৪ অক্টোবর ২০১৯, শুক্রবার, ১১:২৯

কঠিন অবস্থায় ব্যাংকিং খাত

ব্যর্থ ১১ ব্যাংককে তলব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের

বিনিয়োগসীমা নিয়ে দেয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ৫ দফা পরিবর্তন করার পরেও বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনা পরিপালন করতে ব্যর্থ হয়েছে ১১টি ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে পুরো ব্যাংকিং খাতই এখন ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১১ ব্যাংককে তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিটি ব্যাংকের সাথে আলাদা আলাদা বৈঠক করা হচ্ছে। বিনিয়োগসীমা নির্ধারিত সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হচ্ছে। একই সাথে নির্ধারিত সীমার মধ্যে নামিয়ে না আনলে নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থতার শাস্তির বিষয়েও জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে দু’টি ব্যাংকের সাথে বৈঠক করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবগুলোই বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আগ্রাসী ব্যাংকিং বন্ধে বিনিয়োগসীমা ৮৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৮৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়; কিন্তু প্রায় দুই বছর আগে এ নির্দেশনা দেয়া হলেও ১১টি ব্যাংক এখনো তা পরিপালন করতে পারেনি। বরং কিছু ব্যাংক ও ব্যাংকের চেয়ারম্যানের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার ৫ দফা পরিবর্তন করা হয়েছে। সর্বশেষ সাড়ে ৮৩ শতাংশের সীমাও ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১৭ সেপ্টেম্বর পঞ্চমবারের মতো সার্কুলার সংশোধন করে বিনিয়োগসীমা সাড়ে ৮৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮৫ শতাংশে ফিরে নিতে হয়। আর ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ৮৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হয়।
পঞ্চমবারের মতো সার্কুলারটি সংশোধন করার পরেও ১১টি ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা ৮৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে। কোনো কোনোটির বিনিয়োগসীমা ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে সমগ্র ব্যাংকিং খাতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই টাকার সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে গড়ে প্রতিদিন এক হাজার কোটি টাকার ওপরে জোগান দিচ্ছে।

গত ২ অক্টোবর চারটি ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এক হাজার ২৩ কোটি টাকা জোগান দেয়া হয়েছে। গতকাল ৩ অক্টোবর সাতটি ব্যাংককে জোগান দেয়া হয়েছে এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের ঋণের জোগান দিতে বাধ্য পাঁচটি প্রাইমারি ডিলার ব্যাংককে ৭৯১ কোটি টাকা এবং দু’টি নন-পিডি ব্যাংককে ৩৪০ কোটি টাকার তহবিল জোগান দেয়া হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর ব্যয় করতে হয়েছে প্রতি ১০০ টাকার জন্য ছয় টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে তারা বিনিয়োগসীমা কমিয়ে আনতে পারছে না। এতে এক দিকে ব্যাংকিং খাতে টাকার সঙ্কট প্রকট হচ্ছে, অপর দিকে বৈদেশিক মুদ্রার ওপরেও চাপ বাড়ছে। মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখার স্বার্থেই ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগসীমা কমিয়ে আনার সময় বেঁধে দেয়া হচ্ছে।

বিনিয়োগসীমা বেশি এমন ১১ ব্যাংকের একটির তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলো এখন মহা বেকায়দায় আছে। বিনিয়োগসীমা প্রধানত নির্ধারিত হয় ঋণ ও আমানতের অনুপাতের ওপর। ১০০ টাকা আমানত নিলে ব্যাংকগুলো সাড়ে ৮১ টাকা বিনিয়োগ করতে পারে। একটি ব্যাংক ১০০ টাকা আমানত নিয়ে সাড়ে ৮১ টাকা বিনিয়োগ করল; কিন্তু কোনো আমানতকারী হঠাৎ তার প্রয়োজনে ১০ টাকার আমানত প্রত্যাহার করে নিলেনÑ এতে ১০০ টাকার আমানত কমে নামে ৯০ টাকা; কিন্তু ব্যাংক যেসব গ্রাহকের কাছে ঋণ দিয়েছে তাদের কাছ থেকে রাতারাতি বিনিয়োগ ফেরত আনতে পারে না। ফলে আমানত কমে যাওয়ার কারণে ঋণসীমা বেড়ে যায়। একে তো আমানতের সুদহার কম, অপর দিকে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বেশি হওয়ায় সাধারণ গ্রাহক ব্যাংক থেকে আমানত তুলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছে। এভাবেই প্রতিনিয়তই আমানতের পরিমাণ কমছে; কিন্তু কাক্সিক্ষত হারে ঋণ আদায় না হওয়ায় আনুপাতিক হারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বেড়েই যাচ্ছে।

জানা গেছে, বিনিয়োগসীমা বেড়ে যাওয়ার কারণে এক দিকে ব্যাংকগুলো আর নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছে না, অপর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থ হচ্ছে। আবার যারা ঋণ নিয়েছেন তাদের বেশির ভাগই ঋণ পরিশোধ করছেন না। বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক নাখোশ হচ্ছে। এভাবেই তারা এখন উভয় সঙ্কটে পড়েছে। নতুন করে ঋণ দিতে না পারায় ব্যাংকের আয়ও কমে যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এখন বেশির ভাগ ব্যাংক আমানত সংগ্রহের ওপর বেশি নজর দিচ্ছে। বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এতে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। সব মিলেই ব্যাংকগুলো এখন এক কঠিন বিপদের মুখে পড়ে গেছে।

অপর একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, কিছু কিছু ব্যাংকের তীব্র টাকার সঙ্কট চলছে। এর কারণ হিসেবে ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ব্যাংক থেকে একশ্রেণীর গ্রাহক নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে যাচ্ছেন; কিন্তু ওই ঋণ আর ফেরত দিচ্ছেন না। আবার খেলাপিও দেখানো হচ্ছে না। প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের ঋণ কাগজে-কলমে আদায় দেখানো হচ্ছে। ঋণ আদায় না হওয়ায় টাকার সঙ্কট প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে। এ দিকে, ঋণ বিতরণের টার্গেট দেয়া হচ্ছে না। শুধু আমানত সংগ্রহের টার্গেট দেয়া হচ্ছে। যেকোনো হারে আমানত সংগ্রহ করতে বলা হচ্ছে। ফলে ক্ষেত্রবিশেষ ১৪ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এ দিকে ১৪ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করা হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। এভাবেই ব্যাংকের মূলধন ঝুঁকির মুখে পড়ে যাচ্ছে।

ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে তদারকি করতে পারলে এখনই অনেক ব্যাংকের সমস্যা হয়ে যেত। কারণ, কিছু কিছু ব্যাংক খেলাপি ঋণসহ ব্যাংকের যেসব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সরবরাহ করছে তার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখেও না দেখার ভান করছে কিছু কিছু ব্যাংকের ক্ষেত্রে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এ অবস্থা সামনে অনেক ব্যাংকের ক্ষেত্রেও দেখা দেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সব কিছুর ঊর্ধ্বে থেকে দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরো সজাগ হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/445290/