১৩ অক্টোবর ২০১৯, রবিবার, ৪:৩০

ছাত্রলীগ সভাপতি-সম্পাদকের কক্ষসহ ৩টি সিলগালা: বুয়েটে ১০ টর্চার সেল

বুয়েটে ছাত্রদের চার আবাসিক হলে ১০টি টর্চার সেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। ছাত্রলীগ নেতাদের ওইসব কক্ষে (টর্চার সেল) বিভিন্ন শিক্ষার্থীকে ধরে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো।

শনিবার অভিযান চালিয়ে তিনটি কক্ষ সিলগালা করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। যেখানে বুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দুটি কক্ষ রয়েছে। এছাড়া হলগুলোর অতিথি কক্ষেও মাঝেমধ্যে চলত এ নির্যাতন। এর মধ্যে আহসানউল্লাহ হলের অতিথি কক্ষটি উল্লেখযোগ্য। এই অতিথি কক্ষের পাশের রুমটিও তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এই কক্ষটিও টর্চার সেল হিসেবে বেশ পরিচিত। যেটি দলীয় কর্যালয়ের মতো ব্যবহৃত হতো বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক (ডিএসডব্লিউ) অধ্যাপক মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমরা প্রভোস্টদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছি। এরই মধ্যে তিনটি রুম সিলগালা করা হয়েছে। তথ্য পাওয়া সাপেক্ষে বাকিগুলোও সিল করা হবে। অছাত্রদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ছাত্রলীগের নির্মম নির্যাতনে নিহত বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর বেরিয়ে আসছে নির্যাতনের নানা ঘটনা। বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ- তুচ্ছ সব বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো হতো মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন। একজন শিক্ষার্থীকে নিজের সহপাঠীদের দিয়ে থাপ্পড় দেয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন দফায় মারধরের এমন কিছু ঘটনা কল্পনাকেও হার মানায়। হকিস্টিক, ক্রিকেটের স্টাম্প কিংবা রড দিয়ে এমন সব জায়গায় আঘাত করা হয়, যাতে কাউকে দেখানোর উপায় না থাকে। এছাড়া কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ থাকলে রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে এবং ভিন্নমতের আখ্যা দিয়ে চালানো হতো নির্যাতন। এক্ষেত্রে ‘শিবির’ এবং ‘জঙ্গি’ ট্যাগ লাগানো ছিল প্রধান হাতিয়ার। দিনের পর দিন এমন নির্যাতন চালানো হলেও হল প্রভোস্ট বা তার সহকারীরা এগিয়ে আসতেন না। বরং কোনো কোনো হলের প্রভোস্ট নির্যাতনকারী শিক্ষার্থীদের কাছে অনেকটা জিম্মি ছিলেন। অনেকটা লুকিয়ে তারা হলে দায়িত্ব পালনের জন্য যাতায়াত করতেন।

একাধিক হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুয়েটের আটটি হলের মধ্যে চারটি হলে ১০ টর্চার সেল সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই পরিচিত। এসব কক্ষে শিক্ষার্থীদের ডাক পড়লে ধরেই নেয়া হয় তিনি মার খেতে যাচ্ছেন। অন্য শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ করলে তার ওপরও চলে নির্যাতন। ফলে বুয়েটে ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ভয়ের ব্যাপার হয়ে উঠেছিল।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শেরেবাংলা হলের ২০১১ ও ৩০১২ নম্বর কক্ষ টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত। এছাড়া ২০০২ ও ২০০৫ নম্বর কক্ষেও ছাত্রলীগ নেতারা থাকেন এবং ওইসব কক্ষ সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে আতঙ্কের। এর মধ্যে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়েও আবরার ফাহাদকে নির্যাতনের অভিযোগ আছে। এই হলে থাকেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।

আহসানউল্লাহ হলের ১২৩, ৩২০, ৩২১ ও ৩২২ নম্বর কক্ষে প্রায়ই বিভিন্ন অভিযোগে শিক্ষার্থীদের ডেকে এনে মারধর করা হয়। এই হলেই থাকেন ছাত্রলীগ সভাপতি। আর কাজী নজরুল ইসলাম হলের ২০৫, ৩০১(ক), ৩১২ নম্বর কক্ষও মারধরের জন্য ব্যবহার করা হয়। এই হলে রুপক নামে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা থাকেন। ড. এমএ রশীদ হলের ৪০৫ নম্বর কক্ষও সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল আতঙ্কের।

