১১ অক্টোবর ২০১৯, শুক্রবার, ১২:৫৩

নতুন পথে বাংলাদেশ?

-মাসুম খলিলী

বাংলাদেশ কি নতুন এক পথে এগিয়ে যাচ্ছে? এই প্রশ্নটি সামনে আসতে পারে চলমান দুর্নীতি বা ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে শাসক দলের বড় বড় নেতাদেরও ছাড় না দেয়ার ঘোষণা থেকে। সম্ভবত রূপান্তরের বিষয়টি আরো অনেক গভীর। এটি ঠিক যে, বাংলাদেশের শাসক দল এক ধরনের গৃহদাহ বা উত্তরাধিকার সঙ্কটের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। ক্ষমতার উত্তরাধিকার একক পরিবারের মধ্যে আবর্তিত হলে এরকম হতে সাধারণভাবে দেখা যায়। বিশ্বের যেসব দেশে এখনো উত্তরাধিকারের মাধ্যমে ক্ষমতার আবর্তন ঘটছে, সেসব দেশের কোনো কোনোটিতে এ ব্যাপারে ধরাবাঁধা নিয়ম থাকে। সুনির্দিষ্ট থাকে ভার্টিক্যালি বা উল্লম্বভাবে উত্তরাধিকার নির্ণিত হবে, নাকি হরাইজন্টাল বা আনুভূমিকভাবে এটি হবে। বিশ্বের আলোচিত রাজতন্ত্রের মধ্যে সৌদি আরব কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরাত কোনোটাতেই এখন আর নিয়মবাঁধা প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার আবর্তন ঘটছে না। সৌদি আরবে সালমান ক্রাউন প্রিন্স বা বাদশাহ হওয়ার সময় রাজনীতি বা প্রশাসনে সক্রিয়, ভাইদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম ছিলেন না। অথবা তার পরে নিজের যুবক ছেলে যে মুহাম্মদকে উত্তরাধিকারী করেছেন, তারও একাধিক বড় ভাই ও চাচা রয়েছেন। আমিরাতেও এখনকার সবচেয়ে ক্ষমতাধর ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন জায়েদের যোগ্য জ্যেষ্ঠ ভাই রয়েছেন। কিন্তু তারা কর্তৃত্বের লড়াইয়ে পরাভূত। এখন দুই ‘মুহাম্মদ’ সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের সিংহাসনের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী।

বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় রাজতন্ত্রের কোনো স্বীকৃতি নেই। কিন্তু বড় দলগুলোতে রয়েছে এক প্রকার রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। আওয়ামী লীগে সংক্ষিপ্ত সময় বাদ দেয়া হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা একপর্যায়ে দলের হাল ধরেছেন। এর পরে মুজিব পরিবারের কেউ একজন দলের নেতৃত্বে আসবেন, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু দলের উত্তরাধিকার হরাইজন্টাল হবে নাকি ভার্টিকাল হবে, সেটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। রাজনীতিতে সক্রিয়, পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা সম্ভবত চাইছেন দলীয় নেতৃত্বের উত্তরাধিকার হরাইজন্টালি বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী প্রথম প্রজন্মের মধ্যেই হোক। তাহলে সন্তানরা পরে দলের নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী হতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় বর্তমান দলীয় প্রধানের মধ্যে থাকতে পারে। এ জন্য তিনি উত্তরাধিকারের লাইনটি সম্ভবত নিজের সন্তানদের মধ্যে রাখতে চান। এটি মানতে চাইছেন না পরিবারের গুরুত্বপূর্র্ণ অনেক সদস্য। শাসক দলের প্রধানের আকাক্সক্ষার প্রতি এই আনুগত্যহীনতার সাথে যুক্ত থাকতে পারে সাম্প্রতিককালে শাসক দল ও এর অঙ্গ সংগঠনের মধ্যকার শুদ্ধি অভিযান।

