১৩ অক্টোবর ২০১৯, রবিবার, ২:৩৮

ছাত্রলীগের অপরাজনীতি এবং যুবলীগের ক্যাসিনো কাণ্ডের পথ ধরে চারদিকে গণজাগরণের সৃষ্টি

বহুদিন পর, প্রায় ১২/১৩ বছর পর দেশে গণজাগরণের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। আমি এখানে ‘গণ অভ্যুত্থান’ শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকছি। কারণ অসন্তোষ যতই থাক, যতই পুঞ্জিভূত হোক সেই অসন্তোষ, সেই পুঞ্জিভূত অসন্তোষের বিস্ফোরণ না ঘটলে সেটিকে গণ অভ্যুত্থান বলা যায় না। একটির পর একটি ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রথমে ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক রাব্বানীকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদচ্যুত করেন। যদি কোনো রাজনৈতিক কারণে করতেন তাহলে অন্য কথা ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির নিকট থেকে ২ কোটি টাকা ঘুষ আদায়ের অভিযোগে তাদেরকে পদচ্যুত করা হয়েছে।

ছাত্রলীগকে হিট করার পর পরই প্রচণ্ড আঘাত আসে যুবলীগের ওপর। এসব ঘটনা এতই সাম্প্রতিক যে তার পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন নাই। প্রথমে যুবলীগ নেতা খালেদকে গ্রেফতার করা হয় এবং সেখান থেকেই প্যান্ডোরার বাক্সের মতো উন্মেচিত হয় ক্যাসিনোর দুয়ার। শত শত কোটি টাকা উড়ে বেড়িয়েছে ঢাকা এবং মফস্বলের ক্যাসিনো গুলোতে। গ্রেফতার হয়েছে জি কে শামীম, কৃষক লীগের ধানমন্ডি ক্রীড়া চক্রের নেতা, মতিঝিল ক্যাসিনোর রথি মহারথি, সবশেষে সম্রাট। শুক্রবার গ্রেফতার করা হয়েছে মোহাম্মদপুর থেকে পাগলা মিজানকে। তার কাছ থেকেও এফডিআরসহ ৮ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। সারাদেশটাকে জুয়াড়িদের আড্ডায় পরিণত করা হয়েছে।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো এই যে, যেদিন সম্রাটকে গ্রেফতার করা হয় সেই দিনই বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগের ঘাতক ও পাণ্ডারা নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করে হত্যা করে। আবরার হত্যাকাণ্ড যেন বারুদে আগুন দেয়ার মতো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সমাজের সকল শ্রেণি থেকে এর প্রচণ্ড প্রতিবাদ করা হয়। বুয়েটের ছাত্ররা ১০ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। ২৪ ঘন্টার মধ্যে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। মুহূর্তের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে। আরও অবাক ব্যাপার হলো এই যে, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে স্থির থাকতে পারেনি বাইরের জগত। সুইজ্যারল্যান্ড, জার্মানি, ইংল্যান্ড এবং আমেরিকা ছাত্রলীগের এই নৃশংসতার সমালোচনা করে এবং এর বিচার দাবি করে। এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্ত আবরার হত্যার নিন্দা করে এবং এর সুষ্ঠু বিচার দাবি করে। ৪২ হাজার ছাত্রের বিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে এবং তাদের সমর্থনে বিশাল মিছিল বের করে। এমনিভাবে চতুর্দিকে গণ অভ্যুত্থান না হলেও গণজাগরণের সৃষ্টি হয়।

এই গণজাগরণের চাপেই সাময়িকভাবে বিজয় হয়েছে ছাত্রসমাজের, বিশেষ করে বুয়েটের সাধারণ ছাত্রদের। গত ১১ তারিখ শুক্রবার বুয়েটের ভিসি আন্দোলনরত ছাত্রদের সাথে বসেছিলেন। এটা ঠিক কোনো বৈঠকের মতো ছিল না। এটা ছিল ওপেন এয়ার বৈঠক। সেই বৈঠকে অনেক আন্দোলনকারী ছাত্র ছিলেন এবং সাংবাদিকরাও ছিলেন। অডিটোরিয়ামের মধ্যে সেই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। শহীদ আবরারের নির্যাতনের সময়, মৃত্যুর পর এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত জানাজায় তিনি উপস্থিত হতে পারেননি বলে ভাইস চ্যান্সেলর সাইফুল ইসলাম শত শত ছাত্রের সামনে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়েছেন। যেসব দাবি ভিসি মেনে নিয়েছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে (১) রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন বুয়েটে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। (২) যে ১৯ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের সকলকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, অর্থাৎ সাময়িক ভাবে বুয়েট থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। (৩) ছাত্রদেরকে র‌্যাগিং করা বা হেনস্থা করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। (৪) আবরারের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। (৫) আবরার হত্যা সম্পর্কে যে মামলা হবে সেই মামলায় আবরারের পক্ষে সমস্ত খরচ বহন করবে বুয়েট। (৬) ইতোপূর্বে নির্যাতনের যত ঘটনা ঘটেছে তার সবকটিরই তদন্ত করা হবে।

