১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, রবিবার, ১২:৪১

লঞ্চঘাটের নতুন ফি: বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় চলতি বছর কার্যকর নয়

পাইলটেজ, ফেরি টার্মিনালসহ কয়েকটি খাতে নতুন চার্জ ১ অক্টোবর

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নিয়ন্ত্রণাধীন ৯০-৯৫ শতাংশ লঞ্চঘাটে চলতি অর্থবছরে নতুন প্রবেশ ফি আরোপ হচ্ছে না। এসব ঘাটে ইজরাদার থাকায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে- এমন আশঙ্কায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি।

এসব ঘাটে আগামী অর্থবছরের শুরুতে অর্থাৎ ২০২০ সালের পহেলা জুলাই থেকে নতুন ফি কার্যকর হবে। তবে বাকি ঘাটগুলোয় (মামলা বিচারাধীন ছাড়া) পহেলা অক্টোবর থেকে নতুন ফি কার্যকর করা হবে। এসব ঘাটে সংস্থাটির কর্মচারীরা সরাসরি প্রবেশ ফি আদায় করে। এছাড়া পাইলটেজ ফি, ফেরি টার্মিনাল চার্জ, রোড চার্জসহ কয়েকটি খাতে ১ অক্টোবর থেকে নতুন ফি আরোপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে। সূত্র জানায়, এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে সম্প্রতি এক চিঠিতে নৌ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি চেয়েছে বিআইডিব্লিউটিএ। যদিও ১ জুলাই থেকে এসব ফি কার্যকর করতে নির্দেশনা দিয়েছিল মন্ত্রণালয়।

ওই সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, ঢাকা নদীবন্দরের (সদরঘাট) আওতাধীন লেবার হ্যান্ডলিং এবং অন্য ঘাটগুলো ইজারা দেয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। এর সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসূত্র থাকায় ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করছে সংস্থাটি। যদিও এসব ঘাট ইজারা দিতে বিআইডব্লিউটিএকে চিঠি দিয়েছিল নৌ মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ’র সচিব কাজী ওয়াকিল নওয়াজ যুগান্তরকে বলেন, জুলাইয়ের আগেই বিদ্যমান দরে ৯০-৯৫ শতাংশ ঘাট ইজারা দেয়া হয়েছে। ওইসব ঘাটে এখন প্রবেশ ফি বাড়ালে সমস্যা হতে পারে। তাই আমরা আগামী অর্থবছর থেকে নতুন ফি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সদরঘাটের আওতাধীন ঘাটগুলোর ইজারা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব ঘাট ইজারা দেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। দেরিতে হলেও তা বাস্তবায়ন করা হবে। এদিকে নৌপথ ব্যবহারে বিভিন্ন খাত-উপখাতে ফি বাড়ানোর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন লঞ্চ মালিকদের সংগঠন বালাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যা-প) সংস্থা।

সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বদিউজ্জামান বাদল যুগান্তরকে বলেন, আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছি এভাবে বিভিন্ন চার্জ বাড়িয়ে জনগণের কষ্ট দিয়ে উন্নয়ন করার দরকার নেই। প্রায় সব খাত-উপখাতের চার্জ দ্বিগুণ করা হচ্ছে। এসব টাকা যাবে যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের পকেট থেকে। এতে মানুষ নৌপথ ব্যবহারে বিমুখ হবে। স্বল্প দূরত্বের রুটগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ঘাটগুলোয় এমনিতে ইজারাদারদের অনাচার চলে। সেগুলো বন্ধ করতে হবে।
জানা গেছে, সম্প্রতি বিআইডব্লিউটিএ’র নতুন শুল্কহার অনুমোদন করে তা গত পহেলা জুলাই থেকে বাস্তবায়ন করতে নির্দেশনা দেয় নৌ মন্ত্রণালয়। এতে ঘাট ব্যবহারে অর্ধশতাধিক উপখাতে ১১ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ফি বাড়ানো হয়েছে। নতুন শুল্কহারে ঢাকা, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুরসহ কয়েকটি ঘাটের প্রবেশ ফি ৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা করা হয়। ২৫টির বেশি উপখাতে নতুন করে শুল্ক আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে। ফেরি পারাপারে প্রতিটি বাস ও ট্রাক ঘাটচার্জ ৬০ টাকা দিলেও এখন তা বাড়িয়ে ৭৫ টাকা হবে। আগে কার ও জিপের প্রবেশ ফি ছিল না। এখন এসব যানবাহনকে প্রতিবার প্রবেশের জন্য ৩৫ টাকা গুনতে হবে। এ ছাড়াও বিভিন্ন খাত-উপখাতে ফি বাড়ানো হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংস্থাটির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, চলতি অর্থবছরে সংস্থাটির ৯৫ শতাংশ ঘাট ইজারা দেয়া হয়েছে। নতুন ফি কার্যকর করা হলে যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের থেকে আদায় করা বাড়তি টাকা ইজারাদারদের পকেটে চলে যাবে। ওই টাকা সংস্থাটির রাজস্ব খাতে জমা হবে না। এ নিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টিসহ আইনি জটিলতা দেখা দেবে। এসব বিষয় জানিয়েই নৌ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন নদীবন্দরের ইজারাযোগ্য ঘাট-পয়েন্টগুলোর ২০১৯-২০ অর্থবছরের ইজারা কার্যক্রম শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ শেষ হয়েছে। এরূপ পরিস্থিতিতে নতুন বর্ধিত শুল্কহার কার্যকর হলে ইজাদারদের কাছ থেকে বর্ধিতমূল্য আদায় করা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ মামলা-মোকদ্দমার উদ্ভব হতে পারে এবং ভবিষ্যতে নিরীক্ষা আপত্তি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ এ সংক্রান্ত বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র সিদ্ধান্ত জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের ইজারা কার্যক্রম ইতিমধ্যে সম্পন্ন হওয়ায় জটিলতা পরিহারের লক্ষ্যে শুল্কহার চলতি বছরের পহেলা জুলাইয়ে কার্যকর না করে আগামী অর্থবছরের পহেলা জুলাই কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেয়া হল। তবে নবসৃষ্ট বা নতুন ইজারা দেয়া ঘাটের ক্ষেত্রে নতুন শুল্কহার ইজারার দিন থেকে কার্যকর হবে।

