গতকাল শুক্রবার বুয়েট এলাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের করে -সংগ্রাম
১২ অক্টোবর ২০১৯, শনিবার, ২:১৬

পঞ্চম দিনেও ছাত্র বিক্ষোভে উত্তাল বুয়েট

  • ঘোষনায় আশ্বস্ত নন ছাত্ররা
    * ১৪ তারিখের ছাত্র ভর্তি পরীক্ষা বন্ধে অনড় শিক্ষার্থীরা
    * ক্যাম্পাস এখনও নিরাপদ নয়
    * দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে
    স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ১৯ শিক্ষার্থীকে বুয়েট থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে বলে ভিসি অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন। গতকাল শুক্রবার বিকালে বুয়েট অডিটোরিয়ামে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক বৈঠকে ভিসি তাদের এ দুটি দাবি পূরণের কথা জানান। আবরার খুন হওয়ার পর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু ঘাটতি থাকার কথা স্বীকার করে অধ্যাপক সাইফুল হলভর্তি শিক্ষার্থীদের সামনে বলেন, আমার ঘাটতি ছিল। পিতৃতুল্য হিসেবে আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। তিনি বলেন, তোমাদের ১০টা দাবি আমি হাতে পেয়েছি। তোমরা আমার সন্তানের সমান। সন্তানের মত মনে করি। সিসি টিভি থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত অনুসারে আমরা সরকারের উঁচু পর্যায়ে যোগাযোগ করেছি এ ব্যাপারে। তোমাদের দাবির প্রেক্ষিতে মামলার এজাহারভুক্ত ১৯ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হল। পাশাপাশি বুয়েটে কোনো রকমের সাংগঠনিক রাজনীতি থাকবে না। তবে ভিসির ঘোষণার পরও আশ্বস্ত হতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাস এখনও নিরাপদ নয়, মনে করেন আন্দোলনকারীরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
    শিক্ষার্থীদের সবগুলো দাবিই মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ভিসি বলেন, আবরারের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে এবং মামলার খরচ বুয়েট কর্তৃপক্ষ বহন করবে। বিচারকাজ দ্রুত শেষ করতে সরকারকে চিঠি দেওয়া হবে। বুয়েটে র‌্যাগিং বন্ধ হবে।
    গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টায় কানায় কানায় পূর্ণ বুয়েট অডিটোরিয়ামে এ বৈঠক শুরু হয়। শুরুতেই আবরারের জন্য পালন করা হয় এক মিনিট নীরবতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সাইদুর রহমানের পরিচালনায় ভিসি অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের সঙ্গে সভামঞ্চে ছিলেন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক মিজানুর রহমান, শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে এম মাসুদ এবং কয়েকজন ডিন। বুয়েটের বর্তমান চারটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের শর্ত অনুযায়ী সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও এ সভা দেখার সুযোগ পান।
    আগের ঘোষণা অনুযায়ী, বুয়েটের মেইন গেইট থেকে দুই দফা পরিচয়পত্র পরীক্ষা করে শিক্ষার্থীদের অডিটোরিয়ামে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। বিকাল ৩টার পর থেকেই লাইন ধরে আইডি কার্ড দেখিয়ে অডিটোরিয়ামে ঢোকেন শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকরা।
    ক্যাম্পাস এখনও নিরাপদ নয় : বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) প্রশাসনের দলীয় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা ও ১৯ জনকে সাময়িক বহিষ্কারের আশ্বাসের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, হলগুলোতে এখনও দলীয় নেতাকর্মী রয়েছে। ১৯ জন সাময়িক বহিষ্কার হলেও তাদের স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়নি। এছাড়া সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা হলেও আবারও যে শুরু হবে না তার নিশ্চয়তা তারা পাচ্ছেন না। এ কারণে আগামী ১৪ অক্টোবর ভর্তি পরীক্ষা না নেওয়ার পক্ষে মত দেন তারা।
    শিক্ষার্থীরা মনে করেন ক্যাম্পাস এখনও অনিরাপদ। তাই ক্যাম্পাসে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে নতুনদের বিপদের মুখে ফেলতে চান না তারা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চান পরীক্ষা নিতে।
    বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ডিএসডব্লুউ পরিচালক ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি জানান, স্থায়ী বহিষ্কার করা হলে পরে আদালতে হেরে যেতে হয়। এবার যাতে হেরে যেতে না হয়, সেজন্য আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটি করেছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করবে।
