১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ১২:৩৭

চালকের আসনে এরা কারা?

রাজধানীর পল্লবীতে গত ৩১ আগস্টের একটি ঘটনা। মিরপুর ১২ নম্বরের নাহার একাডেমির সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাব্বির (১৩) ছুটির পর বাসায় ফিরছিল। ২১ নম্বর সড়কের চার রাস্তার মোড়ে পৌঁছলে প্রজাপতি পরিবহনের একটি বাসের ধাক্কায় নিহত হয় সে। স্থানীয় লোকজন বাসটিকে আটক করে চালক সনক ওরফে শানুকে (২৫) পুলিশে সোপর্দ করে। এ ঘটনায় পল্লবী থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, আসামিকে আদালতের নির্দেশে এক দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি চালক নন। তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই। তিনি গাড়ির গ্যারেজের মিস্ত্রি।

রাজধানীতে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। সর্বশেষ শিকার সংগীত পরিচালক পারভেজ রবের পরিবার। তাঁকে পিষে মারার তিন দিন পর একই পরিবহন ভিক্টরের চাপায় ছেলে গুরুতর আহত এবং ছেলের বন্ধু নিহত হয়েছেন। ঘটনাটিকে ‘পরিকল্পিত হত্যা’ বলে দাবি করছে পারভেজের পরিবার। এই ঘটনায় ওই বাস সার্ভিসটির ভয়ংকর চিত্র ফুটে ওঠে। অন্যদিকে এক সপ্তাহের মধ্যে বিআইডাব্লিউটিসি কর্মকর্তা কৃষ্ণা রায় চৌধুরী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ফারাহ নাজসহ কয়েকটি ঘটনায় একই চিত্র দেখা গেছে। প্রশ্ন উঠেছে চালকের আসনে এরা কারা?

কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মর্মস্পর্শী এসব মৃত্যুর ঘটনায় সড়কে নিরাপত্তার বিষয়টি বারবার সামনে এলেও সফলতার নজির শূন্য। প্রতিবার প্রচলিত আইনে তদন্ত ও বিচারের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যান বেপরোয়া বাসচালকরা। মালিকরাও থাকছেন শাস্তির বাইরে। সাম্প্রতিক ঘটনায় দেখা গেছে, প্রয়োজনীয় লাইসেন্স না থাকলেও বাস চালাচ্ছেন অনভিজ্ঞ চালক। হেলপার বসছেন চালকের আসনে। প্রতিযোগিতা করে চালানোতে ঘটছে প্রাণহানি। বেপরোয়া চালনায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস উঠে পড়ছে ফুটপাতে। স্বজন হারানোর বিচার চেয়ে হতাশায় নিহতের পরিবার। ভুক্তভোগীরা বলছে, আইনের ফাঁক গলিয়ে বের হয়ে যায় বলেই চালকরা এমন বেপরোয়া। সড়কে প্রাণহানি নিয়ন্ত্রণে এসিড সন্ত্রাস আইনের মতো কঠোর আইন করার দাবি জানায় তারা।

গত এক বছরে শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীতে দুই দফা আন্দোলনে ৯টি দাবি উঠে আসে। এসব দাবি নিয়ে আলোচনা, ট্রাফিক সচেতনতা সপ্তাহ পালন, দুটি স্পিডব্রেকার ও ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করেই শেষ। শিক্ষার্থীরা বলছে, আশ্বাসেই আটকে তাদের দাবি।

গত ১৯ মার্চ প্রগতি সরণিতে জেব্রাক্রসিংয়ে সুপ্রভাত বাসের চাপায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহাম্মেদ চৌধুরী নিহত হন। আবরারের বাবা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আরিফ আহাম্মেদ চৌধুরী বাদী হয়ে গুলশান থানায় বাসের চালক সিরাজুল ইসলামসহ চারজনকে আসামি করে মামলা করেন। আসামি গ্রেপ্তারের পর গত ২৫ এপ্রিল আদালতে চার্জশিট দাখিল করে গোয়েন্দা পুলিশ। এতে বলা হয়, আবরারের মৃত্যুর সময় বাস চালান কন্ডাক্টর ইয়াছির আরাফাত। এ ঘটনায় তাঁকে ও মালিককে অভিযুক্ত করে চালক সিরাজুল ইসলাম ও হেলপার ইব্রাহিম হোসেনকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়। এ ঘটনার আগে পথচারী সিনথিয়া সুলতানা মুক্তাকে আহত করায় সিরাজুল ইসলাম, তাঁর সহকারী ইব্রাহিম হোসেন, কন্ডাক্টর ইয়াছির আরাফাত ও মালিক ননী গোপাল সরকারের বিরুদ্ধে আলাদা মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়।

মামলার তদন্ত-বিচারের বিষয়ে জানতে চাইলে আবরারের বাবা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আরিফ আহাম্মেদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসব বলতে চাই না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, যার যায় সে বুঝে। আমি কী ক্ষত নিয়ে আছি, বুঝি। কোথাও কথা বলছি, মনে হচ্ছে করুণা ভিক্ষা চাইছি। অযোগ্য লোকের হাতে যদি মারণাস্ত্র দেওয়া হয়, তবে যা হওয়ার এখন তা-ই ঘটছে। কঠোর আইন দরকার। এসিডে যেমন আইন করার পর কমেছে।’