রাষ্ট্র পরিচালনায় অধিক ব্যস্ততার কারণে হোক অথবা সমঝোতার অংশ হিসেবে হোক, এক সময় দলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলো অন্তরালে থেকে বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যাকে দেখতে দিয়েছিলেন বড় বোন। দলের নেতৃত্বে মধ্যে যাদের হাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তথা বৈধ-অবৈধ উপার্জনের হাতিয়ার থাকে, তাদেরই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় দলে। আওয়ামী লীগের মধ্যে সেটিই গত ১০ বছরে দেখা গেছে। পরিবারের জ্যেষ্ঠ দুই ব্যক্তিত্বের মধ্যে এ নিয়ে বিরোধ ছিল না বলে কোনো টানাপড়েন এতদিন দেখা যায়নি। তৃতীয় মেয়াদে এসে উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি বেশ প্রবলভাবে সামনে চলে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই ছোট বোন হয়তো রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হতে চান।

মুজিবতনয়া হিসেবে স্বাভাবিকভাবে তার রাজনীতিতে আসার মানে হলো, নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হওয়া। গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনা পরম্পরায় মনে হচ্ছে তিনি সম্ভবত ক্ষমতার সাইড লাইনে পড়ে যাচ্ছেন এবং তার অনুসারীরা শুদ্ধি অভিযানে ছিটকে পড়তে যাচ্ছেন। আর দলের মধ্যে ভার্টিক্যাল উত্তরাধিকারের বিষয়টি প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।

বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের ক্ষমতার রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট দলগুলোতে দেশের বাইরের অনেক বিষয় যুক্ত থাকে। যেকোনো দল ক্ষমতায় থাকাকালে তার নেতৃত্বের উত্তরাধিকার বদলের সময় প্রভাবশালী কূটনৈতিক অংশীদারগুলোর ‘চাওয়া-পাওয়া’র বিষয় থাকে। এ কারণে সরকারপ্রধানের এবারে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে অংশগ্রহণ এবং এর আগে-পরে আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সফর নানা মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ প্রধানের কন্যা ও তার স্বামী কানাডা থেকে এর আগেই সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলে এসেছিলেন। সেখানে সরকারপ্রধানের জামাতার ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ রয়েছে। আর আমিরাতের শাসক পরিবারকে মধ্যপ্রাচ্য এবং মুসলিম বিশ্বের শাসক পরিবারে বিশেষভাবে প্রভাবশালী মনে করা হয়। আকার বা জনসংখ্যার বিচারে দেশটি তেমন প্রভাবশালী হওয়ার কথা নয়। এক সময় সৌদি আরবের প্রভাব বলয়ে থেকেই দেশটি তার পররাষ্ট্র্র্র কৌশলের চর্চা করত। কিন্তু এক দশক ধরে আমিরাত ইসরাইলের সাথে কৌশলগত গোপন সম্পর্ক তৈরি করার পর অনেক ক্ষেত্রে সৌদি নীতিকে চ্যালেঞ্জ করছে। আর মধ্যপ্রাচ্যে এবং গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশগুলোতে আবুধাবিকে বিশেষ কারণে ক্ষমতাধর মনে করা হয়। মুসলিম বিশ্বজুড়ে ইসলামিস্ট দমন কাজে দেশটি যে কাজ করছে, সেটাকে তার ক্ষমতার মূল ভিত্তি মনে করা হয়ে থাকে। হয়তো বা এ কারণে আমিরাতের সাথে সম্পর্ক থাকলে আন্তর্জাতিকপর্যায়ে ইসরাইলি লবির ছায়া লাভ করা সম্ভব বলে মনে করা হয়।

