ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরঞ্জাম কেনাকাটায় ৪১ কোটি টাকার দুর্নীতি
৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১২:১১

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: সরঞ্জাম কেনাকাটায় ৪১ কোটি টাকার দুর্নীতি

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ (ফমেক) হাসপাতালে আইসিইউর (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) রোগীকে আড়াল করে রাখার এক সেট পর্দার দাম পড়েছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা!

শুধু এ পর্দা নয়, কলেজের বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনাকাটায় প্রায় ৪১ কোটি টাকার দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর সব তথ্য উঠে এসেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তদন্তে। ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এসব সরঞ্জাম কেনাকাটা করা হয়।

এ ব্যাপারে তদন্ত করতে সম্প্রতি দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দরপত্রের মাধ্যমে ২০১২-১৬ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন প্রকল্পে ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স অনিক ট্রেডার্স ফমেক হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও মালামাল সরবরাহ করে।

প্রতিষ্ঠানটি সরবরাহকৃত মালামালের দাম কয়েকগুণ বেশি নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অবিশ্বাস্য দামে ফমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ১৬৬টি চিকিৎসা যন্ত্র ও সরঞ্জাম কিনেছে।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ২০১২-১৬ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন প্রকল্পে হাসপাতালটি ১১ কোটি ৫৩ লাখ ৪৬৫ টাকার মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনাকাটা করে। এতে বিল দেখানো হয়েছে ৫২ কোটি ৬৬ লাখ ৭১ হাজার ২০২ টাকা। এ কেনাকাটাতেই মেসার্স অনিক ট্রেডার্স বাড়তি বিল দেখিয়েছে ৪১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার ৭৩৭ টাকা।

বিষয়টি ওই সময়ের ফমেক কর্তৃপক্ষ কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে কাজ করলেও বিপত্তি বাধে সর্বশেষ ১০ কোটি টাকার একটি বিল নিয়ে। সর্বশেষ ১০ কোটি টাকার বিলটিতে চিকিৎসা সরঞ্জামাদিতে বেশি দাম নেয়া হয়েছে- এ মর্মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিলটি আটকে দেয়।

এরপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স অনিক ট্রেডার্স ওই বিল পেতে হাইকোর্টে একটি রিট করে। এরপর বিষয়টি জানাজানি হলে ফরিদপুরসহ সারা দেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পর্দা ছাড়া আর যেসব সরঞ্জামাদি কেনা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ৩ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা দামের একেকটি স্টেথিস্কোপের জন্য খরচ করেছে ১ লাখ সাড়ে ১২ হাজার টাকা করে।

১০ হাজার টাকার ডিজিটাল ব্লাডপ্রেশার মাপার মেশিন কেনা হয় ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। অব্যবহৃত আইসিইউর জন্য অক্সিজেন জেনারেটিং প্ল্যান্টের দাম ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। খোদ জাপান থেকে আনলেও এটার খরচ পড়বে সর্বোচ্চ ৮০ লাখ টাকা।

বিআইএস মনিটরিং প্ল্যান্ট স্থাপনে ২৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এমন প্ল্যান্ট স্থাপনে সর্বোচ্চ খরচ হয় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। এভাবে প্রায় ১৮৬ গুণ পর্যন্ত বেশি দাম দিয়ে ১৬৬টি যন্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে মেসার্স অনিক ট্রেডার্স। অথচ এ অনিক ট্রেডার্সই দুদকের কালো তালিকাভুক্ত।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইন ডাইরেক্টর (হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো) ডা. সত্যকাম চক্রবর্তী শুক্রবার রাতে টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়টি এখন একটি আইনি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে চলছে। উচ্চ আদালত দুদককে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তাই আইনি প্রক্রিয়ায় যেভাবে পরিচালিত হওয়ার কথা সেভাবেই হবে। এর বাইরে কিছুই বলা সম্ভব নয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১০ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও মালামাল সরবরাহ করে মেসার্স অনিক ট্রেডার্স। ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর ফমেক হাসপাতালের স্টোর অফিসার মো. আ. রাজ্জাক স্বাক্ষর করে ১০ প্রকারের যন্ত্রপাতি ও মালামাল বাবদ ১০ কোটি টাকার সরবরাহ করা মালামাল বুঝে নেন।

সরেজমিন দেখা যায়, দু-একটি যন্ত্রপাতি ছাড়া বেশিরভাগই তালাবদ্ধ ভবনের রুম, স্টোর রুম ও আলমারিতে রয়েছে। এগুলো গত কয়েক বছর অযতœ-অবহেলায় থেকে ধুলাবালি পড়ে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

বৃহস্পতিবার সরেজমিন ফমেক হাসপাতালে দেখা যায়, ইউএসএর তৈরি ভিএসএ অনসাইড অক্সিজেন জেনারেটিং প্ল্যান্টটি আইসোলেশন ওয়ার্ডের পশ্চিম পাশে আলাদা একটি রুমে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এ রুমটি দীর্ঘদিন অব্যবহৃত পড়ে থাকায় তালায় মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।

