে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে বলে গণ্য হবে। না হলে তদন্ত-পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার নিয়ম রয়েছে। অর্থের বিপরীতে প্রয়োজনীয় পণ্য না আনলে সেটি শেষ পর্যন্ত অর্থ পাচারের মামলার দিকে চলে যায়।

এটি হল এলসি-পরবর্তী পণ্য আমদানি-রফতানির নিয়মের কথা। কিন্তু অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে কোনো পণ্যই দেশে আনা হয় না।

এলসি ওপেনিং থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়। আমদানিকারক নিজেই রফতানিকারক সেজে তার নিযুক্ত লোকজন জাহাজীকরণের ভুয়া ডকুমেন্ট তৈরি করে ব্যাংকে জমা দিয়ে থাকে। যেহেতু বাস্তবে পণ্য আমনানি/রফতানি করা হয় না, সেহেতু বিষয়টি কাস্টমসের জানারও কথা নয়।

এ ছাড়া আমদানিকারক তো টাকা পাচারের জন্যই এভাবে এলসি খুলেছেন, সেহেতু বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়া দেশের মধ্যে আর কারও জানা সম্ভব না। এখন প্রশ্ন হল- যেহেতু পণ্য আমদানি করা হয়নি সেহেতু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে এ সংক্রান্ত ডকুমেন্ট জমা হওয়ার কোনো সুযোগও নেই।

তাহলে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কী পদক্ষেপ নিয়ে থাকে সেটি অবশ্যই জানার বিষয়। কিন্তু বাস্তবতা হল- প্রভাবশালী মহলের অর্থ পাচারের বিষয় হওয়ার কারণে হয় এই তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে সংরক্ষণ করা হয় না, নতুবা তথ্য গায়েব করে দেয়া হয়।

মূলত এই সুযোগ নিয়েই গত কয়েক বছরে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে যার কব্জায় যত বেশি ব্যাংক এবং যে যত বেশি প্রভাবশালী তার পক্ষে এভাবে অর্থ পাচার করা তত সহজ। হয়েছেও তাই।

দুর্নীতির বেশিরভাগ অর্থ এই চ্যানেল দিয়ে গেছে। যে বা যারা পাচার করেছেন তারা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন নিয়েছেন। এ ছাড়া কমিশন কেটে নিয়ে বাকি অর্থ দিয়ে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডা, লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে দুর্নীতিবাজদের বাড়ি ও ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন সম্পদও কিনে দিয়েছে এই চক্রটি।

তদন্তে কীভাবে ধরা যাবে : মাত্র ৩টি স্থানে অনুসন্ধান করলে এ সংক্রান্ত ভয়াবহ জাল-জালিয়াতির তথ্য-প্রমাণ করা সম্ভব হবে।

প্রথমত, গত ১০ বছরে যেসব ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের এলসি খোলা হয়েছে সেসব ব্যাংকে হানা দিয়ে এ সংক্রান্ত ডকুমেন্ট সংগ্রহ করতে হবে। ব্যাংকগুলোতে ডকুমেন্ট মুছে ফেলা সম্ভব নাও হতে পারে, কেননা এলসির বিপরীতে ব্যাংকগুলো আয় দেখিয়েছে।

এলসি সার্চ করার ক্ষেত্রে সন্দেহভাজন প্রভাবশালীদের ব্যাংকগুলোকে প্রথম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রাপ্ত এলসি ডকুমেন্টের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে থাকা তথ্য যাচাই করতে হবে। যদি সার্ভারে তথ্য না পাওয়া যায় তাহলে দ্বিতীয় ধাপেই পাচারের বিষয়টি প্রমাণিত হয়ে যাবে।

সার্ভারে এলসি এন্ট্রির তথ্য থাকলে পণ্য এসেছে কি না, সে বিষয়টি যাচাই করতে হবে। এরপর পণ্য খালাস সংশ্লিষ্ট বন্দরের কাস্টমসের ডকুমেন্ট যাচাই করতে হবে। প্রয়োজনে শিপিং এজেন্টের কাগজপত্রও দেখা যেতে পারে। মূলত এ বিষয়গুলো তদন্ত করলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।

