১৬ অক্টোবর ২০১৯, বুধবার, ১:০৩

রাষ্ট্রের সফলতা ও ব্যর্থতা

ইবনে নূরুল হুদা : গণমানুষের জন্য কল্যাণকামী, ক্রিয়াশীল ও অপরিহার্য সংঘ হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের সফলতা ও ব্যর্থতা পাশাপাশি থাকলেও এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। মূলত রাষ্ট্রের বুৎপত্তিই হয়েছে সভ্যতাকে অগ্রগামী ও পরিশীলিত করার জন্য। আর রাষ্ট্র বলতে এমন এক রাজনৈতিক সংগঠনকে বোঝায় যা কোনো একটি ভৌগোলিক পরিসর ও তৎসংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার সার্বভৌম ক্ষমতা সংরক্ষণ করে। রাষ্ট্র সাধারণত একগুচ্ছ প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ হিসাবে সংশ্লিষ্ট ভৌগোলিক সীমার ভেতর বসবাসকারী সভ্যদের শাসনের জন্য নিয়ম-কানুন তৈরি এবং জনস্বার্থে প্রয়োগ করে থাকে। আর এ প্রয়োগ যখন যথাযথ হয় তখন রাষ্ট্র সফল ও সার্থক হয়ে ওঠে। অন্যথায় রাষ্ট্রের নামের সাথে যুক্ত হয় ব্যর্থতার তকমা।

ম্যাক্স ওয়েবারের প্রভাব বিস্তারকারী সংজ্ঞানুযায়ী রাষ্ট্র হচ্ছে এমন এক সংগঠন যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে আইনানুগ বলপ্রয়োগের সব মাধ্যমের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রাখে। এসবের মধ্যে রয়েছে সশস্ত্রবাহিনী, নাগরিক সমাজ, আমলাতন্ত্র, আদালত এবং আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। উদ্দেশ্য সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনের মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা। বস্তুত, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এটিই।

মূলত সুশাসন প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও অত্যাবশ্যকীয় অনুসঙ্গ। সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও জাতীয় সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের কর্তব্য। কারণ, সার্বভৌমত্ব না থাকলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বও কল্পনা করা যায় না। তাই রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রমই পরিচালিত হয় সুশাসন, নাগরিক অধিকার ও জাতীয় স্বার্থকে কেন্দ্র করে। কিন্তু রাষ্ট্র যখন এসব ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়, তখন সে রাষ্ট্রকে সফল বলার সুযোগ থাকে না। বিশেষ করে শাসনপ্রক্রিয়া যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উচ্চাভিলাষের বৃত্তে আবর্তিত হয়, তখন সুশাসনের বিচ্যুতি ঘটে। আর সুশাসন এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সকল শ্রেণির মানুষের অধিকার নিশ্চিত হয় এবং জাতীয় স্বার্থ অক্ষুন্ন থাকে। এই প্রক্রিয়ায় শাসনকাজে জনগণ স্বাধীনভাবে অংশগ্রহণ করে; সরকারের নীতি ও কর্মকান্ড সম্পর্কে অবগত হয় এবং নাগরিকরা স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করার অধিকার লাভ করে। মূলত সাংবিধানিক শাসনই হচ্ছে ‘সুশাসন’; যেখানে রাষ্ট্র সকল নাগরিকের অধিকারের ক্ষেত্রে সমতা বিধান করে এবং জাতীয় স্বার্থ সবার ওপরে প্রাধান্য পায়।

রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে নির্বাহী বিভাগ একটি। এই বিভাগের নিয়ামক শক্তিই হচ্ছে আমলাতন্ত্র। বস্তুত, আমলাতন্ত্রের গতিশীলতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সুশাসনের অপরিহার্য অনুসঙ্গ। কারণ, আমলারাই সরকারের সকল কর্মসূচি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করে থাকেন। তারা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। তাই সুশাসনের ক্ষেত্রে আমলাদের ভূমিকার বিষয়টি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কারণ, সরকার, জনগণ ও আমলাতন্ত্রের ত্রিমাত্রিক সেতুবন্ধনই পারে রাষ্ট্রকে সফল ও সার্থক করে তুলতে। আর আমলাতন্ত্রের বিচ্যুতি সুশাসনের ক্ষেত্রে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। তাই আইন ও সাংবিধানিক শাসনের জন্য একটি পেশাদারী, গতিশীল, দলনিরপেক্ষ ও দক্ষ গণপ্রশাসনের কোনো বিকল্প নেই।

আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান এটিই সুশাসনের মূল কথা। আমাদের সংবিধানেও এ নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তা অনেকটা ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে’ মতোই শোনায়। কিতাবে আছে গোয়ালে নেই। আইন আছে তার বাস্তব প্রয়োগ নেই। সরকার আছে সুশাসন নেই। নির্বাচন আছে জনগণের ভোটাধিকার নেই। মনে হয় সবকিছুই যেন উইপোকায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। নীরব ঘাতকের মতই সবকিছুই অন্তঃসারশূন্য করে ফেলছে একের পর এক। ফলে রাষ্ট্রাচারের বিচ্যুতি ও নাগরিকরা তাদের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি নেতিবাচক ও স্বার্থান্ধ রাজনীতির কারণেই নাগরিক অধিকার এখনো সবার জন্য সমান্তরাল করা সম্ভব হচ্ছে না। অপরাজনীতি ও রাজনীতির কক্ষচ্যুতির কারণেই নাগরিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের নায্য অধিকার থেকে। যা স্বাধীন ও সভ্য সমাজে মোটেই কাঙ্খিত নয়।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এজন্য প্রধানত দায়ি। কারণ, কোন দেশের রাজনীতি যখন সংঘাতপ্রবণ হয়ে ওঠে তখন সেদেশে ইতিবাচক কিছু হওয়ার সুযোগ থাকে না। তেমনটিই হয়েছে আমাদের ক্ষেত্রে। ফলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের অনুকূলে আমাদের দেশে জাতীয় ঐক্যমত গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি বরং দিন যতই যাচ্ছে ক্ষমতাপ্রেমীরা নিজেদের ক্ষমতার অভিযাত্রাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য প্রভূ, গোষ্ঠী ও শ্রেণি তোষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। উপেক্ষিত হচ্ছে সর্বজনীন জনস্বার্থ ও নাগরিক অধিকার। এমনকি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিতেও কুন্ঠাবোধ করা হচ্ছে না বরং তথাকথিত বন্ধুত্বের নামে উজার করে দেয়া হচ্ছে সবকিছু। বিনিময়ে আদায় করা যাচ্ছে না কানাকড়িও। প্রাপ্তির খাতাটা শূন্যই থাকছে বরাবরই। ফলে আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতিস্বত্ত্বাও হাসি-তামাশার বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। বিষয়টি উদ্বেগের হলেও স্বার্থান্ধমহল একেবারেই ভাবলেশহীন। কারণ, আত্মপূজা যখন মুখ্য, তখন দেশ, জাতি ও জাতীয় স্বার্থ সেখানে গৌণ হবে এটাই স্বাভাবিক।

মূলত রাষ্ট্রাচারের ব্যর্থতা ও নেতিবাচক রাজনীতির কারণেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রাচীনকাল ও মধ্যযুগে রাষ্ট্রকে মনে করা হতো ঈশ্বরের সৃষ্টি করা প্রতিষ্ঠান। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রকে ‘সর্বজনীন কল্যাণ সাধনকারী’ এবং ‘মানুষের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য’ সংঘ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। আর রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জনসাধারণকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করা, সমাজের শান্তি ভঙ্গকারীদের শাস্তির বিধান করা এবং সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণি ও পেশা নির্বিশেষে সকল শ্রেণির নাগরিকদের অধিকারের সমতা বিধানও রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব এবং আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমারা বৈশ্বিক মানদন্ডে খুবই পশ্চাদপদ।