এই কারণে এবার নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের আগে প্রধানমন্ত্রীর আমিরাত সফরের সময় তার কন্যা সাথে ছিলেন। আমিরাত শাসক মুহাম্মদ বিন জায়েদের সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয় সেখানে মায়ের পাশে বসা ছিলেন সায়মা, এরপরের আসনে ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মোমেন। অন্য দিকে, মুহাম্মদ বিন জায়েদের পাশে ছিলেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। এর পর নিউ ইয়র্কে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী তনয়া মিসরের শীর্ষস্থানীয় জেনারেলদের সাথে বৈঠক করেছেন বলে জানা যায়। নিউ ইয়র্কে সাধারণ অধিবেশনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম এবং রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে ওআইসি-বাংলাদেশ যৌথসভার বাইরে শেখ হাসিনা অনানুষ্ঠানিক বেশ ক’টি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন। এর মধ্যে নরেন্দ্র মোদির সাথে সাইড লাইনে বৈঠক ছাড়াও ইন্দো-বাংলা-মার্কিন ত্রিপক্ষীয় বৈঠক ছিল। মনে করা হয় যে, এই বৈঠকটি বাংলাদেশের এক নতুন অভিযাত্রার জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। এর পেছনে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও দেশটির বিশেষ লবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বৈঠকটির পর ভারতে প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় সফর ছিল অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার।

বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের তৃতীয় দফা ক্ষমতাকালের পররাষ্ট্রনীতি বা কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার নীতি। এই নীতির অংশ হিসেবে দেশের উন্নয়নের বৃহৎ প্রকল্পগুলোতে ব্যাপকভাবে চীনা বিনিয়োগের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। চীন সরকার তাদের ঐতিহ্যগত কৌশল থেকে সরে এসে একতরফাভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয় আওয়ামী লীগ এবং দলটির পরিচালিত সরকারকে। ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যরাতের হিসেবে খ্যাত নির্বাচনে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছে বেইজিং। সেই নির্বাচনে জয়ের পর স্বর্ণ নির্মিত নৌকা নিয়ে শেখ হাসিনাকে প্রথম শুভেচ্ছা জানান বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত। বিএনপি প্রধানকে কারাবন্দী করে রাখা এবং দলটির নেতাকর্মীদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখেনি। ঐতিহ্যগতভাবে চীনমুখী পররাষ্ট্রকৌশলের কারণে ভারত ও পশ্চিমা দেশগুলোর বিরাগভাজন হলেও সর্বতোভাবে বিএনপিকে পরিত্যাগ করেছে বেইজিং। এর ফলে নতুন সরকারে চীনের পছন্দের লোকজন মন্ত্রিসভায় বেশি স্থান পেয়েছেন। বেশ কিছু বড় প্রকল্প চীনারা গ্রহণ করেছে এদেশে। বেইজিং বাংলাদেশকে সাবমেরিন সরবরাহ করে সাবমেরিন ঘাঁটি করার প্রস্তাবও দিয়েছে। রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানের ব্যাপারেও দেশটি অগ্রসর হতে থাকে।

কিন্তু এর পাল্টা কোনো চাপ মোকাবেলার জন্য কতটা প্রস্তুত ছিল দেশটি সেটি বোঝা যায় না। গত সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই প্রতিবেশী এবং পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো থেকে চীনকে ‘সম্পর্কের বসত ঘরের বাইরে’ রাখার জন্য চাপ যত বাড়তে থাকে তত বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ সরকারের অন্দরমহলে। শাসক পরিবারের ক্ষমতার উত্তরাধিকারে মেরুকরণ ঘটে যায়। চাপ অনুভূত হয় অনেক বড় মাত্রায়। এতে চীনের সাথে বর্তমান সরকারের সম্পর্কের উষ্ণতা কমতে থাকে। শেষ পর্যন্ত বেইজিং ২৬ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব ‘পর্যালোচনা’ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে উন্নয়নের জন্য ‘ব্লাংক চেক’ দেয়ার কথা ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। ঢাকাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, চীন বিনিয়োগ না করলেও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আইএমএফ এবং এডিবি থেকে সেটি পূরণ করা হবে।

প্রধানমন্ত্রীর এবারের দিল্লি সফরে ফেনী নদীর পানি দেয়া, ভারতের ত্রিপুরায় তরল গ্যাস সরবরাহের চুক্তি, ভারতের দেয়া ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়ে সে দেশ থেকে অস্ত্র কেনা এবং সমুদ্র উপকূলের ২০ স্থানে ভারতের রেডার স্থাপনের চুক্তি দৃশ্যত ঢাকার চীনা প্রভাববলয় থেকে সরে আসার পরিষ্কার সঙ্কেত। নতুন এই ব্যবস্থার পরে চীনের অনুপ্রবেশ ঠেকানোর নামে বঙ্গোপসাগর এলাকায় আরো কড়া দৃষ্টি রাখবে ভারত। এ ব্যবস্থা শুধু সমুদ্রপথে যেকোনো জাহাজ বা বস্তু শনাক্ত করতে ভারতকে সাহায্য করবে না, একই সাথে বাংলাদেশের নৌসীমানায় তাদের আধিপত্য স্থাপনেও সহায়তা করবে।

