২০ অক্টোবর ২০১৯, রবিবার, ৪:৪০

কাজের আগেই ব্যয় বৃদ্ধি ৪ হাজার কোটি টাকা

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ ও তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই ব্যয় বাড়ল প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এ প্রকল্পে সর্বশেষ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। এতে সরকারের ব্যয় করার কথা দুই হাজার কোটি টাকা। জাপান ঋণ দিচ্ছে ছয় হাজার কোটি টাকা। বাকি ৯ হাজার কোটি টাকা কোথা থেকে আসবে, সেটা এখনও অনিশ্চিত।

এ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৭ সালে। এখনও কাজ শুরু হয়নি। এ প্রকল্পের নির্মাণকাজ পেয়েছে জাপানি একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তারা প্রথমে ব্যয় প্রস্তাব করেছিল ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে এই জাপানি ঠিকাদার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষির পর তাদের ব্যয় বাড়িয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। সাধারণত দরকষাকষির পর ব্যয় কমে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একই সঙ্গে বিদেশি ঋণ ও সরকারি তহবিল থেকে প্রাপ্ত অর্থের চেয়ে এ প্রকল্পে ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা বেশি হচ্ছে। এই বিপুল পরিমাণ টাকার উৎসও এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হয়নি।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, বর্ধিত ব্যয় দেখিয়েই প্রকল্পের চূড়ান্ত ব্যয় অনুমোদনের প্রস্তাব খুব শিগগির ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে যাচ্ছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মহিবুল হক সমকালকে জানিয়েছেন, আগামী নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। শুরুতেই প্রকল্পের ব্যয় বিপুল অঙ্কে বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যখন প্রকল্পের ডিপিপি (বিস্তারিত প্রকল্প প্রস্তাব) করা হয়, তার চেয়ে বর্তমান সময়ে অনেক কিছুরই ব্যয় বেড়েছে। যুক্তিসংগত কারণেই ব্যয় বেড়েছে।

ব্যয় বাড়ল যেভাবে :প্রকল্প-সংশ্নিষ্ট নথিপত্র অনুসন্ধানে দেখা যায়, এ প্রকল্পের ডিপিপি চূড়ান্ত হয় ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সে সময় প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ১৩ হাজার ৬১৪ কোটি ৪২ লাখ পাঁচ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রকল্প সহায়তা (বিদেশি সংস্থার ঋণ) থেকে ১১ হাজার ২১৪ কোটি ৭৮ লাখ ২৬ হাজার টাকা। আর সরকারি তহবিল থেকে জোগান আসবে দুই হাজার ৩৯৯ কোটি ৬৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকা।

পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালের ২৯ জুন প্রকল্পের জন্য জাপানের আন্তর্জাতিক সংস্থা জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়। এ চুক্তিতে ঋণের পরিমাণ উল্লেখ করা হয় ৭৬ বিলিয়ন ৮২৫ মিলিয়ন জাপানি ইয়েন, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ছয় হাজার ১৯ কোটি টাকা।

