১৭ অক্টোবর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৪:৩৯

টাকা যাচ্ছে ভারতে

বন্ধ হয়নি অনলাইন ক্যাসিনো : নিঃস্ব হচ্ছে তরুণ শিক্ষার্থীরা

বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় তিন পাত্তি গোল্ড। এ খেলায় মত্ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দলবেঁধে লাখ লাখ টাকার চিপস কিনছে তারা। হাতের মুঠোফোন নিয়ে খেলছে রাতদিন। ভারতীয় এক ব্যবসায়ী এই জুয়ার আসরটি নিয়ন্ত্রণ লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বাংলাদেশে আছে তার প্রায় শতাধিক এজেন্ট। যারা এসব চিপস বিক্রি করে। যার থেকে ২৫ শতাংশ লাভ করছে। এসব এজেন্টের নম্বর মেলে অ্যাপ্লিকেশনেই। এমন একজনের সঙ্গে এজেন্ট হওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি জানান, প্রথমে ১০ লাখ টাকার চিপস কিনতে হবে। এরপর যুক্ত হওয়া যাবে এজেন্ট হিসেবে। এই টাকা মূলত পাচার হচ্ছে এসব এজেন্টের মাধ্যমে ভারতে।

সূত্র জানায়, সেলিম প্রধান গ্রেফতার হওয়ার পরেও ভারতীয় ব্যবসায়ীর এই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ধান্ধাবাজি এখনও বন্ধ হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টি-২১ এবং পি২৪ নামের অনলাইন গ্যাম্বলিং সাইট খুলে দেশে অনলাইন ক্যাসিনোর প্রবর্তনকারী সেলিম প্রধান। সেলিম গ্রেফতারের পর সরকারের ‘সাইবার থ্রেট ডিটেকশন অ্যান্ড রেসপন্স’ প্রকল্প থেকে ৬৭টি গ্যাম্বলিং সাইট বন্ধ করা হয়েছে। এর আগে এ প্রকল্প থেকে প্রায় আড়াই হাজার গ্যাম্বলিং সাইট বন্ধ করে দেওয়ার পরও অনলাইনে জুয়া খেলা বন্ধ হয়নি।

র‌্যাবের তদন্তকারী সূত্রগুলো জানায়, পাঁচটি দেশের নিবন্ধিত বেটিং সাইটগুলোতে দেশ থেকে অনলাইন জুয়া খেলা হচ্ছে। ব্যাংকে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে এবং ডিলারদের কাছ থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের চিপস বা কয়েন কিনে স্মার্ট মোবাইল ফোন দিয়েই এই জুয়া খেলা চলছে। বাস্তবে ফুটবল-ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলার সময় বাজি এবং ওই সব খেলার আদলেই হচ্ছে অনলাইন জুয়ার কারবার। জুয়ায় অংশ নেওয়া বেশির ভাগই শিক্ষার্থী বা বয়সে তরুণ। নেশায় পড়ে অনেক হচ্ছে নিঃস্ব। সেলিমের মতো আরো ১৫টি চক্র অনলাইন ক্যাসিনোর দেশীয় ডিলারের কাজ করছে। তারা ১৫০টি ওয়েবসাইট ব্যবহার করছে বলেও র‌্যাব তথ্য পেয়েছে। সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইনে বেটিং বা জুয়ার কারবারে বিদেশে অর্থপাচারের পাশাপাশি সাইবার সিকিউরিটিও ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

সূত্র জানায়, অনলাইনে ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ নামের এক ভয়ংকর জুয়া এখনও চলছে। কয়েকজন ভারতীয় বিদেশে বসেই এ খেলা পরিচালনা করে। বাংলাদেশে রয়েছে তাদের কয়েকশ’ ডিলার। তিন পাত্তি গোল্ড একটি অ্যানড্রয়েড অ্যাপ। এর মাধ্যমে চলছে ভার্চুয়াল জুয়া। প্রতিদিন ভার্চুয়াল বোর্ডে লেনদেন হয় কোটি কোটি চিপস (জুয়ার কয়েন)। ডিলারদের ফেসবুক পেজের কমেন্ট বক্স থেকে নম্বর পায় জুয়াড়িরা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র বলেন, তিন পাত্তি গোল্ড হচ্ছে ‘তিন তাসের খেলা’। খেলার সবচেয়ে বড় কার্ড হলো তিন টেক্কা আর সর্বনিম্ন কার্ড ২-৩-৫। এ গেমের মূল বস্তুটি হচ্ছে চিপস বা কয়েন। এক কোটি চিপসের মূল্য ছয় মাস আগেও ছিল ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এখন ৭০-৮০ টাকায় পাওয়া যায়। গেমের ভেতর থেকেই ডলারের বিনিময়ে কোম্পানী তাদের চিপস বিক্রি করে। কিন্তু গেম কোম্পানীর কাছ থেকে ডলারের মাধ্যমে চিপস কেনা অনেকেরই সাধ্যের বাইরে, কারণ তারা চিপসের মূল্য অনেক বেশি নেয়। অনেক খেলোয়াড়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই তাই তারা চিপস বা জুয়ার কয়েন কেনে ডিলারদের কাছ থেকে।