॥দুই॥
অবশিষ্ট দাবিগুলো পূরণ করা হয়নি। এজন্য এই কলাম লেখার দিনেও অর্থাৎ শনিবার ছাত্রদের আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়নি। তবে তারা ভর্তি পরীক্ষার জন্য ২ দিনের জন্য আন্দোলন শিথিল করেছেন। যে ৫টি দাবি পূরণ করা হয়নি সেগুলো হলোÑ (১) হত্যাকারীদের বুয়েট থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হবে এ মর্মে নোটিশ দেয়া, (২) সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধের জন্য অবৈধ ছাত্রদের সিট বাতিল করা, (৩) সাংগঠনিক অফিস সিলগালা করা, (৪) ফাহাদের মামলার খরচ দেয়ার নোটিশ দেয়া (৫) ভিন্নমত দমানোর নামে নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করা এবং (৬) এ ধরনের ঘটনা প্রকাশে একটি কমন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সব হলের সিসিটিভির ফুটেজে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা। আন্দোলনরত ছাত্ররা বলছে যে, ভিসি স্যার চাইলে এক ঘন্টার মধ্যে এই ৫/৬ টি দাবি পূরণ করা সম্ভব। সেজন্যই বলেছিলাম যে ছাত্রদের আংশিক বিজয় হয়েছে পূর্ণ বিজয় এখনো হয়নি। পূর্ণ বিজয় অর্জনের পথে নতুন কোনো অন্তরায় সৃষ্টি হয় কিনা সেটি দেখার জন্য ১৪ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

প্রথমে বলেছি যে বুয়েট ছাত্রদের সাময়িক বিজয় হয়েছে। ‘সাময়িক’ শব্দটি ব্যবহার করেছি এজন্য যে সাময়িক বহিস্কার বা সাসপেন্ড করা স্থায়ী বহিস্কার নয়। ভিসি বলেছেন আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থায়ী বহিস্কার না করলে উচ্চ আদালতে সেই বহিস্কার চ্যালেঞ্জড হতে পারে এবং এসব ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ হেরে যায়। দ্বিতীয় কারণ, অভিযুক্ত ১৯ জনের মধ্যে এই কলাম লেখা পর্যন্ত সকলকেই অর্থাৎ ১৯ জনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। কাউন্টার টেরোজিমের প্রধান এবং ঢাকার অতিরিক্ত মেট্টোপলিটন পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন যে, যাদের নামে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে তারা ছাড়াও অন্য কারো যদি সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় তাহলে তাদেরকেও গ্রেফতার করা হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন যে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুততম সময়ে ‘নিখুত’ চার্জশিট দেওয়া হবে। সাধারণ ছাত্র এবং জনগণের চাপে চার্জশিট ঠিকই দেওয়া হবে। কিন্তু সঠিক বিচার কতদূর হবে অথবা ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে কিনা সেটি এই মুহুর্তে বলা যাচ্ছে না। কারণ এব্যাপারে অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।

কারণ ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হন আবুবকর নামের এক শিক্ষার্থী। তিনি ছিলেন এক দিন মজুরের সন্তান। এ ঘটনায় এফ রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি সাইদুজ্জামান ফারুকসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় শাহবাগ থানার পুলিশ। কিন্তু মামলার রায়ে ২০১৭ সালের ৭ মে ছাত্রলীগের সাবেক ১০ নেতা-কর্মীর প্রত্যেককে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। ২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মীদের নির্যাতনে অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ নিহত হন। তিনিও ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মী ছিলেন। ছয় বছর পর হাইকোর্ট অভিযুক্ত পাঁচ ছাত্রলীগের কর্মীকে মৃত্যুদন্ড দিলেও সেই রায় কার্যকর হয়নি।

