২১ অক্টোবর ২০১৯, সোমবার, ১১:৫৯

চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ৩৩২ শিশু হত্যার শিকার

দেশে চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ৩৩২ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। আর গত বছর হত্যা করা হয়েছে ৫২১ শিশুকে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব বলছে শিশু হত্যা ক্রমাগত বাড়ছে।

আসকের হিসাব অনুযায়ী, এই বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এই নয় মাসে শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৩১২টি আর গত বছরের ১২ মাসে এই সহিংসতার সংখ্যা ছিল এক হাজার ১১টি। জরিপে দেখা যায়, পাঁচ থেকে ১২ বছরের শিশুরাই সবচেয়ে বেশি হত্যা ও সহিংসতার শিকার। বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটছে পরিবার ও পরিচিত পরিবেশের মধ্যে।

হত্যা ছাড়াও শিশুরা ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি, অ্যাসিড সন্ত্রাস ও অপহরণের শিকার হয়। এমনকি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও। স্কুলে শিক্ষকের হাতে শিশু নির্যাতনের সংখ্যাও কম নয়। ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয় শিশু গৃহকর্মীরাও।

এদিকে এসব হত্যা ও নির্যাতরে ঘটনায় মামলা হয় অর্ধেকেরও কম। আসক বলছে, চলতি বছরে এপর্যন্ত ৩৩২টি শিশু হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ১৫১টি।

সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বাবা ও চাচার হাতে শিশু তুহিন হত্যার ঘটনা আরও একবার সমাজকে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু এটাই প্রথম নয়। তুহিন হত্যার কয়েক দিন আগে সাভারেও একইভাবে শিশু হত্যার অভিযোগ পাওয়া যায়।

শিশু অধিকার ফোরামের সাবেক সভাপতি ও শিশু অধিকার কর্মী ইমরানুল হক চৌধুরী বলেন, ‘নিজ পরিবারের মধ্যে বা পরিচিত পরিবেশে শিশু হত্যার এই ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন করে। এখন প্রশ্ন উঠেছে আমাদের পারিবারিক বন্ধন ও মূল্যবোধ নিয়ে। এখানে নিশ্চয়ই গভীর কোনো সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বাবা-চাচা সন্তানকে হত্যা করবে এটা কোনো সামাজিক অবস্থায়ই মেনে নেয়া যায় না। আমাদের নতুন করে চিন্তা করা দরকার পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে শিশুর প্রতি সহিংসতা বাড়ছেই। আর শিশু যেহেতু প্রতিবাদ করতে পারে না, সে যেহেতু প্রতিরোধ করতে পারে না, তাই প্রতিহিংসাসহ নানা বিকৃত আচরণের শিকার হয় শিশু। আমাদের সমাজটি শিশুবান্ধব নয়। এটা আমাদের সমাজের বড় একটি নেতিবাচক দিক। শিশু এখন পারিবারিক ও সামাজিক রাজনীতি এবং দ্বন্দ্বের শিকার হচ্ছে।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘শিশু তুহিন হত্যার ঘটনা আসলে ব্যাখ্যা করা কঠিন। কারণ সাধারণভাবে বলা হচ্ছে জমিজমা নিয়ে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে। তাই বলে নিজের সন্তানকে হত্যা! সেতো শত্রুকেও হত্যা করতে পারত। আসলে আমার মনে হয়েছে যে স্বার্থের কাছে সে এতই অন্ধ হয়েছে যে, তার মনুষ্যত্বই লোপ পেয়েছে। এটা আমার কাছে নতুন একটা পরিস্থিতি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সমাজেই শিশুর প্রতি সহিংসতার উপাদান আছে। শিশুকে গুরুত্ব এবং সম্মানের জায়গায় রাখা হয় না। আর শিশু যেহেতু দুর্বল তাই তার ওপরই আঘাত আসে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে দেশে যথেষ্ট আইন আছে। কিন্তু আইন থাকলেই হয় না। আইনকেতো শুধু কিছু লিখিত বিষয় হিসেবে বিবেচনা করলে চলবে না। এর একটা দার্শনিক দিক আছে। আমার বিবেচনায় সমাজে মূল্যবোধ ও মানবিকতার চরম অবক্ষয়ের প্রকাশ এই শিশু হত্যা। শিশুর প্রতি সহিংসতা মানে দুর্বলের প্রতি সহিংসতা। এটা বিবেচনা করলেই অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘আইনমন্ত্রীই বলছেন এখন বিভিন্ন মামলায় শাস্তির হার মাত্র তিন ভাগ। ৯৭ অপরাধীর বিচার হয় না। আগে আমাদের ধারণা ছিল ১৫-২০ ভাগ বিচার হয়। এই পরিসংখ্যান দিয়ে বিচারহীনতার পপুলার কথা বলা যাবে। কিন্তু অপরাধ দমনে বিচার হওয়াই যথেষ্ট নয়। সমাজ যদি অপরাধপ্রবণ হয় তাহলে সেটা বড় ধরনের সংকট। আমরা সেই সংকেটর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ঘুষ, দুর্নীতি, হত্যাসহ আরো অনেক অপরাধের পুঞ্জিভূত প্রকাশই হচ্ছে এই শিশু হত্যা। এটা জঘন্য একটা অমানবিক স্বার্থপর সমাজের লক্ষণ। ’

https://www.dailysangram.com/post/393662