সাধারণত প্রকল্পের ডিপিপিতে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে যে ব্যয় ধরা হয়, তার সমপরিমাণ ঋণ নেওয়াটাই রেওয়াজ। কারণ, রেওয়াজ অনুযায়ী বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে যে পরিমাণ প্রকল্প সহায়তা বা ঋণ পাওয়া যায়, তার হিসাবেই প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা এবং সরকারি তহবিলের অনুপাত নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ডিপিপিতে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা প্রকল্প সহায়তা বা ঋণের কথা বলা হলেও পরবর্তী সময়ে জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি করা হয়েছে মাত্র ছয় হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রকল্প সহায়তা অংশে বাকি পাঁচ হাজার কোটি টাকার জোগান কীভাবে আসবে, তা উল্লেখ করা হয়নি। ফলে প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ প্রক্রিয়া ও ঋণচুক্তি নিয়ে শুরুতেই ধোঁয়াটে অবস্থার সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময়ে ঋণের পরিমাণ না বাড়লেও ধাপে ধাপে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। সর্বনিম্ন দর দিয়ে কাজ পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ ব্যয়ের হিসাব দেখানো হয়েছে ভ্যাট ও অন্যান্য কর ছাড়া ১৭ হাজার ৮১৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এ ব্যয়ই চূড়ান্ত ব্যয় হিসেবে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হচ্ছে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রকল্পে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম নামে একটি যৌথ উদ্যোগের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই কনসোর্টিয়ামের অন্তর্ভুক্ত কোম্পানি হচ্ছে জাপানের মিতসুবিশি করপোরেশন, ফুজিটা করপোরেশন। এর সঙ্গে স্যামসাং সি অ্যান্ড টি এবং মারুনৌচি ও সিওডাকু নামে আরও তিনটি প্রতিষ্ঠান যুক্ত রয়েছে। এই কনসোর্টিয়াম দরপত্রে অংশগ্রহণের সময় ব্যয় দেখিয়েছিল, ১৬ হাজার ৪৩৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এই ব্যয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের তহবিল অংশে ভ্যাট ও অন্যান্য কর যুক্ত রেখে ঋণ সহায়তা অংশকে করের আওতামুক্ত দেখানো হয়েছিল। কিন্তু দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রকল্প-সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা ও দরকষাকষির পর এই ঠিকাদারি কনসোর্টিয়াম সব ধরনের ভ্যাট ও কর ছাড়া পরিবর্তিত ব্যয় দেখিয়েছে ১৭ হাজার ৮১৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। গত মার্চ মাসে দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। অর্থাৎ মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানই ব্যয় বাড়িয়েছে প্রায় এক হাজার ৩৭ কোটি টাকা। ভ্যাট ও অন্যান্য কর যোগ করা হলে এই ব্যয় আরও প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা বাড়বে।

সার্বিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগেই ডিপিপির তুলনায় ব্যয় বাড়ছে প্রায় চার হাজার ২২৪ কোটি টাকা। আর নতুন ব্যয়ের হিসাবে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ঋণ সহায়তার (ছয় হাজার কোটি টাকা) চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকা বাদ দিলে আরও প্রায় ৯ হাজার কোটির জোগান কোত্থেকে আসবে, তা এখনও নিশ্চিত নয়।

এ ব্যাপারে সরকারি কেনাকাটা-সংক্রান্ত একজন বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, এ প্রকল্পে ঋণের তুলনায় তিন গুণ বেশি ব্যয় দাঁড়িয়েছে, যেটা অস্বাভাবিক। এর ফলে অতিরিক্ত অর্থের জন্য হয় নতুন ঋণের সন্ধান করতে হবে, না হলে সরকারি তহবিল থেকে জোগান দিতে হবে। অর্থের উৎস চূড়ান্ত না করে এটি ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিতে পাঠানোর বিষয়টিও অস্বাভাবিক। আর সরকারি তহবিলের পরিমাণ যদি বিদেশি সংস্থার ঋণের চেয়ে তিন গুণ বেশি হয়, তাহলে বিদেশি সংস্থার শর্ত মেনে দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। সাধারণত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা কিংবা দরকষাকষির মাধ্যমে ব্যয় কমানো হয়; কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যয় এক হাজার কোটি টাকার বেশি বাড়ানো হয়েছে, সেটাও অস্বাভাবিক। তিনি আরও বলেন, এই প্রকল্পের কেনাকাটায় দেশের বাজার থেকে ইট-বালু কেনার ক্ষেত্রে ভ্যাট ও কর মওকুফ সুবিধার কথা বলা হয়েছে, সেটিও যুক্তিসংগত নয়।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: এ ব্যাপারে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন সচিব মহিবুল হক সমকালকে বলেন, যে সময় ডিপিপি গ্রহণ করা হয়েছিল আর যে সময়ে এসে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তার মাঝখানে সময়ের ব্যবধানে বাজারে অনেক কিছুর দাম বেড়ে গেছে। এ কারণেই ব্যয় বেড়েছে যুক্তিসংগত হারেই।

মোট ব্যয়ের মধ্যে বিদেশি সংস্থার ঋণের পরিমাণ তিন ভাগের এক ভাগ। আর এখন পর্যন্ত সরকারি তহবিল থেকে পাওয়ার কথা বলা হয়েছে মাত্র দুই হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে বাকি প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার জোগানের কী হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ জন্য ঋণের পরিমাণ বাড়াতে জাইকার সঙ্গে আলোচনা চলছে। জাপানি ঋণ বাড়লে আনুপাতিক হারে সরকারি তহবিলের পরিমাণও বাড়বে।

তিনি আরও জানান, সরকারি ক্রয় কমিটিতে অনুমোদনের পর আগামী নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

https://samakal.com/capital/article/19101687/