সূত্রমতে, বাংলাদেশ ব্যাংক দু-একটি ঘটনা তদন্ত করে বেশিদূর এগোতে পারেনি। মোদ্দা কথা, এভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের তথ্য অনুসন্ধানে অদ্যাবধি শক্তিশালী কোনো তদন্ত হয়নি। সরকার চাইলে চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বিষয়টি শক্তভাবে তদন্ত করা সম্ভব।

ঋণ জালিয়াতির টাকা পাচার : অনুসন্ধানে জানা গেছে, যেসব ব্যাংকের পরিচালকরা ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত তাদের ব্যাংকেই এসব জালিয়াতির ঘটনা বেশি ঘটেছে।

কতিপয় প্রভাবশালী পরিচালক মিলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। তারা যৌথভাবে ব্যাংকিং খাতে ঋণ জালিয়াতি করে আমানতকারীদের টাকা এভাবে আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন।

সূত্রমতে, ভুয়া ঋণ আবেদনকারী সাজিয়ে সেখানে জামানত সংক্রান্ত কাগজপত্র জাল-জালিয়াতি করে প্রস্তুত করা হয়। এরপর প্রভাব খাটিয়ে নিজের ব্যাংক থেকে খুব সহজে ঋণ অনুমোদন করে নিজেরাই সে টাকা তুলে নিয়ে পাচার করে থাকেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী নামকাওয়াস্তে ঋণের কয়েকটি কিস্তি চালানোর পর সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর ঋণটি চলে যায় খেলাপির খাতায়। এক সময় তা নিয়ে যাওয়া হয় তামাদি বা অবলোপন শিটে। সাধারণ জনগণের টাকা তারা এভাবে তুলে নিয়ে ব্যাংককে ডুবিয়ে দিচ্ছেন।

অভিযোগ আছে- চক্রটি প্রভাব খাটিয়ে তদন্ত কাজকেও বাধাগ্রস্ত করে। কিন্তু যথাযথ পদ্ধতিতে তদন্ত হলে এসব ঘটনা বের করা সম্ভব। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে খেলাপি ঋণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। অথচ ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি নেই।

এ ক্ষেত্রে প্রভাবশালীরাই ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করছে, বিশেষ করে, বাংকগুলোর কিছু প্রভাবশালী পরিচালক ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণ করছে। এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুব বেশি কিছু করতে পারছে না। ব্যাংকের মালিকদের পক্ষে নিজের ব্যাংকগুলোতে সহজেই এলসি খোলার সুযোগ রয়েছে, বিশেষ করে, মূলধনি যন্ত্র আমদানির আড়ালে তারা টাকা পাচার করছেন।

এসব টাকা সিঙ্গাপুর, দুবাই ও কানাডায় পাচার করা হয়েছে। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তাই এসব অর্থ পাচার করেছেন।

পাচারের নতুন রুট : বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে (ওবিইউ) দেশ থেকে টাকা পাচার করা হচ্ছে। অফশোর ব্যাংকিং পরিচালনার প্রচলিত নীতিমালার বিশেষ শিথিলতার সুযোগ নিয়ে যেমন বেআইনি তহবিল সংগ্রহ করা হচ্ছে, তেমনি ওইসব টাকা বেনামে পাচার করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, তিনটি ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার করার তথ্য পাওয়া গেছে। বেসরকারি আরও দুটি ব্যাংকের ওবিইউর মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। ওই টাকা জমা করা ও পাঠানোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই।

সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশে ঋণের পরিমাণ বেড়ে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে বেশকিছু ঋণ ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে। এসব ঋণের মধ্যে বেশকিছু অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে নেয়া। ওইসব অর্থই আবার ঋণ হিসেবে দেশে আনা হয়েছে।

জিএফআই প্রতিবেদন : চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত জিএফআইর রিপোর্ট অনুসারে গত দশ বছরে দেশ থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। এর মধ্যে ২০১৫ সালে পাচার হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা।

