বনানীর কড়াইল বস্তি। ছবি: সংগৃহীত
৩১ আগস্ট ২০১৯, শনিবার, ২:১৮

সরেজমিন কড়াইল বস্তি: প্রতি মাসে ১৯ কোটি টাকার বাণিজ্য

ভাঙারি দোকানদার, হোটেল বয়, রিকশাচালক, বাসের হেলপার, নৌকার মাঝি থেকে তারা এখন নিয়ন্ত্রক

বনানীর কড়াইল বস্তিতে প্রতি মাসে প্রায় ১৯ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয়। সরকারি জমিতে গড়ে ওঠা বস্তির ঘরভাড়া এবং অবৈধ সংযোগের গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের বিলের নামে এ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তথাকথিত মালিক ও সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট। এরাই বস্তির সামগ্রিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেন।

তাদের অনেকেই এখন কোটিপতি। যারা এক সময় ছিলেন ভাঙারি ব্যবসায়ী, রিকশাচালক, বাসের হেলপার, হোটেল বয় ও নৌকার মাঝি। কিন্তু এসব অপকর্মের ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্টরা একরকম নির্বিকার।

রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে গত সোম ও মঙ্গলবার সরেজমিন ঘুরে এবং বস্তিবাসীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য। বস্তিবাসীর অভিযোগ, গরিবের রক্ত চুষে তারা (নিয়ন্ত্রক) কোটিপতি হয়েছেন।

এখন তারা ‘বস্তির রাজা’। ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গসংগঠনের নাম ভাঙিয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠছেন এই রাজারা। শুধু তাই নয়, তাদের তত্ত্বাবধানে রাতভর বস্তিতে চলে মাদক ও জুয়ার আসরও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৫৬ সালে তৎকালীন টিএন্ডটির নামে ১৭০ একর জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। এর মধ্যে এখন ১৬০ একর জমিতেই গড়ে উঠেছে কড়াইল বস্তি। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এ বস্তি প্রসার লাভ করে।

১৯৮৮ সালের বন্যার পর দেশের নদী ভাঙনপ্রবণ বিভিন্ন এলাকার মানুষ এ বস্তিতে আশ্রয় নিলে এটি বিশাল আকার ধারণ করে। এ বস্তিতে প্রায় ৮০ হাজার ঘর রয়েছে। এখানে বসবাসকারী ৭৫ হাজার পরিবারে প্রায় চার লাখ লোক বসবাস করেন।

বস্তির রাজারা শুধু গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পানির অবৈধ বিলের নাম করে বস্তিবাসীর কাছ থেকে মাসে ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। আর ঘরভাড়া বাবদ আদায় করা হয় প্রায় ১১ কোটি টাকা।

অভিযোগ রয়েছে- এ টাকার ভাগ বিদ্যুৎ বিভাগ, তিতাস গ্যাস, ওয়াসা এবং পুলিশসহ নানা সংস্থার কাছে চলে যায়। এ কারণেই স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় বসে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করলেও দেখার কেউ নেই।

এমনকি কড়াইল বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গত ৮ বছরে তিনটি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

পুলিশের গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, পানি, বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের অবৈধ লাইন থাকলে সেটা দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা রয়েছে। তবে এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হলে সেটা পুলিশ দেখে। এ ধরনের ঘটনার বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, কড়াইল বস্তিতে পানির অবৈধ সংযোগের বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ডেসকোর গুলশান অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন মিয়া যুগান্তরকে বলেন, বস্তিতে মিটার দিয়ে বৈধভাবে বিদ্যুতের লাইন দেয়া হয়েছে। সেখানে অবৈধভাবে কেউ যেন লাইন টানতে না পারে সেটি দেখার জন্য ভিজিল্যান্স টিম আছে। তারপরও বস্তিতে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ নেন বস্তিবাসী।

