১৪ অক্টোবর ২০১৯, সোমবার, ১১:২৪

আবরার হত্যা

অচেতন আবরারকে স্কিপিং রোপ দিয়ে আঘাত করে মোজাহিদুল

মামলার ৫ আসামি কারাগারে; শামীম বিল্লাহ ও মোয়াজ রিমান্ডে

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের সদস্য মুজাহিদ মোজাহিদুল ওরফে মোজাহিদুর রহমান ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। গতকাল দুপুরে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম নিভানা খায়ের জেসির খাস কামরায় সে এই জবানবন্দী দেয়। মুজাহিদ মোজাহিদুল ওরফে মোজাহিদুর রহমান আবরার হত্যায় এজহার ভুক্ত ৯ নম্বর আসামি এবং বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সদস্য। এ নিয়ে আবরার হত্যাকাণ্ডে ৪ আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। 

পুলিশ ও আদালত সূত্র বলছে, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মুজাহিদ মোজাহিদুল ওরফে মোজাহিদুর রহমান স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারের শরীরে বেধড়ক আঘাত করার কথা স্বীকার করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আবরারকে মারধর করে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ইফতি ক্যান্টিনে খেতে যায় বলে জানায় মোজাহিদুল। এরপর মিনিট বিশেক পর ফিরে এসে দেখে আবরার অচেতন হয়ে মেঝেতে শুয়ে আছে। তখন সে আবরারকে ধমক দিয়ে উঠে দাঁড় করায় এবং কয়েকটি চড় মারে। মুজাহিদুর রহমান তখন কক্ষে থাকা স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে বেধড়ক মারধর করার কথা স্বীকার করেছেন। এ ছাড়া সে জানায়, ওই সময় ইফতি আবার স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু ও পায়ে আঘাত করে। তানভিরও চড়-থাপ্পড় মারে। মারধরের সময় নিজের ভূকিকা এবং অন্যদের ভূমিকার বিষয়ও তথ্য দিয়েছেন মোজাহিদুল।

রাত ১১টার দিকে অনিক সরকার আবার কক্ষে আসে। হঠাৎ অনিক স্টাম্প দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে আবরারকে একের পর এক আঘাত শুরু করে। এভাবে টানা এক ঘণ্টা আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে অনিক সরকার। আবরার তখন অচেতন হয়ে পড়েছিল। উহ আহ শব্দটি পর্যন্ত করেনি। সে সময় সেখানে উপস্থিত সবাই ভয় পেয়ে যায়। এরপরই ওদের মনে আচড় কাটে আবরারকে হয়তো আর বাঁচানো যাবে না। এরপর শুরু হয় মোবাইলে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাসেলের সাথে যোগাযোগ করা। এভাবেই আবরার হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন মুজাহিদ মোজাহিদুল ওরফে মোজাহিদুর রহমান।

এর আগে আবরারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত এজাহারনামীয় মো: শামীম বিল্লাহ (২০) ও মোয়াজ আবু হুরায়রা (২০) প্রত্যেকের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন বিজ্ঞ আদালত। এ ছাড়া মামলায় পাঁচ আসামিকে পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গতকাল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো: ওয়াহিদুজ্জামান পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে আসামিদের আদালতে হাজির করে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। আসামিপক্ষে জামিন চেয়ে আবেদন করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদ শুনানি শেষে জামিন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

যাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে তারা হলেনÑ বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ, গ্রন্থ ও প্রকাশনা সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ ওরফে মুন্না, সদস্য মুনতাসির আল জেমি ও খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ওরফে তানভীর। গত ৮ অক্টোবর আসামিদের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
এ দিকে একই মামলায় শামীম বিল্লাহ এবং মোয়াজের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো: ওয়াহিদুজ্জামান আসামিদের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদ শুনানি শেষে পাঁচ দিন করে রিমান্ডের আদেশ দেন।

রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, ৬ অক্টোবর রাত ৮টা ৫ মিনিটের দিকে আবরারকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে পরের দিন রাত আড়াইটা পর্যন্ত হলের ২০১১ এবং ২০০৫ নম্বর কক্ষে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ক্রিকেট স্ট্যাম্প এবং লাঠি-সোটা দিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রচণ্ড মারধর করা হয়। এর ফলে ঘটনাস্থলে আবরারের মৃত্যু হয়।

আবরারের মৃত্যু নিশ্চিত করে আসামিরা ওই ভবনের দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে তার লাশ ফেলে রাখে। পরে কিছু ছেলে আবরারের লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মামলার সুষ্ঠু তদন্ত, মূল রহস্য উদঘাটন, অন্যান্য সহযোগী ও এজাহারবহির্ভূত পলাতক আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেফাতর, কোনো হুকুমদাতা থাকলে তাদের শনাক্ত করা এবং কী কারণে এ রকম নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সেসব তথ্য জানার জন্য আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের প্রার্থনা করেন তদন্ত কর্মকর্তা। রাষ্ট্রপক্ষে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান (হিরণ) জামিন নামঞ্জুর করে রিমান্ড মঞ্জুরের প্রার্থনা করেন।

শুনানিতে তিনি বলেন, আবরার হত্যা মামলা দেশবাসীর বিবেককে নাড়া দিয়েছে। বিশ্ব তাকিয়ে আছে এ মামলার কী বিচার হয়। আসামিরা এজাহারভুক্ত। আবরার মেধাবী ছাত্র। বুয়েট থেকে বিশ্বমানের ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গ্রামে ফিরে গিয়ে সে তার বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু বিনাকারণে নির্মমভাবে পিটিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের প্রার্থনা করছি।

শামীমের পক্ষে তার আইনজীবী ফকির আব্দুল মজিদ রিমান্ড বাতিল চেয়ে শুনানি করেন। তিনি বলেন, শামীমের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। দুর্ভাগ্যক্রমে তাকে মামলায় সম্পৃক্ত করা হয়েছে। সে পাশের রুম থেকে আসার পথে দ্বিতীয় ভিডিও ফুটেজে তাকে দেখা গেছে। এ মামলায় ঘটনাস্থল থেকে যারা গ্রেফতার হয়ে এবং স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে শামীমের বিরুদ্ধে তারা কিছু বলেনি। এ ঘটনায় জাতি শোকাহত, মর্মাহত। আমরাও শোকাহত, মর্মাহত। মামলাটির তদন্ত চলছে। নিরপেক্ষ তদন্ত হয়ে আসুক। এ অবস্থায় শামীমের রিমান্ড বাতিলের প্রার্থনা করছি। প্রয়োজনে তাকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক।

আসামি মোয়াজের পক্ষে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ কামরুল হোসেন বলেন, আসামি বুয়েটে শিক্ষার্থী। হলের করিডোরে আসা যাওয়ার পথে তাকে দেখা গেছে। যে আসামিরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে তারা কেউ তার নাম বলেনি। জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে তাকে জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। আসামিপক্ষের আইনজীবীদের প্রতি উত্তরে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, রাত আড়াইটার সময় আসামিরা আসা-যাওয়া করছিল। তাদের এত পড়াশোনা। আসলে তারা সেখানে পাহারা দিচ্ছিল। উভয়পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে আদালত আসামিদের কাছে কিছু বলার আছে কি না জানতে চান। তবে আসামিরা কোনো কথা বলেননি। এরপর আদালত আসামিদের পাঁচ দিন করে রিমান্ডের আদেশ দেন।

গত ৬ অক্টোবর রোববার রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল (ইইই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই রাতে হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে পরের দিন সন্ধ্যার পর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়। নিহত আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদি হয়ে মামলাটি করেন।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/448005