অন্যান্য ফি কার্যকর পহেলা অক্টোবর থেকে : বিআইডব্লিউটিএ’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রবেশ ফি বাদে নৌপথ ও সংস্থাটির ভূমি ও স্থাপনা ব্যবহার সংক্রান্ত অন্যান্য ক্ষেত্রে নতুন শুল্কহার পহেলা অক্টোবর থেকে কার্যকর করা হবে। এ বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, পাইলটেজ কুপন বই, টার্মিনাল টিকিট বই, ফেরি টার্মিনাল চার্জ বই, বিভিন্ন ধরনের রসিদ, রোড চার্জ বই ও ওয়েসাইড লঞ্চঘাট টিকিট বই ছাপার কাজ সময়সাপেক্ষ। তাই এসব চার্জ পহেলা অক্টোবর থেকে কার্যকর হবে।

নতুন শুল্কহার অনুযায়ী, কনজারভেন্সি চার্জ ১১-১৬ শতাংশ, পাইলটেজ ফি ২৫ শতাংশ, ফেরি টার্মিনালে যানবাহন প্রবেশ ফি ২০-৩৩ শতাংশ বাড়বে। সব যাত্রীবাহী লঞ্চকে যাত্রীপ্রতি বছরে ১০০ টাকার স্থলে ১১৫ টাকা, স্পিডবোট ৪১৪ টাকার স্থলে ৫০০ টাকা এবং সব পণ্যবাহী নৌযানকে টনপ্রতি ৪৫ টাকার স্থলে ৫০ টাকা হারে ফি দিতে হবে। এছাড়া জাহজের মুরিংয়ের জন্য ফি আরোপ করা হয়েছে। আগে এ খাতে ফি দিতে হতো না। একইভাবে অন্যান্য খাত-উপখাতে বাড়তি ফি দিতে হবে।

ইজারা দেয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব : জানা গেছে, ঢাকা নদীবন্দরের (সদরঘাট) আওতাধীন তিনটি লেবার হ্যান্ডলিং পয়েন্ট, ৩টি ফেরিঘাট এবং পার্কিং ইয়ার্ড ইজারা দিতে বিআইডব্লিউটিএ’কে চিঠি দিয়েছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এতে গত জুলাইয়ে এসব ঘাটের সঙ্গে আরও কয়েকটি ঘাটকে ইজারা দিতে বলা হয়। ওই নির্দেশনার আলোকে কয়েকটি ঘাটের ইজারা টেন্ডার আহ্বান করা হলেও সদরঘাটের বিষয়ে ‘ধীরে চলো নীতিতে’ রয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নৌ মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ’র কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক ইজারাদার নিয়োগ ও যাত্রীদের হয়রানি বিবেচনায় এ ঘাটগুলো ইজারা দেয়া নিয়ে তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন। মূলত এ ঘাটটি কেরানীগঞ্জ এবং কোতোয়ালি ও সূত্রাপুরের ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা নিয়ন্ত্রণ করেন। যদিও কাগজেকলমে বলা হচ্ছে- ২০১৬ সাল থেকে বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘাটটি পরিচালনা করছে। এসব ঘাট ইজারা দেয়া হলে নতুন ইজারাদারের নিয়ন্ত্রণে যাবে। এ নিয়ে বিশৃঙ্খলা হতে পারে। একই কারণে চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ইজারা দিতে টেন্ডার আহ্বান করা হলেও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তা স্থগিত করা হয়। এখন পর্যন্ত ওই অবস্থায়ই আছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/215744/