প্রতিনিয়ত তিন পাত্তি গোল্ড খেলেন এমন কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, যে কেউ চাইলেই ডাউনলোড করতে পারে। দুই সপ্তাহ আগের হিসাবে এ অ্যাপ্লিকেশনটি ডাউনলোড করেছেন প্রায় ৫০ মিলিয়নের অধিক মানুষ। এই খেলায় সুবিধা হচ্ছে প্রতিদিন ব্যবহারকারীকে ১ লাখ চিপস ফ্রি দেয়া হয়। দিন রাত ২৪ ঘণ্টা খেলা যায়। আরো আগ্রহের কারণ মাত্র ১ বার খেলেও বের হয়ে আসা যায় এখান থেকে। আগ্রহের বসে এই খেলা শুরু করার পরেই নেশায় পড়ে যায় ব্যবহারকারীরা। আর এই জুয়া সব থেকে বেশি খেলে থাকেন শিক্ষার্থীরা।
এই খেলার নেশায় পড়ে পাচার হচ্ছে বিপুল অংকের টাকা। এই জুয়ার জন্য সাড়ে ৭ লাখ চিপস কিনতে হয় ৮০ টাকায়। ১ কোটি ১৫০ টাকায়, ৩ কোটি ৩ লাখ চিপস ৪২০ টাকায়, ৭ কোটি ৫০ লাখ চিপস ৮৫০ টাকায় ও ১৬ কোটি চিপস কিনতে খরচ হয় ১ হাজার ৭ শ’ টাকা। আর জেমস কিনতে খরচ হয় ১শ’ জেমস ৮০ টাকা, ১ হাজার ৭৫ জেমস ১৫০ টাকা, ৫ হাজার ৫শ’ জেমস ৮৫০ টাকা, ১১ হাজার ৫শ’ জেমস ১ হাজার ৭ শ’ টাকা ও ৬২ হাজার ৫শ’ জেমস কিনতে গুণতে হয় ৮ হাজার ৪ শ’ টাকা। তবে তাদের অ্যাপের নিয়ম অনুযায়ী এই মূল্যে কিনতে প্রয়োজন পড়ে ক্রেডিট বা ডেভিড কার্ড। এ কারণে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ঝুঁকে পড়ছেন তারা। রয়েছে চিপস শেয়ারের সুবিধা।
জানা যায়, বাংলাদেশে আছে এমন চিপস শেয়ারের শতাধিক এজেন্ট। তারা বিভিন্নভাবে খেলায় যুক্তদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এদের সবার রয়েছে ফেসবুক পেজও। এমন একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইচ্ছা পোষণ করা হয় ১ কোটি চিপস কেনার। নিয়ম অনুযায়ী ১ কোটি চিপসের মূল্য ১৫০ টাকা হলেও তারা চায় ১ হাজার টাকা। আরেকটি নম্বরে ফোন করেও ঠিক একই পরিমাণ অর্থ চাওয়া হয়। খেলাটিতে থাকে ব্যক্তিগত টেবিল বানিয়ে পরিচিতজনদের সঙ্গে খেলার সুযোগ। এছাড়াও তিন পাত্তির পাশাপাশি জোকার, ভেরিয়েশন, হাজারি, পোকার, আন্দার-বাহার, রুমি, ডেলিশিয়া খেলা যায়। এছাড়াও খেলা যায় টুর্নামেন্ট। এই খেলাটিতে নেই অর্থ ফেরত পাবার সুযোগ নেই। চিপস শেয়ারের মাধ্যমেই অর্থ আয় করে থাকে তারা।
আলোচিত এই ক্যাসিনো খেলে এক মাসে ৬০ হাজার টাকা হেরেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, শখের বসেই এই খেলা শুরু করি। এখন রীতিমতো নেশায় পরিণত হয়েছে। এই খেলায় লাভের থেকে লোকসান বেশি হয়। ২ বছরে হারিয়েছি ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা।
স¤প্রতি ৮ বন্ধু মিলে ১ লাখ টাকার চিপস বিক্রি করেছেন। তারা সবাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের খেলার জন্য রয়েছে ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ। এই গ্রুপের মাধ্যমে তারা কোড অনুযায়ী ৫ জনের টেবিলে ৪ জন বসে। আর ১ জন যিনি আসেন তার চিপস বাগিয়ে নেন। নিজেদের কার্ড সব ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়। এভাবে তারা আয় করে চিপস। এই গ্রুপের সদস্যরা আবার চিপস শেয়ার বা বিক্রি করে আয় করে থাকে অর্থ। তাদের একজন বলেন, আমাদের এটা আয়ের একটা উৎস। আমরা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন কৌশলে আয় করে থাকি। তিনি বলেন, আমারা এই আয় করা চিপস বিক্রি করি। তবে বাংলাদেশে রয়েছে এসব চিপস বিক্রির