৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, সোমবার, ১:৩৩

ভোলায় সড়ক ও সেতু নির্মাণ

লেপছেপ দিয়ে শেষ হচ্ছে ২৪ কোটি টাকার কাজ

‘সেতু ভেঙে না পড়া পর্যন্ত তো কাজ খারাপ বলা যাবে না’

ভোলায় সড়ক ও জনপথের ২৪ কোটি টাকার কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নতুন করে দুটি সেতু নির্মাণ, ৩৪টি বাঁক সরলীকরণ মিলে এসব কাজে যেন অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করা হয়েছে। যেনতেনভাবে কাজ শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যে বিল তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হতে চলেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, রাস্তার সাববেইস, কার্পেটিংসহ কাজের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিয়ম মানা হচ্ছে না এবং এখন পর্যন্ত অত্যন্ত নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে।

ভোলা সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ যেন অনিয়মকেই নিয়মে পরিণত করার কারখানায় পরিণত হয়েছে। অন্য একটি কাজে দুর্নীতির অভিযোগের ক্ষেত্রে চলতি বছরেই নির্বাহী প্রকৌশলীর স্থলাভিষিক্ত অবস্থাতেই এখানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সওজের বিভাগীয় তদন্ত হয়েছে।

এলাকাবাসী বলছে, ভোলার ইলিশা থেকে চরফ্যাশন পর্যন্ত বর্তমান কাজটির ঠিকাদার মাহফুজ খানকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে নিম্নমানের উপকরণে কাজ শেষ করে বিল তুলে নিতে সাহায্য করছে সওজ। জানা যায়, ২০১৮ সালের মার্চ মাসে তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘মাহফুজ খান জেভি’ ২৪ কোটি টাকার কাজটির দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করে কাজ শুরু করে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভোলার বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল বাসস্ট্যান্ডের পরে পৌরসভার সীমানায় ও চরফ্যাশনের আগে দুটি পুরনো সেতু ভেঙে নতুন দুটি সেতু নির্মাণ করার কথা। এরই মধ্যে একটির কাজ শেষ হয়েছে এবং ভোলা পৌরসভার সীমানার সেতুটির নির্মাণের কাজ চলছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, নির্মাণাধীন সেতুতে অত্যন্ত নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেকের মতে, পুরনা সেতুর চেয়ে খারাপ হচ্ছে নতুন সেতুর নির্মাণকাজ।

তবে সওজের দায়িত্বরত উপসহকারী প্রকৌশলী মো. সোলায়মান বলেন, ‘আমি জুলাই মাসের শেষে ভোলাতে পদায়ন হয়েছি। আগে কী ধরনের উপকরণ দিয়ে কাজ হয়েছে তা বলতে পারব না, তবে এখন বাকি অংশের কাজে কোনো ধরনের খারাপ উপকরণ ব্যবহার করা হবে না।’ তদারকির দায়িত্বরত আরেক প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম অসুস্থ থাকায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

সওজ সূত্র বলছে, ৩৪টি বাঁক সরলীকরণসহ সব কাজে উপকরণ ভালো মানের ব্যবহার করার কথা। ভালো করে সাববেইস করাসহ আধুনিক পদ্ধতিতে ডাবল বিটুমিনাস কার্পেটিং বা বাইন্ডার কোর্সের নিয়ম অনুযায়ী সরলীকরণ রাস্তার ওপর প্রথমে ৭০ মিলিমিটার কার্পেটিং করার কথা। পরে কাজ শেষ হলে মূল রাস্তার সঙ্গে মিল করে আরো ৫০ মিলিমিটার কার্পেটিং করার নিয়ম। দুই ধাপে কার্পেটিংয়ের এ কাজকে ডাবল বিটুমিনাস কার্পেটিং বা বাইন্ডার কোর্স বলা হয়।

সরেজমিনে আরো দেখা যায়, বাঁক সরলীকরণের যেসব কাজ হয়েছে তা অত্যন্ত নিম্নমানের এবং কোথায়ও ডাবল বিটুমিনাস কার্পেটিংয়ের প্রথম ধাপে ৭০ মিলিমিটার কার্পেটিং খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ৩০ থেকে ৪০ মিলিমিটার কার্পেটিং করেই কাজ সারা হয়েছে। ৭০ মিলিমিটারের জায়গায় কোথাও মাত্র ২০-২৫ মিলিমিটার কার্পেটিং করা হয়েছে বলে মনে করছে এলাকাবাসী। এ যেন পুকুরচুরি।

এ ছাড়া কার্পেটিংয়ের আগে ভালো করে সিলকোট না দেওয়া ও কার্পেটিংয়ে নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করারও অভিযোগ উঠেছে। সাববেইসের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিম্নমানের পাথর ও বালু ব্যবহার করা হয়েছে। তাতে পাথরের পরিমাণ অনেক কম ছিল, বালুর পরিমাণ ছিল বেশি। পুকুর বা খালপারের পাইলিংয়ের কাজও নিম্নমানের হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নিয়ম রয়েছে প্রথমে সাববেইসের ওপর ৭০ মিলিমিটার কার্পেটিং করতে হবে এবং পরে তার ওপর আবার ৫০ মিলিমিটার কার্পেটিং করতে হবে। কিন্তু এই নিয়ম খাতাপত্রেই রয়ে গেছে।

এদিকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বাঁক সরলীকরণের কাজ শেষ করতে গিয়ে রোলার কম দেওয়ায় ও অন্যান্য মিশ্রণের কাজ নিম্নমানের হওয়ায় রাস্তা এক বর্ষাতেই ডেবে যাচ্ছে নানা স্থানে। ভেঙে যাচ্ছে রাস্তার কিনারা। আর এসব অনিয়ম সওজের যোগসাজশেই হচ্ছে বলে সবার ধারণা। তারা বলছে, বিভাগীয় কর্তারা জড়িত না থাকলে এমন নিম্নমানের কাজ হতে পারে না।

এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে ভোলা সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী পঙ্কজ ভৌমিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দেখা মতে কাজ ভালো হচ্ছে। নিম্নমানের কাজ হলে সেতু তো ভেঙে পড়ত। সেতু ভেঙে না পড়া পর্যন্ত তো কাজ খারাপ বলা যাবে না। আর সেতু ভেঙে পড়লে আমারও তো দায়ভার আছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘রাস্তার সরলীকরণে কাজে আমাদের দেখিয়ে দেওয়া পাথর/কণা ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৮৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।’

এ বিষয়ে ‘মাহফুজ খান জেভি’র কর্ণধার মাহফুজ খানের সঙ্গে তাঁর মোবাইল ফোনে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে ভোলায় কর্মরত তাঁর প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী মো. ফেরদাউস আহমেদ দাবি করেন, ‘আমরা সেতুর কাজ খারাপ করছি না। নিয়ম মেনেই কাজ করছি।’ কার্পেটিং ৭০ মিলিমিটারের স্থলে ৩০-৪০ মিলিমিটার করার অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

স্থানীয়দের অভিমত প্রভাবশালী ঠিকাদার মাহফুজ খান বরিশাল ও ভোলা সওজের অফিসকে ম্যানেজ করে মূল্য তালিকা টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে এ কাজ নিয়েছেন। তিনি কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছেন না। এর ফলে ব্যাহত হচ্ছে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও মানুষের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে সরকারের প্রতি ভ্রান্ত ধারণা।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2019/09/09/812579