॥তিন॥
আমরা যদি আরেকটু পেছনে তাকাই দেখতে পাব, ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের সময় সন্ত্রাস বিরোধী মিছিল করছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মঈন হোসাইন ওরফে রাজু ও তাঁর বন্ধুরা। সেই মিছিলে সন্ত্রাসীদের গুলীতে রাজু খুন হলেও পুলিশ অভিযোগপত্র জমা দিতে পারেনি। রাজুর স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। সেই ভাস্কর্যের নিচে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবিতে সমাবেশ করেন। কিন্তু হত্যার বিচার হয়নি।

গত ১০ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮টি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো ২০১৬ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যা। লাশ উদ্ধারের তিন দিন পর ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেলের চিকিৎসকদের দেওয়া প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনাটি ‘আত্মহত্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে দিয়াজের মা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী জাহেদা আমিন চৌধুরী বাদী হয়ে আদালতে হত্যা মামলা করেন। মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন, ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি আলমগীর টিপুসহ ছাত্রলীগের ১০ নেতা-কর্মীকে আসামী করা হয়। দিয়াজের মায়ের আপত্তিতে আদালত সিআইডিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই এক প্রতিবেদনে চিকিৎসকেরা দিয়াজের শরীরে হত্যার আলামত পাওয়ার কথা জানান। বর্তমানে মামলাটি পিআইবির তদন্তাধীন। দিয়াজের মা সন্তান হত্যার বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু তদন্ত কাজ শেষ হয় না।

॥চার॥
ফিরে আসছি বর্তমান পরিস্থিতিতে। এখন পর্যন্ত পরিবেশ খুব গরম। কারণ ফাহাদের এই পৈশাচিক হত্যাকান্ড কেউ মেনে নিতে পারেননি। হত্যাকান্ডের পরদিনই শুধু বুয়েট নয়, ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা প্রভৃতি বিশ^বিদ্যালয় প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে। বুয়েটের শিক্ষক সমিতি ছাত্রদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। বুয়েটের প্রাক্তন এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন ভিসির নির্লিপ্ততার জন্য তার তীব্র সমালোচনা করেছে এবং এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে প্রখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার জামিলুর রেজা চৌধুরী, ভিসি সাইফুলের পদতাগ দাবি করেছেন। ইংল্যান্ড, জার্মানি, আমেরিকা এবং জাতিসংঘ আবরার হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন।
আগেই বলেছি যে, সারা দেশে একটি গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে। সেই গণজাগরণের চাপে সরকার ছাত্রদের অনেক দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। যত দ্রুতই মামলা পরিচালনা করা হোক না কেন, মামলা শেষ করতে কম করে হলেও দুমাস লাগবে। এই দ্ ুমাসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ভাবেই শান্ত হয়ে আসবে। তখন মামলার রায় কি হয় সেটি নিয়ে অনেকের মধ্যে এখন সংশয় বিরাজ করছে।

কোনো রকম রাজনৈতিক চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে গণ আন্দোলনকে থামানো সম্ভব বলে মনে হয় না। কারণ রাজনীতিবিদরা দাবি করছেন যে, ক্যাসিনো ডন খালেদ, জি কে শামীম, স¤্রাট প্রমুখ যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষের জেরার মুখে যেসব তথ্য ফাঁস করেছেন তার মধ্যে বর্তমান সরকার এবং প্রশাসনের অনেক রাঘব বোয়াল রয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট এবং বিএনপির নেতারা দাবি করেছেন যে, ঐ সব মাফিয়া ডনদের জেরায় যেসব রুই কাতলার নাম এসেছে সেগুলো প্রকাশ করা হোক এবং তাদেরকে অবিলম্বে গ্রেফতার করা হোক। সরকার যদি সেটা না করে তাহলে চলমান আন্দোলন থামবে বলে মনে হয় না। বরং সেটি নতুন ডাইমেনশন পাবে। সেই আন্দোলন অচিরেই এই সরকারের পদত্যাগ এবং পুনর্নির্বাচনের দাবিতে পর্যবসিত হতে পারে। কথায় বলে যে, আন্দোলন নাকি জমে শীতকালে। শীতকাল সমাগত। এখন আগামী দুই আড়াই মাসে বিরোধী দল কতখানি নাড়া দিতে পারে তার ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতি।

Email: asifarsalan15@gmail.com

https://www.dailysangram.com/post/392718