৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১২:৫৬

অপারেটর-বিটিআরসি দ্বন্দ্বে টেলিকম সেক্টরে অস্থিরতা

১৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি বিনিয়োগকারীদের ; বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য অশনি সঙ্কেত

দেশের শীর্ষ দুই অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবির সাথে সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির দ্বন্দ্বে টেলিকম সেক্টরে চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাবে ইতোমধ্যেই শেয়ারবাজারে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন গ্রামীণফোনের বিনিয়োগকারীরা। পাশাপাশি সময়ের সাথে সাথে গ্রাহকসেবার মান আরো নিম্নœমুখী হচ্ছে। সরকারের অবস্থান পরিবর্তন না হলে এ সেবা আরো তলানিতে নামতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। পুরো পরিস্থিতিকে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য অশনি সঙ্কেত হিসেবে উল্লেখ করে দ্রুত ‘গ্রহণযোগ্য’ সমাধান চেয়েছে অপারেটরেরা।

বিটিআরসির দাবিÑ গ্রামীণফোনের কাছে অডিট আপত্তি দাবির ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং রবির কাছে ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে বিটিআরসি ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরর। বকেয়া আদায়ে গত ২ এপ্রিল অপারেটর দু’টিকে চিঠি দেয় বিটিআরসি। তাগাদা দেয়ার পরও ওই টাকা পরিশোধ না করায় গত ৪ জুলাই গ্রামীণফোনের ব্যান্ডউইথ ক্যাপাসিটি ৩০ শতাংশ এবং রবির ১৫ শতাংশ সীমিত করতে

আইআইজিগুলোকে নির্দেশ দেয় বিটিআরসি। কিন্তু তাতে গ্রাহকের সমস্যা হওয়ায় ১৩ দিনের মাথায় ওই নির্দেশ প্রত্যাহার করে নেয় বিটিআরসি। এরপর ২২ জুলাই গ্রামীণফোন ও রবিকে বিভিন্ন প্রকার সেবার অনুমোদন ও অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দেয়া স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয়। দফায় দফায় চেষ্টা করেও নিরীক্ষা আপত্তির টাকা আদায় করতে না পেরে গ্রামীণফোন ও রবির লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ৩০ দিনের সময়সীমা দিয়ে দুই অপারেটরকে নোটিশ পাঠিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নোটিশের জবাব না দিলে বা পাওনা টাকা পরিশোধ না করলে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে এই দুই অপারেটরে প্রশাসক নিয়োগের মতো পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে বলে বিটিআরসি সূত্র জানিয়েছে।

অন্য দিকে শুরু থেকেই অডিট আপত্তিকে ‘একতরফা ও বিতর্কিত’ হিসেবে উল্লেখ করে আলোচনা বা সালিসি বৈঠকের মাধ্যমে সামাধান চেয়ে আসছে অপারেটর দু’টি। সালিসি বৈঠক চেয়ে একাধিকবার বিটিআরসিতে চিঠি পাঠানো হলেও তাতে সাড়া দেয়নি সংস্থাটি। এ ব্যাপারে একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে উভয় পক্ষই। অবেশেষে কঠোর সিদ্ধান্তের হুমিক দিয়ে এই নোটিশ পাঠানো হলো।

বিটিআরসির এই নোটিশকে অযৌক্তিক উল্লেখ করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় গ্রামীণফোন বলেছে, তাদের গঠনমূলক সমাধানের প্রস্তাবে এটা বিটিআরসির অনীহার বহিঃপ্রকাশ। গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার যেকোনো অন্যায্য পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তারা সব ব্যবস্থাই নেবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়।

লাইসেন্স বাতিলের কারণ দর্শানোর নোটিশ টেলিযোগাযোগ খাতে বিনিয়োগকারীদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং গ্রাহকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে মন্তব্য করে যথাসময়ে নোটিশের জবাব দেয়ার ঘোষণা দেয় দ্বিতীয় শীর্ষ অপারেটর রবি।

বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মোবাইল গ্রাহক ১৬ কোটি ৮২ হাজার। এর মধ্যে ৭ কোটি ৪৭ লাখ গ্রামীণফোনের। আরো ৪ কোটি ৭৬ লাখ গ্রাহক নিয়ে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে রবি। এই হিসাবে মোট গ্রাহকের ৪৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ গ্রামীণফোন এবং ২৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ রবির সেবা নিয়ে থাকেন। কিন্তু দেশের শীর্ষ দুই অপারেটরের সাথে বিটিআরসির চলমান দ্বন্দ্বে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছেন গ্রাহকেরা। একই সাথে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে অপারেটর দু’টি।

জানা গেছে, এনওসি বন্ধ থাকায় বর্তমানে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ বা বিটিএস স্থাপন করতে পারছে না অপারেটর দু’টি। যন্ত্রাংশ আমদানির অনুমতি, নতুন কোনো প্যাকেজ চালু এবং চলতি প্যাকেজে কোনো পরিবর্তনও আনতে পারছে না তারা। এতে এক দিকে কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন গ্রাহকেরা, পাশাপাশি বিপুল আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে অপারেটরদেরও।

একাধিক মোবাইল গ্রাহক অভিযোগ করেন, গত কয়েক মাস ধরে নির্ধারিত টাকা দিয়ে প্যাকেজ বা কলরেট ক্রয় করেও কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না তারা। কলড্রপের সংখ্যা সাম্প্রতিক সময়ের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। একটি নম্বরে কয়েকবার ডায়াল করার পর সংযোগ মিললেও কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার কেটে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের গতিও কমে গেছে অনেক। কাস্টমার সার্ভিসে কল করেও কোনো প্রতিকার মিলছে না।

অপারেটরগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, সরকারের অবস্থান পরিবর্তন না হলে শিগগিরই এ সমস্যা থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা নেই।

এ দিকে সরকার ও অপারেটরের দ্বন্দ্বে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে দেশের শেয়ারবাজারে। বিটিআরসির পাওনা দাবির পর গত চার মাসে শেয়ারবাজার প্রায় ৩৫০ পয়েন্ট সূচক হারিয়েছে। বাংলাদেশে সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের একাধিক বৈঠকের পরও স্বাভাবিক হচ্ছে না শেয়ারবাজার। বিটিআরসির সাথে দ্বন্দ্বে গত পাঁচ মাসে এক-চতুর্থাংশেরও বেশি শেয়ারের দর হারিয়েছে গ্রামীণফোন। এতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন গ্রামীণফোনের বিনিয়োগকারীরা। গত ১ এপ্রিল গ্রামীণফোনের প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ৪১৭ টাকা। বৃহস্পতিবার এই শেয়ার ২৯৫ টাকায় লেনদেন হয়। বড় মূলধনী এই কোম্পানির শেয়ারের দাম কমে যাওয়ায় পুরো পুঁজিবাজারেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ফলে গত পাঁচ মাসে পূঁজিবাজার সূচক আড়াই বছর আগের অবস্থানে নেমে এসেছে।

কোম্পানির তথ্যানুযায়ী, শতভাগ শেয়ারের ৯০ শতাংশই রয়েছে গ্রামীণফোনের উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে। বাকি ১০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানায় রয়েছে সরকার, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেছেন, ‘পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত গ্রামীণফোনের কাছে বকেয়া আদায় নিয়ে টানাপড়েন বাজারের জন্য আতঙ্কের খবর। বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত ছিল : কারণ বড় মূলধনী এই কোম্পানিটির প্রভাবে পুঁজিবাজার প্রভাবিত হবে। আকস্মিক ও বিলম্বিত পাওনা দাবি নিয়ে কোম্পানিটির শেয়ারের দামে পতন হচ্ছে, যা কোম্পানির বিনিয়োগকারী ও পুঁজিবাজারকে ক্ষতির মুখে ফেলেছে।’

এ দিকে সম্প্রতি বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে বিডিং সম্পন্ন করা এডিএন টেলিকম লিমিটেডের প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এডিএন টেলিকম আইপিওর মাধ্যমে সাধারণ শেয়ার ইস্যু করে ৫৭ কোটি টাকার তহবিল উত্তোলন করবে। কিন্তু টেলিকম সেক্টরে চলমান অস্থিরতায় পূঁজিবাজারে কাক্সিক্ষত মূল্য পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

জিপি ও রবির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এনওসি বন্ধ থাকায় ইন্টারনেট, ভয়েস ও ডিজিটাল সেবায় বেশ ভোগান্তিতে পড়েছেন গ্রাহকেরা। কারণ, মোবাইল সেবায় প্রতিদিনই নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। এনওসি বন্ধ করে দেয়ায় নেটওয়ার্ক পরিচালনায় ব্যবহার করা প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার কেনা যাচ্ছে না। এতে নেটওয়ার্ক আপগ্রেডেশন ব্যাহত হবে। ফলে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে গ্রাহক কম ব্যান্ডউইথ পাবেন। স্বাভাবিকভাবেই গতি হবে ধীর। আর থ্রিজি ও ফোরজি সক্ষমতা বাড়ানোর কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সার্বিক ডাটা নেটওয়ার্কের সক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে ইন্টারনেটের গতির কমে যাওয়ার পাশাপাশি কলড্রপও বাড়ছে।
জিপি ও রবি বলছে, নতুন লাইসেন্স প্রাপ্ত তিনটি টাওয়ার কোম্পানির ব্যবসাও এর ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানেও নতুন বিনিয়োগ আটকে গেছে। সারা দেশে বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফোরজি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে লাইসেন্স বাতিলের নোটিশ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে নেতিবাচক বার্তা দিবে।

এ দিকে পারস্পরিক আলোচনা এবং সালিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনসম্মত উপায়ে চলমান সঙ্কট সমাধানে এখনো আশাবাদী অপারেটরগুলো। না হলে আদালতের মাধ্যমে তারা আইনি লড়াই চালিয়ে যাবে।

অডিট পাওনাকে ‘বিতর্কিত’ উল্লেখ করে গ্রামীণফোনের ডাইরেক্টর ও হেড অব রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স হোসেন সাদাত বলেন, ‘এনওসি বন্ধের সিদ্ধান্তে ইতোমধ্যেই টেলিকম সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তার ওপর বিটিআরসির এই অযৌক্তিক নোটিশ গঠনমূলক সমাধানের প্রস্তাবে অনীহার বহিঃপ্রকাশ। গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার যেকোনো অন্যায্য পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সব ব্যবস্থাই নেয়া হবে।

রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, ‘বিতর্কিত নিরীক্ষা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দাবিকৃত অর্থ আদায়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ নোটিশ প্রকৃতপক্ষে সমস্যা সমাধানে সহায়ক নয়। লাইসেন্স বাতিলের কারণ দর্শানোর নোটিশ টেলিযোগাযোগ খাতে বিনিয়োগকারীদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং গ্রাহকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/438169/