৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শুক্রবার, ১১:৩০

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি

চার বছরেও শেষ হয়নি তদন্ত

বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় মামলাগুলোর তদন্ত শেষই হচ্ছে না। দীর্ঘ সূত্রতা সঙ্গী হয়ে রয়েছে এই তদন্তে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় চার বছর কেটে গেলেও অজানা কারণে থমকে আছে সেটা। দেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া অন্যতম ব্যাংক কেলেঙ্কারির তদন্ত কবে শেষ হবে তা নিয়েও জেগেছে শঙ্কা। এই ইস্যুতে দুদকের কর্মকর্তারাও অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করছেন। গত চার বছরে ৫৬টি মামলায় একাধিক বাদীও পরিবর্তন করা হয়েছে। তাতেও কোনো ফল মেলেনি।

সূত্র মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর দুই মেয়াদে দুর্নীতির সব আলামত, দলিল, কাগজপত্র দুদকের হাতে আছে।
সে সময়ের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত ও অর্থ আত্মসাতে যোগসাজশ থাকা ব্যাংকের গুলশানসহ কয়েকটি শাখার দুর্নীতি-সংক্রান্ত সব নথিও রয়েছে তদন্ত কর্মকর্তাদের ফাইলে। এরপরও তদন্তের কোনো কূল কিনারা হয়নি। এই তদন্তের পেছনে কোনো অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে কিনা সেটাও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে সংশ্লিষ্টদের কাছে। বর্তমানে দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিম বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি মামলার তদন্ত করছে। দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারির ঘটনায় মামলার তদন্তটি কোন পর্যায়ে রয়েছে সেটা বলা মুশকিল। তবে এটা ঠিক যে দীর্ঘ সময় কেটে গেছে কোনো সুরাহা হয়নি। অবশ্য কমিশনের পক্ষ থেকে তদন্ত শেষ করার ব্যাপারে আন্তরিকতার অভাব নেই বলেও জানান তিনি।

দীর্ঘ সময় কেটে যাওয়া মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান মানবজমিনকে বলেন, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় মামলার অগ্রগতি বেশ এগিয়েছি। সবকিছু ঠিক থাকলে শিগগিরই মামলার চার্জশিট দেয়া হবে।
দুদক ২০১৫ সালের ২১-২৩শে সেপ্টেম্বর বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ৩৬ কোটি ৬৫ লাখ ৯৪ হাজার ৩৪১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৫৬টি মামলা করে। ২০১৭ সালের শেষ দিকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বাচ্চুসহ তৎকালীন পর্ষদ সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে তদন্ত ও আদালতে চার্জশিট পেশের জন্য দুদকের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলেন। তদন্ত শেষ না হওয়ায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের ওই আদেশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। জালিয়াতি করে বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের তদন্ত প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দুদকে পাঠানো হয় ২০১৩ সালে। পরে অভিযোগটি অনুসন্ধান করে ২ হাজার ৩৬ কোটি ৬৫ লাখ ৯৪ হাজার ৩৪১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদক ৫৬টি মামলা করে ২০১৫ সালের ২১-২৩শে সেপ্টেম্বর। ৫৬ মামলায় ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামসহ মোট ১২০ জনকে আসামি করা হয়। বাকি ২ হাজার ৪৬৩ কোটি ৩৪ লাখ ৫ হাজার ৬৫৯ টাকা আত্মসাতের অনুসন্ধান করে আর কোনো মামলা করা হয়নি। ওই সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনার সময় দুই মেয়াদে শেখ আবদুল হাই বাচ্চু চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকলেও তাকে কোনো মামলায় আসামি করা হয়নি। শুধু তাই নয়, ওই সময়কার পর্ষদ সদস্যদের কারও নাম আসামির তালিকায় নেই। ওই ৫৬ মামলার বিপরীতে ২ হাজার ৩৬ কোটি ৬৫ লাখ ৯৪ হাজার ৩৪১ টাকা ঋণ প্রস্তাব ছিল জালিয়াতিপূর্ণ। অ্যাকাউন্ট খোলার আগেই টাকা হাতে পেয়েছেন লুণ্ঠনকারীরা, যা ছিল নজিরবিহীন।

