১৭ অক্টোবর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৪:২৬

সুন্দরবনে ফের দস্যুবাহিনী

জীবিকার টানে বিপদসঙ্কুল বনে ঢুকছে সবাই

সুন্দরবনকে সরকারিভাবে গত বছরের নভেম্বরে দস্যুম্ক্তু ঘোষণা করা হয়। তারপর ছয় মাস পেরুতেই সুন্দরবনে তারা আবার ফিরে এসেছে। এপ্রিল মাসে মধুর মওসুমের শুরুতে মৌয়ালদের সাথে দস্যুরাও ঢোকে বনের অভ্যন্তরে। প্রতিক্রিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সক্রিয়। তাদের অভিযানে ইতোমধ্যে দস্যুরা নিহত, অস্ত্রসমেত পাকড়াও হয়েছে। দস্যুরা বনের জেলে-বাওয়ালীদের জন্যই শুধু হুমকি নয়, বনের প্রাকৃতিক সুরক্ষক বাঘের অস্তিত্বের প্রতিও হুমকি।

গত বছরের ১ নভেম্বর বাগেরহাটের শেখ হেলালউদ্দিন স্টেডিয়ামে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে সুন্দরবনের ৬টি দস্যুবাহিনীর সদস্যরা অস্ত্রসমর্পণ করে। প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে সে অনুষ্ঠানে বনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করেন। অবশ্য র্যাব এবং কোস্টগার্ডসহ অন্যান্য বাহিনী তার আগে থেকে বনে দস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আসছিল। সে অভিযানের মধ্যেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দস্যুবাহিনীর আত্মসমর্পণের আরো অনুষ্ঠান হয়। দস্যুমুক্ত ঘোষণার পর সুন্দরবনের ৯ দস্যুবাহিনীর ৮৪ সদস্যকে পুনর্বাসনের জন্য সরকার ১ লাখ টাকা করে প্রদান করে। র্যাব সূত্রানুযায়ী, তারা বনে ২২৩টি অভিযান চালিয়ে ১৩৫ দস্যুকে হত্যা ও ৫০৭ জনকে আটক করতে সক্ষম হয়। উদ্ধার হয় এক হাজার ৫৫৬টি অস্ত্র এবং ৩৩ হাজার ৩২৪ রাউন্ড গুলি। এছাড়া কোস্টগার্ড ও পুলিশের অভিযানে ডাকাত মারা পড়া, আটক ও অস্ত্র উদ্ধার হয়। এতসবের পরেও বনে ডাকাতদের পুনরাবির্ভাব হয়েছে।

বনে ডাকাতের তৎপরতা আবার শুরু হওয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অ্যাকশনও শুরু হয়েছে। সবশেষ গত মঙ্গলবার র্যাব-৬ এর ভারপ্রাপ্ত স্পেশাল কমান্ডার সহকারী পুলিশ সুপার তোফাজ্জল হোসেন জানান, বনদস্যু আমিনুর বাহিনীর অবস্থানস্থল সুন্দরবনের শিবসা নদীর কয়রাখালী নামক স্থানে র্যাবের একটি টিম সে দিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে অভিযানে যায়। র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে দস্যুরা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে অবস্থান নেয়। তাদের ধাওয়া করলে তারা র্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে আমিনুর বাহিনীর প্রধান আমিনুর, তার সেকেন্ড ইন কমান্ড রফিক ও সদস্য আক্তার হোসেন ও মণিষ সাহা নিহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে তিনটি বন্দুক ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। একইভাবে র্যাব-৬ কিছু জলদস্যুর পৃষ্ঠপোষক জেলেদের কাছ থেকে টোকেনের মাধ্যমে চাঁদা আদায়ের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ১০ অক্টোবর সকালে সিপিসি-স্পেশাল কোম্পানি কমান্ডার মেজর এ এম আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে খুলনা জেলার কয়রা থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। তারা ৪ নং কয়রা সরকারি পুকুরপাড় এলাকা থেকে ১টি ওয়ান শ্যুটার গান, ৫ রাউন্ড গুলি, চাঁদা আদায়ের টোকেন, বিকাশের মাধ্যমে চাঁদা আদায়ের নথিপত্রসহ আসামী মো: নূর হোসেন (৩০), ও মো: মোজাফফর সরদারকে (৩২) গ্রেফতার করেন। এ ছাড়া গত ২৮ সেপ্টেম্বর ভোরে সুন্দরবনের সাতীরা রেঞ্জের অধীন আমতলীখাল থেকে বনদস্যু সেলিম বাহিনীর দুই সদস্যকে আটক করে কোস্টগার্ড। তাদের কাছ থেকে দুটি দোনলা বন্দুক, একটি একনলা বন্দুক ও ২১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। কৈখালি কোস্টগার্ডের সদস্যরা জানান, সুন্দরবনের আমতলী খালে বনদস্যু সেলিম বাহিনীর সদস্যরা ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে কোস্টগার্ড সেখানে অভিযান চালায়। শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাজমুল হুদা জানান, কোস্টগার্ডের হাতে আটক দুই বনদস্যুএবং অস্ত্র ও গুলি থানায় সোপর্দ করা হয়।