এর বাইরে ঢাকায় সরকার যেকোনো নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়লে দিল্লির সামরিক সহায়তার গোপন এক চুক্তির বিষয়ও অনানুষ্ঠানিক গণমাধ্যম সূত্রে বলা হচ্ছে। এটি সত্য বা অসত্য যাই হোক না কেন, বাংলাদেশ যে ভারসাম্য রক্ষার আগের নীতি থেকে সরে এসে আবার প্রতিবেশী দেশের সাথে বিশেষ সম্পর্ক বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে তাতে কোনো অস্পষ্টতা নেই।

বেইজিংয়ের রাজনৈতিক সমর্থনের অনির্ভরতা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নানা সময় বিপদের কারণ হয়েছে। দেশটির সরকারে যারা থাকেন তাদের সাথে সম্পর্ক দৃঢ করার নীতির কারণে, বিপদে পড়ার সময়ের অবন্ধু হিসেবে তারা কিছুটা স্বীকৃতি লাভ করেছে। চীন তার বন্ধুদের রাজনৈতিক নিরাপত্তা দেয় না, শুধু ব্যবসায় করে- এই ধারণার কারণে বর্তমান সরকারও সম্ভবত চীনা সম্পর্কের কারণে বড় ধরনের ঝুঁকি নিতে চায়নি।

প্রশ্ন হলো- এর জন্য কতটা মূল্য দিতে হবে বর্তমান সরকার অথবা বাংলাদেশকে? এখন হয়তো অনেক প্রকল্পে চীন অর্থ ছাড় বন্ধ করে দেবে এবং নতুন প্রকল্প নেবে না। নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের ঢাকা সফর বাতিলও করা হতে পারে। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ থেকে এখন বিসিআইএম প্রকল্প বাদ পড়ে যেতে পারে। রোহিঙ্গা সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত হয়ে যাবে। এদেশে চীনা সমরাস্ত্রের স্থান করে নেবে বিকল্প সূত্রের সমরাস্ত্র। বাংলাদেশের ক্ষমতার গভীর বলয়ে চীনের কতটা অবস্থান রয়েছে- তা স্পষ্ট নয়। সে রকম কিছু না থাকলে দেশটিকে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে চীনের কাছে হাত পাতা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

বাংলাদেশ যেভাবে ‘আগ্রাসী’ মিত্রের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে, তাতে ভিন্ন কোনো চিন্তার সুযোগ ভুটানের মতো হারিয়ে যাবে কি না। ভুটানও অবশ্য তার সীমান্ত বিরোধের ক্ষেত্রে নিজস্বভাবে সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছে। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুসারে, ভুটান দিল্লির সাথে আলোচনা ছাড়াই সীমান্তে বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণরেখাকে স্থির সীমান্ত হিসাবে গ্রহণ করতে রাজি হয়েছে। এ হিসেবে, আলোচিত দোকলামের ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণ স্বীকৃত হয়ে যাবে যেটি কোনোভাবেই কামনা করেনি ভারত।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চার দিনের ভারত সফর শেষে যে সাতটি চুক্তি ও তিনটি সমঝোতা স্মারক এবার সই হয়েছে তাতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি দেখছেন না আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনের বক্তব্যেও বিষয়টি ফুটে উঠেছে। এবার তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। উল্টো ফেনী নদীর পানি তুলে নেবে ভারত। রোহিঙ্গা ইস্যুতে শক্তভাবে বাংলাদেশের পাশে দরকার ভারতকে। এনআরসি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আশ্বস্ত করলেও তার মন্ত্রীরা প্রতিনিয়তই হুমকি দিচ্ছেন। এগুলোর সুরাহা হওয়া দরকার। ভারত ও বাংলাদেশ যে যৌথ বিবৃতিটি প্রকাশ করেছে তার কোথাও ‘এনআরসি’ শব্দটির উল্লেখ পর্যন্ত নেই। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, ‘জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাহলে আন্তর্জাতিক স্তরের একটি যৌথ বিবৃতিতে কেন তার উল্লেখ থাকতে যাবে?’ অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার কিছু নেইÑ এই আশ্বাসটা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী মোদির মুখ থেকে আসুক। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বা অন্যান্য বিজেপি নেতা যেভাবে ক্রমাগত হুমকি দিয়ে চলেছেন যে, এনআরসি বাতিল হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বাংলাদেশেই পাঠানো হবে, সেই পটভূমিতে এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য জরুরি।