শনিবার দুপুরে আহসানউল্লাহ হলে থাকা ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার জামিউশ সানির ৩২১ নম্বর রুম সিলগালা করে দিয়েছে বুয়েট প্রশাসন। এছাড়া হলের গেস্টরুমের পাশের একটি রুমও সিলগালা করা হয়। অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেই রুমটি ছাত্রলীগ তাদের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছিল। শেরেবাংলা হলে থাকা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক (বহিষ্কৃত ও আবরার হত্যা মামলায় গ্রেফতার) মেহেদী হাসানের ৩০১২ নম্বর রুমও সিলগালা করা হয়। এ ছাড়াও সোহরাওয়ার্দী হলের ১১২ নম্বর রুমও সিলগালা করে বুয়েট প্রশাসন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুয়েটের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা বেশি নির্যাতনের শিকার হয়। এমএ রশীদ হলের নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক এক শিক্ষার্থী যুগান্তরকে বলেন, আমাদের হলের ৪০৫ নম্বর কক্ষে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা হতো। ছাত্রলীগ নেতা মিনহাজ, অয়ন, সৌরভ ও বাঁধন মিলে শিক্ষার্থীদের এ রুমে অমানবিক নির্যাতন করত। আমার এক বন্ধুকে একবার ব্যাপক মারধর করা হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। আসলে কোনো ঝামেলায় না জড়াতে নির্যাতন নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না।

ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ না নিলে শিক্ষার্থীদের লিস্ট করা হয় এবং পরে সে অনুযায়ী ডেকে নিয়ে ইচ্ছামতো মারধর করা হয়। এছাড়া সামান্য কোনো বিষয় নিয়েও শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে টর্চার করা হয়। এক্ষেত্রে লাঠি, স্টাম্প, হকিস্টিকসহ কাছে যা পায়, তা দিয়েই অমানবিকভাবে মারধর করে। এমনকি ছাদের ওপর নিয়ে নির্যাতন করা হয়।

আবরারের হত্যার পর বুয়েটের সাবেক এক শিক্ষার্থী নিজে নির্যাতিত হওয়ার ছবিসহ ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন, যা এরই মধ্যে ভাইরাল হয়েছে। এনামুল হক নামের ওই শিক্ষার্থী জানান, এসব মারের দাগ (পিঠে আঘাতের চিহ্ন পোস্ট করা ছবি) আবরারের নয়, এগুলো তার শরীরেরই ছবি। আবরার মারা গেলেও সেবার ছাত্রলীগ কর্মীর নির্যাতনের পরও প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন তিনি।

এতে তিনি লেখেন, বুয়েটের ওএবির (পুরাতন একাডেমিক ভবন) দোতলায় মেকানিক্যাল ড্রয়িং কুইজ দেয়া শেষ হওয়া মাত্রই পরীক্ষার রুম থেকে ছাত্রলীগ নেতা তন্ময়, আরাফাত, শুভ্র জ্যোতির নেতৃত্বে ৮-১০ জন আমাকে শিক্ষকের সামনে থেকে তুলে নিয়ে আহসানউল্লাহ হলের তখনকার টর্চার সেল ৩১৯ নম্বর রুমে নিয়ে নির্যাতন করে। আমি কারও সঙ্গে রাগারাগি পর্যন্ত করতাম না, কারও সঙ্গে কখনোই সম্পর্ক খারাপ ছিল না। শুধু ফেসবুকে সরকারি নীতির সমালোচনা করে পোস্টের কারণে বুয়েটের মতো একটা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগ আমার সঙ্গে এমন আচরণ করে।

তিনি আরও লিখেছেন, এসব অপরাজনীতি থাকলে ক্যাম্পাসে রক্ত ঝরবেই। তাই নির্যাতিত ছাত্র হিসেবে দাবি জানাই, ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত হোক, ছাত্র এবং শিক্ষকদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক।

জানা গেছে, গত এক মাসেই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগ অন্তত আট থেকে ১০টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটায়, যার বেশির ভাগই শিবির সন্দেহে পিটুনি। এছাড়া নেতাদের দেখলে সালাম না দেয়া, ডাইনিং ও টিভি রুমে সিট ছেড়ে না দেওয়াসহ অসংখ্য ছোট ছোট কারণেও বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করেন। লাঠি দিয়ে পেটানো, হাত-পা ভেঙে দেয়া, হল থেকে বের করে দেয়া বুয়েট ছাত্রলীগের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