মূলত রাষ্ট্র যখন তার গণমুখী চরিত্র হারিয়ে ফেলে তখনই মানুষে মানুষে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার চেয়ে নিজেদের আত্মপুঁজার অনুসঙ্গগুলোই মুখ্য হয়ে ওঠে। আর রাজনীতি যখন শুধুই ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে তখন রাষ্ট্র আর কল্যাণমুখী থাকে না বরং শ্রেণি বা গোষ্ঠী বিশেষের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থের অনুসঙ্গ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে প্রচলিত আইন, সংবিধান, শিষ্টাচার, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও রাষ্ট্রাচারের ঐতিহ্য কোনো কিছুই আমলে নেয়া হয় না। ক্ষমতাই যখন মুখ্য, তখন জাতীয় স্বার্থ, মূল্যবোধ ও জনস্বার্থ সেখানে গৌণই হয়ে পড়ে।

সঙ্গত কারণেই জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আমাদের তেমন সাফল্য নেই। আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম যে, এবার বোধহয় তিস্তার পানি বন্টন সহ প্রতিবেশীর সাথে দ্বিপাক্ষিক সমস্যারগুলোর সমাধান হবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি পড়েছে ইতোমধ্যেই। অনেক প্রত্যাশার পরও কাঙ্খিত তিস্তাচুক্তি না হলেও ফেনী নদীর পানি ইতোমধ্যেই বিসর্জন দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় আমাদের এই বৃহত প্রতিবেশী চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের ভূখ- দিয়ে দেশটির ট্রেন চলবে এখন খবরও বাতাসে ভাসছে। ফলে তিস্তাচুক্তির স্বপ্নের যে অপমৃত্যু হয়েছে যে, তা মোটামোটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। যদিও এই চুক্তি নিয়ে বরাবরের মত এবার আশার বাণী শোনানো হয়েছে কিন্তু তা নিয়ে আশান্বিত হওয়ার মত কোন আলামত পাওয়া যাচ্ছে না বরং বিষয়টি রীতিমত আত্মাহুতি দেয়া হয়েছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এমন আত্মাহুতির সমালোচনা করার জন্য নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে। বিষয়টি গণতান্ত্রিক ও সভ্য সমাজের জন্য সত্যিই লজ্জার।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আগে সরকার বিরোধিতা বা সমালোচনাকে রাষ্ট্রোদ্রোহিতা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও সে অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। এখন জাতীয় স্বার্থে কথা বলাকেও আমলী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। আর এর বিচারের জন্য কোনো আইন বা আদালতের প্রয়োজন হচ্ছে না বরং সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনই দ-মু-ের কথা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিষয়টি আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত অমিত সাহার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার বক্তব্যের নির্যাস হচ্ছে উপরের নির্দেশে বাধ্য হয়েই তারা এই ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। ভিকটিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো সে ক্ষমতাসীনদের অপছন্দের একটি ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত এবং সে সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশের সাথে সম্পাদিত চুক্তিগুলোর সমালোচনা করেছে। ফলে তার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য বিবেচিত হওয়ায় তাকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ভিন্নমতের কারণেই এভাবে মানুষ পিটিয়ে হত্যার ঘটনার নজীর শুধু আমাদের দেশেই।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ধরনের নির্যাতন প্রতিনিয়তই ঘটছে। বিশেষ করে দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে নিজেদের অপকর্মকে নির্বিঘœ করার জন্যই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কথিত ‘শিবির’ তকমা লাগানো হচ্ছে। নিজেদের অপকর্ম আড়াল করার জন্য একশ্রেণির দুর্বৃত্ত এটিকে হাতিয়ার বানিয়েছে। আর এভাবেই অবলীলায় চলছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দলন, পীড়ন ও নির্যাতন। এমনকি মতের মিল না হলে সাধারণ মানুষ অশুভ তৎপরতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। যার সর্বসাম্প্রতিক ভিকটিম হচ্ছে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। একজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা কোন ভাবেই কাঙ্খিত নয় বরং এই দুঃখজনক ঘটনা রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার দিকেই অঙুলী নির্দেশ করে।

এখানেই শেষ নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রচারে একটা উড়ণচ-ী ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও অভ্যন্তরীণ উভয় ক্ষেত্রেই। সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ক্ষমতার প্রভাব বলয়কে কেন্দ্র করেই। সঙ্গত কারণেই বরাবরই উপেক্ষিত হচ্ছে জনস্বার্থ। নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার জন্য ক্ষমতাসীনরা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে চ-নীতির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণভাবে শ্রেণি তোষণের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। যা সুশাসনের জন্য অন্তরায় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মূলত নিজেদের ক্ষমতাকে নির্বিঘœ ও নিরঙ্কুশ করার জন্য যা করা দরকার তাই করা হচ্ছে। ইদানিং সে প্রবণতা আগের তুলনায় বেড়েছে।

