৩০ আগস্ট ২০১৯, শুক্রবার, ৪:১৭

এমসিকিউ তুলে দেয়ার পক্ষে অনেক শিক্ষক অভিভাবক

বর্তমানে এইচসএসসি পর্যন্ত ৩০ নম্বরের এমসিকিউ চালু রয়েছে। এই এমসিকিউ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে বিতর্ক চলে আসছে। বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় এমসিকিউ প্রশ্নমান কমানো হয়েছে। কিন্তু অনেক শিক্ষকের দাবি এমসিকিউ প্রশ্ন কমিয়েও তেমন লাভ হয়নি। এটি পুরোপুরি তুলে দেয়া দরকার।

গত বছর ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এসএসসি ও সমমানের সব বিষয়েরই বহু নির্বাচনী বা এমসিকিউ প্রশ্ন পরীক্ষা শুরুর আগেই ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে গত বছর ২০ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রেস কনফারেন্সে প্রশ্নফাঁস বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, টিক মারাটা বন্ধ করে দেবো। ওখানেই সুবিধা বেশি। ওটা বন্ধ করে দেবো। এর আগে গত বছর ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে তৎকালীন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী বলেন, এমসিকিউ প্রশ্ন পর্যায়ক্রমে তুলে দেয়া হবে। তাহলে প্রশ্নফাঁসের সুযোগ থাকবে না।

গত বছর অনুষ্ঠিত প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় বহুনির্বাচনী প্রশ্ন বন্ধ করা হয়। কিন্তু যে এসএসসি পরীক্ষায় এমসিকিউ ঘিরে টানা প্রশ্নফাঁসের রেকর্ড সৃষ্টি হয়, সেই এসএসসি বা অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষায় এমসিকিউ বাতিল বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় হতাশ অনেকে। ২০১৬ সালে ৪০ নম্বরের এমসিকিউ ছিল। ২০১৭ সালে থেকে ৩০ নম্বরে কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু এরপর আর কমানো হয়নি।

১৯৯২ সালে যখন এসএসসিতে এমসিকিউ পদ্ধতি চালু হয় তখন এটি ৫০ নম্বরের ছিল। এরপর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় এমসিকিউ পদ্ধতি চালু হয়।

চালু হওয়ার পর থেকেই বিতর্ক পিছু ছাড়েনি এমসিকিউ পদ্ধতির। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যে কয়টি বড় ধরনের পদক্ষেপ ও পরিবর্তন হয় তার মধ্যে অন্যতম ছিল ১৯৯২ সালে এমসিকিউ পদ্ধতি চালু। অনেকের মতে, দেশের শিক্ষার মানে বড় ধরনের ধস নামে এ পদ্ধতি চালুর ফলে। আর কয়েক বছর ধরে শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব নৈরাজ্য চলছে তাতে এমসিকিউ পদ্ধতি একটি যাচ্ছে তাই পদ্ধতিতে পরিণত হয়। একসময় দেশে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়া নকল প্রথা বন্ধ করা গেলেও এমসিকিউর হাত ধরে পরীক্ষার হলে আবার একপর্যায়ে ফিরে আসে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। শুধু এমসিকিউর কারনে নয়, শিক্ষা ক্ষেত্রে অন্যান্য অনেক নৈরাজ্যের কারণে এমসিকিউ ঘিরে নতুন নৈরাজ্য মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রশ্নফাঁস না হলেও এমসিকিউ নিয়ে কারো তেমন কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না গত কয়েক বছর। কারণ পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীরা যেমন দেখাদেখির অবাধ সুযোগ পায়, তেমনি অনেক শিক্ষক কর্তৃকও উত্তর বলে দেয়ার ঘটনা ঘটে। এমনকি বিভিন্ন পরীক্ষার হলে পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্নের বান্ডিল খুলে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করার নজিরও স্থাপিত হয়। এমসিকিউ ঘিরে অসদুপায় অবলম্বনের ফলে ভালোমন্দ প্রায় শিক্ষার্থী ভালো ফল অর্জনে সক্ষম হয়। ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় মেধাবীরা।

অনেক শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এমসিকিউর কারণে পরীক্ষার হলে অসদুপায় অবলম্বন প্রতিরোধ যেমন কঠিন হয়ে পড়ে, তেমনি শিক্ষার ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তন ঘটে। অনেকের মতে, এমসিকিউর কারণে শিক্ষার মানে প্রচণ্ড ধস নামে।

এমসিকিউ চালুর পর লিখিত পরীক্ষায় নম্বর রাখা হয় ৫০। দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় চলমান ধারা পরিবর্তন করে লিখিত পরীক্ষা থেকে ৫০ নম্বর কমিয়ে দেয়ায় গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় একটি আমূল পরিবর্তন আনা হয়। অনেকের মতে, এমসিকিউ পদ্ধতি চালুর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষার্থীরা। কমে যায় শিক্ষার মান। কারণ লিখন পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব কমে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের মানের অবনতি ঘটে।

১৯৯২ সালে এমসিকিউ চালুর সময় প্রতিটি বিষয়ে ৫০০ প্রশ্ন ব্যাংক নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা বই না পড়েও গাইড থেকে ৫০০ প্রশ্ন মুখস্থ করেই ৫০ নম্বর নিশ্চিত করতে পারত। এ নিয়ে সমালোচনার কারণে পরবর্তীতে নির্দিষ্ট ৫০০ প্রশ্ন বাদ দেয়া হয়। কিন্তু যে কারণে অর্থাৎ পুরো বই যাতে শিক্ষার্থীরা ভালো করে অধ্যয়ন করে সে জন্য এ পদ্ধতি চালু করা হলেও সেটি তেমন কাজে আসেনি। শিক্ষাবিদদের মতে, প্রশ্ন প্রণয়নের ধরন, প্রয়োগে ত্রুটির কারণে এ পদ্ধতিটি মার খেয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক শাহ শামীম আহমেদ বলেন, এমসিকিউ পদ্ধতিকে ভালোভাবে ব্যবহার এবং এ থেকে সুফল পেতে দরকার ছিল সঠিক পদ্ধতিতে প্রশ্ন তৈরি করা। এমসিকিউ প্রশ্ন এমনভাবে করা দরকার ছিল, যাতে শিক্ষার্থীর বৃত্ত ভরাট বা টিক চিহ্ন দেয়ার চেয়ে চিন্তা করতে অধিক সময় ব্যয় করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে এমনভাবে প্রশ্ন করা হয় যেখানে একজন শিক্ষার্থী কিছু প্রশ্নের প্রথম শব্দ দেখেই বুঝে ফেলে এর উত্তর কী হবে। ফলে এমসিকিউ পরীক্ষার জন্য যে সময় বরাদ্দ থাকে তার অনেক আগেই পরীক্ষা শেষ হয়ে যায় অনেকের। এ থেকে বোঝা যায় মুখস্থ প্রবণতাই এখানেও প্রাধান্য পাচ্ছে। দুর্বল প্রশ্ন প্রণয়নের কারণে এটি হচ্ছে।

কেরানীগঞ্জে অবস্থিত নুরুল আলম স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল দেওয়ান বাকিউল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, এমসিকিউ প্রশ্ন কমিয়ে তেমন লাভ হয়নি। এ পদ্ধতি পুরোপুরি তুলে দেয়া দরকার।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/436201/