সুইস ব্যাংকেও বাংলাদেশিদের ৫ হাজার কোটি টাকা জমা রয়েছে। যার বেশিরভাগই দেশ থেকে পাচার করা। এ ছাড়া পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসেও টাকা পাচারের জন্য এ পর্যন্ত ৮২ জন ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করা হয়েছে।

এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আবদুল আউয়াল সরকার টাকা পাচার নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। ওই প্রতিবেদনে তিনি বলেছেন, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ১৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা পাচার হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তেও ভুয়া এলসি খুলে পণ্য দেশে না এনে টাকা পাচারের ঘটনা ধরা পড়েছে। একই সঙ্গে রফতানিমূল্য দেশে না এনেও টাকা পাচারের ঘটনা শনাক্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গবেষণা : গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে ভয়াবহ আকারে টাকা পাচারের তথ্য দিয়েছে বিশ্বের খ্যাতনামা সংস্থাগুলো। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজের পানামা ও প্যারাডাইস পেপার কেলেঙ্কারি। এসব সংস্থার গবেষণায় দেশ থেকে টাকা পাচারের ভয়ানক তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

এমনকি জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন মহাব্যবস্থাপকের ব্যক্তিগত গবেষণায়ও দেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। বলা হচ্ছে, টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ায় গত কয়েক বছর ধরে এর পরিমাণ বেড়েই চলেছে।

দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দৃষ্টান্ত নেই।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগতভাবে দুর্বল হচ্ছে। আইনের শাসনে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়াও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে কিছু লোক বিদেশে টাকা নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কালো টাকা পাচার হতে পারে। এ ছাড়াও বিনিয়োগে মন্দার কারণে ব্যবসায়ীদের টাকা বিদেশে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তার মতে, সরকারকে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে- টাকা ফিরিয়ে আনা এবং জড়িতদের কঠোর শান্তি নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে একযোগে কাজ করতে হবে, বিশেষ করে, পাচার রোধে আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, টাকা পাচারের প্রথম কারণ হল বাংলাদেশে, অর্থ উপার্জন সহজ।

দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্যসহ নানা অবৈধ উপায়ে খুব দ্রুতই এখানে সম্পদ বানানো যায়। আর যারা এইভাবে অর্থ উপার্জন করে, তারা বড় অংশই বাইরে নিয়ে যায়। তাদের ছেলে-মেয়েরা দেশের বাইরে পড়াশোনা করে। সেখানে সম্পদ গড়লে তা নিরাপদ। তিনি বলেন, দেশের যে অবস্থা, তাতে নানা ধরনের আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া এলসি খোলার পর ঠিকমতো জিনিসপত্র আসছে কি না, সঠিক দামে খোলা হয়েছিল কি না, তার নজরদারিও নেই।

ড. সালেহউদ্দিন আরও বলেন, অর্থ পাচারে কারও বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- এমন বড় কোনো উদাহরণও নেই। এসব বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া না হলে টাকা পাচার বন্ধের সম্ভাবনা নেই। তাই শুধু কথার কথা নয়, বাস্তবেই সরকারের পক্ষ থেকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান যুগান্তরকে বলেন, চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত চার শতাধিক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে।

বিভিন্ন দেশ থেকে এদের বিষয়ে তথ্য আনার চেষ্টা করা হচ্ছে, বিশেষ করে, কোন কোন দেশে তারা টাকা পাচার করেছেন, সেসব দেশের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান চলছে। এসব তথ্য সংগ্রহ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেয়া হবে। এরপর তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

অর্থ পাচার. ঋণখেলাপি, ঋণ অনিয়ম বা আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অর্থ পাচারের বিষয়টি বিএফআইইউ দেখছে। আর ঋণ অনিয়মের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে তদন্ত করে দেখতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ ছাড়া ঋণ অনিয়ম ও আত্মসাতের বিষয়ে যে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও। ঋণ অনিয়ম বা জালিয়াতি যেখানে যাই হোক না কেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো ব্যবস্থা নিচ্ছে। পাচার করা টাকাও ফেরত আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/237654/