সে ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সরকারি চাকরি আইনের গেজেট নোটিফিকেশন জারি করে তা কার্যকারিতাও দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা অনুযায়ী বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে এই আইনটি প্রণয়নের কাজে হাত দিয়েছিল। প্রায় দশ বছর পর আইনটির গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। যা বিশেষ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে এবং আইনটি সংবিধানের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক ও আইনের শাসনের পরিপন্থী বলেই মনে করছেন সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, সম্প্রতি জারি করা সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ এর একাদশ অধ্যায়ের ৪১ এর (১) উপধারায় সরকারি কর্মচারিদের ফৌজদারি অপরাধ বিষয়ে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারির দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র গ্রহণ হওয়ার আগে তাকে গ্রেফতার করতে হলে সরকারের বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নিতে হবে। ২ উপধারায় বলা হয়েছে, কোন সরকারি কর্মচারির বিরুদ্ধে আদালতে ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন থাকলেও বিভাগীয় মামলা দায়ের বা নিষ্পত্তিতে কোন বাধা থাকবে না।

মূলত সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ প্রণয়নের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক ধরনের ‘ইনডেমনিটি’ তথা দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনে এ ধারা দুদকের আইনের যে প্রধান্য তা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেলায় খর্ব করবে। ফলে দুর্নীতির পরিসর আগের তুলনায় বাড়বে। বস্তুত, ফৌজদারী মামলা ছাড়াও দুর্নীতির মামলায় আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করার আগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করতে চাইলে সরকারের অনুমতি নেয়ার যে বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে তা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক ধরনের ‘ইনডেমনিটি’ দিয়েছে। অথচ সংবিধানে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীনে ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। সর্বোপরি জনগণের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্ব্বোচ আইন। কিন্তু আমলাদের জন্য নতুন আইন প্রণয়নে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মানা হয়নি। কারণ, আমাদের সংবিধানের ১৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন’।

এমনকি সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমূহের ২১ অনুচ্ছেদে নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্যে বলা হয়েছে, (১) সংবিধান ও আইন মান্য করা, সুশৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা, জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। (২) সকল সময়ে জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত সকল পর্যায়ের ব্যক্তিদেরকে কর্মচারী বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদ থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব, সকল বাহিনীর প্রধান, সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারী থেকে নিম্নতম পর্যায়ে গ্রাম্য চৌকিদার পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। সর্বপরি এই সকল ব্যক্তিরা প্রথমত বাংলাদেশের নাগরিক। তাই তারা কেউই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বাইরে নয়। কিন্তু নতুন আইনে শ্রেণিবিশেষকে আনুকূল্য দেয়ার জন্য সংবিধান ও প্রচলিত আইনের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে।

মূলত একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ সম্পদ আহরণে প্রজাতন্ত্রের দুর্নীতিবাজ কর্মচারীরা সর্বাত্বক সহযোগিতা করে আসছে। এতে অসৎপ্রকৃতির আমলাদেরও ‘পোয়াবারো’ হয়েছে একথাও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আর উভয় পক্ষের অশুভ ও অনাকাঙ্খিত সখ্যতার কারণেই ৩০ ডিসেম্বরের মত একটি ‘মিডনাইট’ নির্বাচনও আমাদেরকে হজম করতে হচ্ছে। আর সরকারি কর্মচারিদের জন্য নতুন আইনকে তার প্রতিদান হিসেবেই মনে করা হচ্ছে। কারণ, এই আইনের মাধ্যমে আমলাদের বিশেষ মর্যাদা ও আইনের উর্দ্ধে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রাখা হয়েছে। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী সহ কোন শ্রেণির নাগরিকই আইনের উর্ধ্বে নয়। আর সকল নাগরিকের জন্য আইন সমানভাবে প্রযোজ্য হবে এটাই সুশাসনের কথা।