অবশেষে তালা ভেঙে রুম খোলার ব্যবস্থা করে কর্তৃপক্ষ। সেখানে দেখা যায়, বন্ধ রুমটির দেয়ালে শ্যাওলা পড়ে নোনা ধরে স্যাঁতসেঁতে অবস্থায় পড়ে রয়েছে ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা মূল্যের পুরো প্ল্যান্টটি। প্ল্যান্টটিতে সংযোগ দেয়া রয়েছে বড় আকারের বেশ কয়েকটি অক্সিজেন ভর্তি সিলিন্ডার। এগুলো অযতেœ পড়ে থেকে বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে।

আরও দেখা গেছে, ফমেক হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগে হসপিটাল সারটেইন সিস্টেম ফর আইসিইউ/সিসিইউ ১৬টি বেড পড়ে রয়েছে। এর পাশে ঘেরাও করার জন্য রয়েছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের রোগীকে আড়াল করার এক সেট (১৬ পিস) পর্দা।

এ রুমের দায়িত্বে রয়েছেন সিনিয়র স্টাফ নার্স রিজিয়া আক্তার। তিনি যুগান্তরকে বলেন, প্রতিদিন এ রুমের তালা খুলে বেড ও যন্ত্রপাতি চালু করি এবং ঝেড়েমুছে আবার বিকাল হলে রুম বন্ধ করে চলে যাই। এভাবেই কয়েক মাস ধরে কাজ করছি।

জনবলের অভাবে এখনও আইসিইউ চালু করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের ভ্যাকুয়াম প্ল্যান্টটি পুরনো ভবনের দন্ত বিভাগে স্থাপন করা হয়েছে। রুমটি বেশির ভাগ সময় তালাবদ্ধ অবস্থায় থাকে। মাঝেমধ্যে রুমটি খুলে দেলোয়ার হোসেন নামের একজন ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন। এ প্ল্যান্টটিও পড়ে থেকে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

ডিজিটাল ব্লাডপ্রেশার ৩টি যন্ত্র মেল মেডিসিন, সিসিইউ ও লেবার ওয়ার্ডে অনেকটা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

বিস মনিটরিং সিস্টেমটি কাগজপত্রে অপারেশন থিয়েটারে থাকার কথা থাকলেও সেখানে গিয়ে মেশিনটি দেখা যায়নি। থ্রি হেড কার্ডিয়াক স্টেথিস্কোপ ৪টি মেডিসিন ওয়ার্ড ও সিসিইউ কক্ষে প্যাকেটজাত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ফাইবার অপটিক ল্যারিনোস্কোপ সেট ম্যাকিন্টোস ২টি গাইনি ও মেডিসিন ওয়ার্ডে রয়েছে।

এছাড়া অটোমেটিক স্ক্রাব স্টেশন, স্যাকশন মেশিন ও ডাউন স্টিম ইকুইপমেন্ট অনেকটা চালু অবস্থায় রয়েছে বলে দাবি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

সার্বিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতির বিষয়ে ফমেক হাসপাতালের পরিচালক কামদা প্রসাদ যুগান্তরকে বলেন, আমি মাত্র কয়েক মাস আগে এ হাসপাতালে যোগদান করেছি। আমি এ বিষয়ে তেমন কিছু জানি না। তবে শুনেছি, এ নিয়ে হাইকোর্টে রিট হয়েছে। আদালতের আদেশে দুদক তদন্ত করবে। তদন্তের পর বিষয়টি জানা যাবে।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যন্ত্রপাতিগুলো বুঝে নেয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে এগুলো পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। যেন তাড়াতাড়ি আইসিইউ বিভাগসহ সব যন্ত্রপাতি চালু করা যায়।

এদিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের এক সেট পর্দা ৩৭ লাখ টাকা দিয়ে কেনার খবরের বিষয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ২০ আগস্ট এ বিষয়টি ৬ মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে নির্দেশ দেন আদালত। বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ এ নির্দেশ দেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান যুগান্তরকে বলেন, আমরা জেনেছি। কিন্তু এ বিষয়ে লিখিত কোনো আদেশ শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পাইনি।

এ বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার জানান, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের একটি পর্দা ৩৭ লাখ টাকা দিয়ে কেনার খবরের বিষয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ২০ আগস্ট এ বিষয়টি ৬ মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে নির্দেশ দেন আদালত।

তিনি বলেন, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মূল্যায়ন কমিটিতে সরকারি কর্মকর্তা ও ডাক্তার ছিলেন। দুঃখজনক যে, এভাবে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে, এতে চিকিৎসাসেবার মানের যে বিষয় তা কখনই বাস্তবায়ন হবে না।

এর আগে পাবনায় রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের গ্রিন সিটিতে বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয় ৬ হাজার টাকা। পরে তা গড়ায় আদালতে। এ বিষয়টি নিয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপক সমালোচনা ও ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য উঠেছিল।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/218109/