আবরারের মৃত্যুর পর সড়কে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে নামেন বিইউপি শিক্ষার্থীরা। তাঁদের আন্দোলনে যুক্ত হন আরো কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। সে আন্দোলনের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ক নাজমুস সাকিব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটি ফুট ওভারব্রিজ হয়েছে। আমাদের সঙ্গে বসে মেয়র অনেক কাজের বিষয় দেখিয়েছেন। আশ্বাসের পর আর অগ্রগতি নেই।’

গত বছরের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে পাল্লা দিয়ে যাত্রী ওঠানোর সময় রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ১৪ শিক্ষার্থীকে চাপা দেয় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মীম। এ ঘটনায় ফুঁসে ওঠে শিক্ষার্থীরা। স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর দাবি জানায়। সড়ক নিরাপদ করতে তারা ৯ দফা দাবি জানায়। পরে আশ্বাসে ফিরে যায় ক্লাসে। ওই সময় এক দফায় এবং আবরারের মৃত্যুর পর দুই দফায় ট্রাফিক সচেতনতা মাস পালন করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। জানতে চাইলে অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রাণহানির জন্য চালক, পথচারী, মালিকসহ অনেকের দায় আছে। আমরা বাস মালিকদের সঙ্গে বসেছি। তাঁদের সচেতন করে অন্যদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে। ১০০টি স্পটে পথচারীদের ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা পারাপারের সময় ধরে বোঝানো হয়েছে।’

নিহত দিয়া খানম মীমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম নিজেও পেশায় যাত্রীবাহী বাসের চালক। মেয়েকে হারানোর পর থেকে তিনি আর বাস চালান না। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন ওরা তো রাস্তার পাশে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল। বাসের ড্রাইভার তো দূর থেকেই দেখছিল। সতর্ক থাকলে দুটি বাস রেষারেষি করে এমন ঘটনাটা ঘটাত না। আমি আর স্টিয়ারিং ধরি না।’

গত বছরের ৩ এপ্রিল কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারার কাছে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের বাসের প্রতিযোগিতায় হাত হারান তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ এপ্রিল রাতে মারা যান তিনি। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলায় বিআরটিসি বাসের চালক ওয়াহিদ ও স্বজন পরিবহনের বাসের চালক খোরশেদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এখনো চার্জশিট দেওয়া হয়নি। শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান বলেন, ‘তদন্ত এখন শেষ পর্যায়ে।’

গত ২৭ আগস্ট বাংলামোটরে বাসচাপায় বিআইডাব্লিউটিসি কর্মকর্তা কৃষ্ণা রায় চৌধুরীর পা বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনায় ১ সেপ্টেম্বর মিরপুর থেকে চালক মোরশেদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পরে মোরশেদ জবানবন্দিতে জানান, ঘটনার দিনই তিনি প্রথম বড় বাস চালান। তাঁর ছিল না প্রয়োজনীয় লাইসেন্সও। এ ঘটনায় ট্রাস্ট সার্ভিসেস লিমিটেডের বাস মালিক ইয়াসমিন ও চালকের সহকারীকেও আসামি করেন কৃষ্ণার স্বামী রাধে শ্যাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘শুনেছি, একজন ধরা পড়েছে। এরপর কী হবে জানি না।’

৫ সেপ্টেম্বর তুরাগে ইস্ট ওয়েস্ট হাসপাতালের সামনে থেকে বাসে ওঠার সময় ভিক্টর ক্লাসিক (ঢাকা মেট্রো-ব-১২-০৯৬৩) বাস চাপা দিয়ে সংগীত পরিচালক পারভেজ রবের প্রাণ কেড়ে নেয়। এ ঘটনার চার দিন পর পরিবার থেকে মামলা করা হয় বলে জানান তুরাগ থানার ওসি নুরুল মোক্তাকিম। অন্যদিকে পারভেজের কুলখানির বাজার করতে গিয়ে গত রবিবার সেই ভিক্টর পরিবহনের ধাক্কায় ফের নিহত হয়েছেন তাঁর ছেলের বন্ধু মেহেদী হাসান ছোটন। আর ছেলে ইয়াসির আলভী রব গুরুতর আহত। এবারের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় চালক রফিককে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই সাদেক বলেন, ‘দুজন বাসে উঠতে চেয়েছিল, চালক যাত্রী নেবে না বলে চলে যাচ্ছিল।’

গত ৫ সেপ্টেম্বর মহাখালীতে ক্যান্টনমেন্ট মিনিবাস সার্ভিসের (মিরপুর ১৪ নম্বর) বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপাতের কাছে দাঁড়ানো কর্মজীবী নারী ফারহা নাজকে চাপা দেয়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত বাসচালক শামিম মিয়া এখনো অধরা। মামলা হলেও আড়ালে মালিকপক্ষ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও বনানী থানার এসআই আফজাল হোসেন বলেন, ‘শামিমকে ধরতে অভিযান চলছে।’

গত শনিবার পল্লবীর কালশী সড়কে কালশী উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী লিজা আক্তার (১৪) স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে তাকে চাপা দেয় বেপরোয়া একটি পিকআপ ভ্যান। জনতা পিকআপটি আটক করলেও চালক পালিয়ে যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন লিজার বাবা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দিনের বেলা স্কুল থেকে ফেরার পথে আমার মেয়েটাকে পিকআপ মেরে দিল। এরা কেন সাবধান হয় না! লিজার জ্ঞান ফিরলেও সে কথা বলতে পারছে না।’

 

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/09/10/813154