ডিলার। তারা সরাসরি চিপস কিনে অধিক দামে বিক্রি করে থাকে। এই গ্রুপের আরেকজন বলেন, আয়ের পাশাপাশি কিনেও বিক্রি করে থাকি আমরা। ১ কোটি চিপস ১৫০ টাকায় কিনে লাভ করা যায় ৫শ’ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত। ভুক্তভোগিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অলনাইন ক্যাসিনো খেলে ইতোমধ্যে অনেকেই নিঃস্ব হয়েছে। একজন ভুক্তভোগি অবিভাবক জানান, তার ছেলে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছেলেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার ফি দিয়েছেন। কিন্তু ক্যাসিনো খেলতে গিয়ে সে সব টাকা হেরেছে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চিঠি পেয়ে তিনি বিষয়টি আবিস্কার করেছেন। ওই অবিভাবকের মতে, তার মতো এরকম বহুজনের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও বলেন, অনলাইনে এই অপরাধের জগতটা বিশাল। সে তুলনায় আমাদের পর্যবেক্ষণ সক্ষমতা এখনো অপ্রতুল। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। মন্ত্রী বলেন, অনলাইন গ্যাম্বলিং সাইটগুলোর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ থেকেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সেলিম প্রধানকে শনাক্ত করে। তাকে আটকের পর অনলাইন জুয়া সম্পর্কে এত দিন আমাদের জানার বাইরে জুয়াড়িদের অনেক কৌশল নজরে আসছে এবং সে অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, আমাদের একটি সাইবার মনিটরিং সেল রয়েছে। সেই সেলে আমরা দেখতে পাই কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অনলাইনে ক্যাসিনো গেমিংয়ে নিয়োজিত রয়েছে। এর সূত্র ধরে আমরা কাজ করছি। সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করেই অনলাইন ক্যাসিনো বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগও এ বিষয়ে কাজ করলে তাদের কাছে এ বিষয়ে বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি। একজন কর্মকর্তা জানান, তারা ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়ার তদারকি করে থাকেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফেসবুক, ইউটিউব বা গুগলের মতো ওয়েবসাইট থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব ও সামাজিক মূলবোধ পরিপন্থী নির্দিষ্ট কোনো কনটেন্ট অপসারণে বিদেশি কর্তৃপক্ষের কাছে যাতে ধরনা দিতে না হয়, তার জন্যই ‘সাইবার থ্রেট ডিটেকশন অ্যান্ড রেসপন্স’ প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। এর মাধ্যমে ফেসবুক বা ইউটিউবে কোনো আপত্তিকর মন্তব্য, পোস্ট বা ভিডিও দেশের বাইরে দেখা গেলেও বাংলাদেশে দেখতে না পারার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পটি চূড়ান্তভাবে গ্রহণের আগে এর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বর এটি বিটিআরসির কাছে হস্তান্তর করা হবে। বিটিআরসিই এটি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে। ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার বা এনটিএমসিও এটি ব্যবহার করতে পারবে। ১৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প থেকে গত মে মাস পর্যন্ত ২২ হাজার পর্নো এবং আড়াই হাজারের মতো গ্যাম্বলিং সাইট বন্ধ করা হয়।

https://www.dailyinqilab.com/article/241718/