সুন্দরবনে দস্যুতা এখন খুবই কঠিন। সেটা ডাকাতদলে যোগ দেয়ার পরেই সবাই বুঝতে পারে। সুন্দরবনে থাকতে হলে মুঠো সাইজের মাকড়সা আর বিভিন্ন প্রজাতির সাপের সাথে সহবাস মেনে নিতে হয়। সেই সাথে এখন সরকারি বাহিনীগুলোর অভিযানের মুখে তাদের সাথে অন্তহীন ইঁদুর-বিড়াল খেলায়ও নিয়োজিত থাকতে হয়। আর বড় বিপদ হচ্ছে বাঘ। বনে অবস্থানকালে অনেক রাত তাদের নির্ঘুম কাটে। রাতে বনে খসখস শব্দ শুনে তারা সে দিকে গুলি চালায়। এরপরও যখন প্রচণ্ড আতঙ্ক তাদের গ্রাস করে তখন দ্রুত নৌকায় উঠে পড়ে। এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কান্তিহীন কেটে যায়। বাধ্য হয়ে তাদের বাঘ মেরেও ফেলতে হয়। এরকম মাসের পর মাস ধরে বনে থেকে নৌকা-জাহাজে অভিযান ও অপহরণের পর টাকা আদায়ের কর্ম করার পর সেখান থেকে ফিরে আসার উপায় খুঁজছিল প্রায় সবাই। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকার বনদস্যুদের জন্য ক্ষমা এবং আত্মসমর্পণ করলে শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেয়ার ঘোষণা করলে সেই সুযোগ তারা গ্রহণ করে বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু এতসব বিপদ সত্ত্বেও আবার বনে ডাকাতের ফিরে আসা অবধারিতই ছিল বলে বনের জেলে বাওয়ালীরা জানিয়েছেন।

খুলনা জেলার সুতারখালি-কালাবগী গ্রামের জাহাঙ্গীর একটি বনদস্যু দল পরিচালনা করত। একই গ্রামের সালাম ও মিঠু ছিল দস্যুদলের সদস্য। আত্মসমর্পণ করে তারা ১ লাখ করে টাকা পেয়েছিল। এখন জাহাঙ্গীর একটা মাছের ঘের করলেও বাকি দুইজন বেকার। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অধিকাংশ আত্মসমর্পণকারীর অবস্থা একইরকম। দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগতভাবে চাষবাসের সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে আসায় বনের পাশের হাজার হাজার মানুষকে সুন্দরবনের গভীরে প্রবেশ করে মধু সংগ্রহ, মাছ শিকার এবং ঘরবাড়ি নির্মাণের প্রয়োজনীয় কাঠ ও গোলপাতা সংগ্রহে বাধ্য করে। আর এভাবে বনে জেলে-বাওয়ালীদের কাছ থেকে অর্থ পাওয়ার জন্য অনেকে ডাকাত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।

সাতক্ষীরার নওয়াবেঁকী বিড়ালী গ্রামের মৌয়াল আব্দুর রশিদ বলেন, গত মওসুমে মহাজনের কাছ থেকে ৮২ হাজার টাকার চালান নামিয়ে প্রথমবার বনে গিয়েই পুঁজি শেষ। বনে নামার আগেই বনদস্যুদের দাবিকৃত ১৬ হাজার টাকা মিটিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু চার দিনের মাথায় পুষ্পকাঠি এলাকায় একই বনদস্যু দলের অন্য সদস্যরা এক মণ মধুসহ চৌদ্দ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। রাজগুল মোল্যা ও কওছার আলীসহ কয়েকজন মৌয়াল জানান, মধুর পাস নিতে বন বিভাগকে ৮০০ টাকা দিতে হয়। কিন্তু ডাকাতদের মিটাতে হয় মাথাপিছু ১৫০০ টাকা। তাদের দু’জনের দু’টি দলের জন্য বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিতে আট হাজার করে টাকা খরচ হলেও ডাকাতদের দিতে হয় ১২ হাজার করে টাকা। টাকা না দিয়ে বনে ঢুকলে ধরা পড়ার পর দ্বিগুণ অর্থ আদায়সহ শারীরিক নির্যাতনের মুখোমুখী হতে হয়।

সুন্দরবনে জেলে-বাওয়ালী আর ডাকাতের বসবাস জনপ্রিয় টমঅ্যান্ডজেরী কার্টুনের মতো। বনের জেলেদের জীবনকাহিনী নিয়ে রচিত সমরেশ বসুর উপন্যাস ‘গঙ্গা’য় সেই ব্রিটিশ আমল থেকে বনে জেলে আর ডাকাতের পাশাপাশি উপস্থিতির বর্ণনা পাওয়া যায়। তারা সবাই বনে যাচ্ছেন জীবিকার টানে। বাঘের থাবায় প্রাণ হারানোর মতো অনেক কষ্টে উপার্জিত অর্থ ডাকাতের হাতে তুলে দেয়াকেও বনজীবীরা নিজেদের নিয়তি বলে মেনে নিতে বাধ্য হন।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/448820/