এদিকে গত ২৩শে জুন বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় ১৩ জনকে আসামি করে আরো একটি মামলা করে দুদক। গুলশান থানায় এ মামলা করেন দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক জিন্নাতুল ইসলাম। আসামিরা হলেন- বেসিক ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিজিএম) ইমরুল ইসলাম, ডিজিএম শাকির মাহমুদ শরফুদ্দীন, ডিজিএম (বর্তমানে বরখাস্ত) শাহ আলম ভূঁইয়া, সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক (বর্তমানে বরখাস্ত) আসিফ আহমেদ ও সাবেক অ্যাডভান্সড অফিসার ফারুক আহমেদ ভূঁইয়া। ব্যাংক কর্মকর্তাদের বাইরে আসামিরা হলেন মেসার্স পিসি এভিনির মালিক রোজিনা আহমেদ, রমনার বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন, তোপখানার মোয়াজ্জেম হোসেন, তোপখানার মোতালেব হোসেন ও মোফাজ্জল হোসেন, ভূঁইয়া অ্যাসোসিয়েটসের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এম মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, কনসালট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার মহিউদ্দিন সিকদার ও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক ইনস্ট্রাকটর (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ) খলিলুর রহমান ভূঁইয়া। এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যহার করে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে গুলশান শাখা থেকে ৬ কোটি ৩৭ লাখ ৮৫ হাজার ৩৯ টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করেছেন। বর্তমানে সুদাসলে এই টাকার পরিমাণ ৭ কোটি ৯২ লাখ ৪২ হাজার ৩৯৩ টাকা।

বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন সময়ের পরিচালনা পর্ষদের ১৩ সদস্যের মধ্যে সাবেক চেয়ারম্যান বাচ্চুকে দুদক একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করে। আর বাকি যাদের জিজ্ঞসাবাদ করা হয় তারা হলেন- সাবেক ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদার, সাবেক বাণিজ্য সচিব (সাবেক পর্ষদ সদস্য) শুভাশীষ বোস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক নিলুফার আহমেদ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কামরুন্নাহার আহমেদ, প্রফেসর ড. কাজী আখতার হোসেন, ফখরুল ইসলাম, সাখাওয়াত হোসেন, জাহাঙ্গীর আকন্দ সেলিম, একেএম কামরুল ইসলাম, মো. আনোয়ারুল ইসলাম (এফসিএমএ), আনিস আহমেদ এবং একেএম রেজাউর রহমান।

একটি সূত্র জানায়, ওই সময়কার পর্ষদের অনেকেই বেসিক ব্যাংকের তদন্তে পরোক্ষভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছেন। লুটে নেয়া টাকার বিপরীতে প্রতিটি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছিল ওই সময়ের পর্ষদ। এই দায় তারা এড়াতে পারেন না। চার্জশিটে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেই আদালতে চার্জশিট দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট।

জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে দুদকের কাছে পাঠানো এক আদেশে বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান বাচ্চুসহ ওই সময়কার পর্ষদ সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে তদন্ত সম্পন্ন করে চার্জশিট পেশের কথা বলা হয়েছিল। সর্বোচ্চ আদালতের ওই নির্দেশনাও এখনও পালন করা হয়নি।

এদিকে বেসিক ব্যাংকের এই তদন্ত নিয়েও অনেকটা বিরক্ত দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। গত মে মাসে প্রেসিডেন্টের কাছে দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন হস্তান্তর শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই কথাটা আমি গত দুই বছর ধরে শুনে আসছি। বেসিক ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক। কেন বাংলাদেশে কি আর কোনো ব্যাংক নেই?

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=189098