শিক্ষার্থীর অভিযোগ, ৩ অক্টোবর রাতে শেরেবাংলা হলের ২০০২ কক্ষে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এহতেশামকে মারধর করে। মারধরে অংশ নেন আবরার হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশারফ সকাল, সহসম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু, উপদফতর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ। মারধর শেষে এহতেশামকে এক কাপড়ে হল থেকে বের হয়ে যেতে বলে। এহতেশামকে তার ব্যবহার্য কোনো জিনিসপত্রও নিতে দেয়া হয়নি। বের করে দেয়ার একদিন পর তার জিনিসপত্র নিতে গেলে তা পাওয়া যায়নি।

তাদের আরও অভিযোগ, ২৭ জুন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মেরে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছিল প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী অভিজিৎ করের। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী অভিজিৎ কর ৩০ জুন নিজের ফেসবুক পোস্টে তার ওপর নির্যাতনের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করেন। ফেসবুকে তার বর্ণনা অনুযায়ী, ২৭ জুন রাত সাড়ে ১২টার দিকে আহসানউল্লাহ হলের ২০৫ নম্বর রুমে তাকেসহ প্রথম বর্ষের বেশ কয়েকজনকে ডেকে আনা হয়। তারপর এক এক করে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তাদের মারধর করা হয়। এর মধ্যে দাড়ি রাখার জন্য একজনকে কষে থাপ্পড় মারা হয়। জ্যেষ্ঠ ছাত্রকে সালাম না দেয়ার কারণে আরেকজনকে বেধড়ক মারধর করা হয়। এরপর অভিজিৎ করকে চুল লম্বা রাখার কারণে থাপ্পড় দিয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়া হয়। তাকে আরও মারধরও করা হয়।

এছাড়া গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর রশিদ হলে ৩০৮ নম্বর কক্ষে ১৫তম ব্যাচের পুরকৌশল বিভাগের মেহেদী হাসান ও নেভাল আর্কিটেকচার বিভাগের নীলাদ্রি নিলয় দাস শিবির সন্দেহে মেকানিক্যাল বিভাগের সাদ আল রাজিকে মারধর করেন। গত বছর রশিদ হল ফেস্টের ফি না দেয়ার কারণে ১৪তম ব্যাচের সিভিল বিভাগের মিনহাজ, অয়ন, সৌরভ; ১৫তম ব্যাচের সিভিল সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারি বিভাগের নাসিমকে বেধড়ক প্রহার করা হয়। ওই হলের ৪০৫ নম্বর রুমে এই মারধরের ঘটনা ঘটে।

২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী সাখাওয়াত অভিকে মিছিলে যেতে বলেন উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা। কিন্তু তার মিছিলে যেতে একটু দেরি হওয়ায় অমিত তাকে শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে বেধড়ক প্রহার করেন। এতে তার হাত ভেঙে যায়। তবে তাকে বলতে বাধ্য করা হয়, সিঁড়ি থেকে পড়ে হাত ভেঙে গেছে।

গত বছর রশিদ হলের ১১ ব্যাচের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অনুপ, ১৩ ব্যাচের পানিসম্পদ বিভাগের সম্রাট, ১৪ ব্যাচের মিনহাজ শিবির সন্দেহে ও ১৩ ব্যাচের নগর পরিকল্পনা বিভাগের সেতুকে মারধর করে হল থেকে বের করে দেন।

২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে শেরেবাংলা হলের গেস্টরুমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কর্মরত তিন সাংবাদিককে মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এক শিক্ষার্থীকে আটকে নির্যাতনের ঘটনায় সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে তাদের আটকে রেখে মারধর করা হয়। মারধরে অংশ নেন শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক নাফিউল আলম ফুজি, যুগ্ম সম্পাদক ইফতেখারুল হক ফাহাদ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক এসএম মাহমুদ সেতু।

তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাসিম আফরোজ তাজ যুগান্তরকে বলেন, আবরার হত্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর যে নির্যাতন, এরই অংশ এই আবরার হত্যাকাণ্ড। যারা এতদিন ভয়ে এই নির্যাতনের বিষয়ে মুখ খুলতে চায়নি, এখন তারা অভিযোগ করেছে প্রশাসনের কাছে। বুয়েট প্রশাসনের উচিত যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, এখন তাদের ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেয়া।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/231292