এ ধরনের লাইন পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে দেই।

গ্যাসের অবৈধ সংযোগ বিষয়ে তিতাসের পরিচালক (অপারেশন) কামরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। এটা মার্কেটিং বিভাগ বলতে পারবে।

কড়াইলের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন সিন্ডিকেটের কাছে তারা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। কড়াইল বস্তির একজন যুবলীগ নেতা যুগান্তরকে বলেন, একজন স্থানীয় শ্রমিক লীগ নেতা কড়াইলের বেলতলা অংশের মূল নিয়ন্ত্রক। ছয় বছর আগেও তিনি ভাঙারি ব্যবসা করতেন।

এখন তিনি কোটি টাকার মালিক।

কড়াইল বেলতলা বস্তির বাসিন্দা মো. আরিফ যুগান্তরকে বলেন, এক মাসে প্রতিটি লাইটের জন্য ১০০ টাকা, ফ্যানের জন্য ১০০ টাকা, টেলিভিশনের জন্য ২০০ টাকা, ফ্রিজের জন্য ৩০০ টাকা দিতে হয়। গ্যাসের প্রতিটি চুলার জন্য ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা দিতে হয়।

আর পানির লাইন ব্যবহার করতে প্রতিটি পরিবারকে ৫০০ টাকা গুনতে হয়। বস্তির জামাইবাজার, বউবাজার, মোশারবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে একই ধরনের তথ্য জানা গেছে।

বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পানির জন্য একটি পরিবারকে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা গুনতে হয়। এ হিসাবে ৮০ হাজার পরিবারের কাছ থেকে প্রায় ৪ কোটি টাকা আদায় করে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

একটি গ্যাসের চুলার জন্য বস্তিবাসীকে গুনতে হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। সাধারণত একটি চুলা তিনটি পরিবার ব্যবহার করে থাকে। এ খাত থেকে সিন্ডিকেট হাতিয়ে নেয় প্রায় এক কোটি টাকা।

আর বিদ্যুতের পেছনে প্রতিটি পরিবারকে গড়ে ৪০০ টাকা করে গুনতে হয়। এ খাত থেকে সিন্ডিকেট আদায় করে প্রায় ৩ কোটি টাকা। আর ঘরভাড়া বাবদ প্রতিটি ঘর থেকে দেড় হাজার টাকা করে আদায় করা হয়।

এ খাত থেকে ঘরের মালিক এবং প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের আয় প্রায় ১১ কোটি টাকা।

কড়াইলের জামাইবাজার এলাকার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমানের বাড়ি ছিল কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নে। ১০ বছর আগে নদীভাঙনে ভিটেবাড়ি হারিয়ে কড়াইল বস্তিতে আশ্রয় নেন।

তিনি বলেন, এই বস্তি গড়ে উঠেছে সরকারি জায়গায়। অথচ প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা ঘরভাড়া দিতে হয়। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিল দিতে হয় এক হাজার টাকার বেশি।

এগুলো নেন প্রভাবশালীরা। আর সবই অবৈধ লাইন। সরকার মিটার লাগিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে বৈধ লাইন আসার কথা। কিন্তু আমাদের ব্যবহার করতে হয় অবৈধ লাইন।

কুমিল্লাপট্টির বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অবৈধ গ্যাস, পানি আর বিদ্যুতের বিল তুলতে সন্ত্রাসী বাহিনী আছে। এ সন্ত্রাসী বাহিনী সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে।

এই প্রভাবশালীরাই ছোট-বড় বিরোধের মীমাংসার দায়িত্ব পালন করেন। যে পক্ষ তাদের বেশি অর্থ দেবে রায় তার পক্ষে যাবে। কোনো ঘটনায় থানা পুলিশের সহায়তা নিতে হলেও প্রভাবশালীদের সমর্থন থাকতে হবে।

মোশারবাজার এলাকার বাসিন্দা মো. আমিনুল বলেন, কড়াইল বস্তির সবচেয়ে বড় সমস্যা মাদক। প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় অবাধেই চলে মাদক কেনাবেচা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/215368/