    হলগুলো রাজনৈতিক নেতাদের দখলমুক্ত করার ব্যাপারে ডিএসডব্লিউ পরিচালক বলেন, যাদের থাকার বৈধতা নেই, তাদের বের করে দেওয়া হবে। প্রয়োজনে আজকেই হলগুলোতে ক্লিনিং অভিযান হবে।
    তবে এসব আশ্বাস মানতে চাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা। এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসন ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে আলোচনা চলছে।
    পঞ্চম দিনের বিক্ষোভে বুয়েট : আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে টানা পঞ্চম দিনের মত বিক্ষোভ করছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। দশ দফা দাবিতে আন্দোলনরত এই শিক্ষার্থীরা গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় বুয়েটের শহীদ মিনার চত্বরে সমবেত হলে স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠে ক্যাম্পাস। এরপর শিক্ষার্থীরা একটি বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। বুয়েটের শহীদ মিনারের প্রাঙ্গণ দিয়ে মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গা প্রদক্ষিণ করে। এরপর তারা আবার এসে শহীদ মিনারের সামনে অবস্থান নেন।
    এ সময় তারা দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। সাংবাদিক সম্মেলন শেষে আবার বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিলে আবরার ফাহাদ হত্যাকারীদের ছাত্রত্ব বাতিল, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি নিশ্চিত করা এবং বুয়েটকে সন্ত্রাসমুক্ত করার দাবি জানানো হয়। এসময় আন্দোলনকারীরা ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, খুনিদের ফাঁসি চাই’/ ‘ফাঁসি ছাড়া যাব না, যাব না যাব না’/ ‘খুনিদের ঠিকানা, এই বুয়েটে হবে না’/ ‘সন্ত্রাসীদের ঠিকানা, এই বুয়েটে হবে না’/ ‘শিক্ষা সন্ত্রাস, এক সাথে চলে না’/ ‘বহিষ্কার বহিষ্কার, খুনিদের বহিষ্কার’/ ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’/ ‘প্রশাসন নীরব কেন, জবাব চাই দিতে হবে’ স্লোগান দেন।
    আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি মাহমুদুর রহমান সায়েম বেলা সোয়া ১১টায় শহীদ মিনার চত্বরের সমাবেশ থেকে বলেন, আমরা যে দশ দফা দাবি দিয়েছি, এখনও তার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি আমরা দেখিনি। দাবিগুলো বাস্তবয়নে সদিচ্ছার অভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি। তিনি বলেন, ভিসি বর্তমান শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে একান্তে একটি কক্ষে কথা বলতে চান মিডিয়ার উপস্থিত ছাড়া। কিন্তু তারা জানিয়ে দেন, বর্তমান চারটি ব্যাচের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংবাদকর্মীদের উপস্থিতিতেই আলোচনা হতে হবে।
    সায়েম বলেন, ভিসির সঙ্গে আলোচনায় বুয়েটের শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র দেখে অডিটোরিয়ামে ঢুকতে দেওয়া হবে। টেলিভিশন চ্যানেল, দৈনিক পত্রিকা ও পরিচিত অনলাইন সংবাদপত্রগুলোর দুজন করে সংবাদকর্মীকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে। কোনো অপ্রচলিত বা ফ্রিল্যান্স সংবাদকর্মীকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। আলোচনা চলাকালে লাইভ টেলিকাস্ট করা যাবে না, তবে আলোচনা শেষে প্রচারের জন্য ভিডিও নেওয়া যাবে।
    শুক্রবার মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচির পাশাপাশি দুপুরে প্রতিবাদী পথনাটক ও গ্রাফিতি আঁকার কর্মসূচি রয়েছে বুয়েট শিক্ষার্থীদের। এছাড়া বুয়েট ডিবেটিং ক্লাবের আয়োজনে একটি প্রতীকী বিতর্কের আয়োজন করা হয়েছে। পরে তারা সবাই একসঙ্গে অডিটোরিয়ামে যাবেন ভিসির সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিতে।
    উল্লেখ্য, বুয়েটের শেরে বাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ও তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরারকে গত রোববার রাতে ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। তার পর আন্দোলন চালিয়েশ আসছেন শিক্ষার্থীরা। আবরার হত্যাকা-ের পর ‘দ্রুত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার জন্য’ সমালোচনার মুখে থাকা ভিসি সাইফুল ইসলাম গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীদের সামনে এসে তোপের মুখে পড়েন। সেদিন তাকে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা তালাবন্ধ করে রাখে আন্দোলনকারীরা। পরদিন কুষ্টিয়ায় আবরারের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েও এলাকাবাসীর প্রতিবাদের মুখে ফিরে আসতে হয় তাকে। দায়িত্বে ‘ব্যর্থতার জন্য’ ইতোমধ্যে ভিসির পদত্যাগ দাবি করেছে বুয়েট শিক্ষক সমিতি ও বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন।

https://www.dailysangram.com/post/392619