এ কারণেই হয়তো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে নয়, সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে আগ্রহী। কারণ তারা বাংলাদেশের জনগণের কোনো সুবিধার কথা চিন্তা করছে না। এতে তাৎক্ষণিকভাবে মনে হতে পারে, তারা জিতে গেছে। জনগণের কাছেও হয়তো এসব বলে দু-চারটি ভোটও বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু তাদেরও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকেও জনগণের কাছে এসব নিয়ে বলতে হবে। ফলে দেশের জনগণ বা সরকার যদি মনে করে, তারা আসলে প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাহলে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সুসম্পর্কে ফাটল ধরবে। এক সময় হয়তো আমাদের সরকার অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে অধিক মনোযোগী হবেন। সেটা তো ভালো হবে না।’

অন্য দিকে, ভারতের উপকূলে রেডার ব্যবস্থা স্থাপন করা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চীন বিভাগের ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী মনে করেন, আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দেশের তরফ থেকে যা-ই বলা হোক না কেন, দিল্লির সরকার ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপরাষ্ট্রে যে অত্যাধুনিক নজরদারির ব্যবস্থা গড়ে তুলছে তার আসল উদ্দেশ্য চীনের নৌবাহিনীর গতিবিধির দিকে নজর রাখা। তিনি বলেছেন, চীন সম্পর্কে ভারতের যে উৎকণ্ঠা রয়েছে এবং বাংলাদেশের সাথে চীনের যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তা কিছুটা নিষ্ক্রিয় করতেই ভারত সরকার অবশ্যই চাইবে এটা প্রমাণ করতে যে, ‘বাংলাদেশের ওপর তাদেরও কিছুটা হলেও প্রভাব রয়েছে।’

বাংলাদেশ ১৯৭৬ সাল থেকে চীনের সাথে ক্রমে ক্রমে বেশ ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এই সম্পর্ক গত ১০ বছরে গভীর ও নিবিড় আকার ধারণ করে। বিশেষত, ২০০৯ সাল থেকে চীনের সাথে বাংলাদেশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে। বাংলাদেশ ২০০৯ সাল থেকে তার সশস্ত্র বাহিনী, বিশেষভাবে বিমান ও নৌবাহিনীর, আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে চীনের কাছ থেকে ব্যাপক সাহায্য ও সহযোগিতা পেয়েছে। কিন্তু ভারতের সাথে এবারের চুক্তির পর সম্ভবত সেই অবস্থা পাল্টে যাবে। ভারত-চীন-যুক্তরাষ্ট্র মিলে যে একটি ‘স্ট্র্যাটেজিক ট্রায়েঙ্গেল ডায়নামিকস’ সৃষ্টি করেছে, বিশ্বব্যাপী তার গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু ভারত ও চীন উভয়ের সাথেই ঘনিষ্ঠ, তাই সে দেশের ওপর এবারের দিল্লি সমঝোতার একটা প্রভাব পড়তে বাধ্য।

এখন দেখার বিষয় হলোÑ বাংলাদেশের রাজনীতি, নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে সে প্রভাব কতখানি পড়ে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকেও সেটি প্রভাবিত করে কি না। হ

http://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/447096