বিষয়টি আত্মসচেতন মানুষকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের মূল চেতনা ও অভীষ্টের পরিপন্থী প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের জন্য সরকারের পূর্বানুমতির বিধান রেখে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ কার্যকর করার সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয় দক্ষ, জনবান্ধব, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক জনপ্রশাসন নিশ্চিত করতে আইনের চোখে সকল নাগরিক সমান অধিকারের যে সাংবিধানিক বিধান তার সাথে সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক। তাই বিভিন্ন মহল থেকে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এই আইনকে প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে।

মূলত জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন পেশাজীবীসহ সাধারণ জনগণের প্রতি বৈষম্যমূলক বিধানাবলি রেখে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ কার্যকর করার সিদ্ধান্ত সংবিধান পরিপন্থী বলে সকল মহল থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আইনটি এভাবে কার্যকর হলে বর্তমান সরকারের আমলেই প্রণীত ও বাস্তবায়নরত জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সাথেও এটি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া, ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেফতারের পূর্বে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণের বিধান ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ৫৪ ধারার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। দুর্নীতিবাজ ও অসৎ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ অব্যাহত থাকবে মর্মে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণারও সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষে জোরালোভাবে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণা এবং সরকারের দুর্নীতিবিরোধী বাচনিক অবস্থান জনমনে যে প্রত্যাশার সৃষ্টি করেছে, এ আইনটি কার্যকর হওয়ায় তা রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এছাড়া, বিতর্কিত বিধানটি দুদকের কার্যক্ষমতা অনেকাংশে খর্ব করে সম্পূর্ণ অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত হওয়ার ঝুঁকির সৃষ্টি করেছে। যা শুধু উদ্বেগজনকই নয় বরং বেআইনী ও অসাংবিধানিক।

সদ্য কার্যকর হওয়া সরকারি চাকুরি আইনের আইন ও সাংবিধানিক দিক এবং বিভিন্ন দুর্বলতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে ভিন্নতর পরিসরে আলোচনা হচ্ছে। অবশ্য তারা এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, নতুন আইন প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততা, স্বচ্ছতা, উন্নততর পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন নিশ্চিতের পরিপন্থী। তাদের মতে, সরকারি চাকরি আইন নামটিই সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। এ আইনটির নাম হওয়া উচিত ‘জনপ্রশাসন আইন’।

এ ছাড়া, গ্রেফতারের পূর্বে সরকারের অনুমতি গ্রহণের বিধানটি বাস্তবে সরকারি খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধের পরিবর্তে আইনের ছত্রছায়ায় এ ধরনের অপরাধের সুরক্ষা ও এর ব্যাপকতা বাড়ার ঝুঁকি আরো বৃদ্ধি পাবে। ফলে সুশাসন ও স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

মূলত সংবিধান নিয়ে ক্ষমতাসীনরা অনেক উচ্চবাচ্য করলেও তাদের দ্বারাই সংবিধান ও জাতীয় স্বার্থ বারবার উপেক্ষিত হচ্ছে। দেশ ও জাতির চেয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠী স্বার্থ, সংঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থ। ফলে দেশে অপশাসন, দুঃশাসন, জুলুম-নির্যাতন, দুর্নীতি, চাঁদাবাজী, হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য সহ নানাবিধ অপরাধ প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে বৈ কমছে না। সম্প্রতি যার নির্মম ভিকটিম হয়েছে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। যা কখনো কাঙ্খিত ছিল না। তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই অশুভ বৃত্ত থেকে আমাদেরকে অবশ্যই বেড়িয়ে আসতে হবে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক নেতিবাচক রাজনীতি পরিহার করে সকলকে অবশ্যই ইতিবাচক রাজনীতিতে ফিরে আসতে হবে। অন্যথায় স্বাধীনতার স্বপ্নগুলো আমাদের কাছে অধরায় থেকে যাবে। রাষ্ট্রও সফল হবে না বরং আমাদেরকে ব্যর্থতার গ্লানিই বহন করতে হবে।

inhuda71@gmail.com

https://www.dailysangram.com/post/393046