২৯ আগস্ট ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৩:৪৫

পর্যবেক্ষণে এসে ফেনীর জেলা প্রশাসক

ছাগলনাইয়া সীমান্তহাটে একতরফা বাণিজ্য সুবিধা নিচ্ছে ভারত

নানা অনিয়ম অব্যবস্থাপনার মধ্যে ছাগলনাইয়া সীমান্তহাট থেকে একতরফা সুবিধা লুটে নিচ্ছে ভারত। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পণ্য অবাধে বিক্রি হওয়ার সুযোগে ক্রেতা সেজে অবৈধ ব্যবসায়ীরা অবাধে শুল্কমুক্ত ভারতীয় পণ্য দেশে ঢোকানোর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার।
গত মঙ্গলবার সকালে ছাগলনাইয়া সীমান্তহাটের ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণে এসে সীমান্তহাটে বিরাজমান নানা অনিয়ম ও বাংলাদেশীদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কথা বলেছেন ফেনী জেলা প্রশাসক মো: ওয়াহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষের সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণের জন্য দু’দেশের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সীমান্ত বাজার চালু করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে দুই দেশের নাগরিকদের সীমান্ত বাজারের নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না। নিয়ম রয়েছে বাজারের পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বের লোকজন ক্রেতা-বিক্রেতা হিসেবে বাজারে ব্যবসা পরিচালনা করবে। কিন্তু দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এসে ভারতীয় মালামাল ক্রয় করে নিয়ে যায়। আর এদিকে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন তাদের মালামাল সেই হারে ভারতীয়রা নিচ্ছে না। এ জন্য তারা লোকসান গুনছে।

তিনি আরো বলেন, উভয় দেশের নাগরিকদের সীমান্ত বাজারের নীতিমালা অনুসরণ করে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে এবং তিনি সবাইকে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলারও অনুরোধ জানান। বাংলাদেশের ফেনীর ছাগলনাইয়ার মধুগ্রাম সীমান্তে এবং ভারতের ত্রিপুরার শ্রীনগর সীমান্তে বর্ডারহাট পর্যবেক্ষণ শেষে সীমান্ত হাটের সার্বিক দিক সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, এ সীমান্ত হাটে বাংলাদেশী ক্রেতাদের ভারতীয় বিক্রেতাদের কাছ থেকে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক পণ্য ক্রয় করছে। অন্য দিকে ভারতীয় ক্রেতারা প্রয়োজনের চেয়েও কম পণ্য ক্রয় করতে দেখলাম। জেলা প্রশাসক বলেন, প্রয়োজনের চেয়ে আমরা যারা অধিক পণ্য ক্রয় করছি তাদের মাঝে দেশপ্রেমের ঘাটতি আছে। জেলা প্রশাসকের স্বাক্ষরিত বাংলাদেশী ক্রেতাদের প্রদেয় আইডি কার্ডটি দেখালেও হাটে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, কিছু লোক আমার স্বাক্ষর নকল করে এমন আইডি কার্ড তৈরি করেছে বিধায় তাদের হাটে প্রবেশে অনুমতি দিচ্ছে না। আবার অনেকের আইডি কার্ডের মেয়াদ শেষ তাই প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তবে মেয়াদ থাকা আসল আইডি কার্ড থাকলে অবশ্যই তাদের হাটে প্রবেশে অনুমতি দেয়া হবে।

এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিজিবি ফেনী ব্যাটালিয়ন-৪ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল নাহিদুজ্জামান, ফেনীর পুলিশ সুপার খোন্দকার নূরুন্নবী, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) পি কে এনামুল করিম, সহকারী পুলিশ সুপার ছাগলনাইয়া সার্কেল নিশান চাকমা, ছাগলনাইয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ হোসেন পাটোয়ারী, ছাগলনাইয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) সুদীপ রায় ও স্থানীয় রাধানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল হক মাহবুব।

প্রসঙ্গত ছাগলনাইয়ার মোকামিয়া সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে চালু হওয়া বর্ডারহাট ঘিরে একশ্রেণীর চোরা কারবারি ও অসাধু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে শুরু থেকেই। পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় বসবাসকারী দু’ দেশের নাগরিকরা শুধু তাদের নির্দিষ্ট কিছু স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বর্ডারহাটে বেচাকেনার সুযোগ থাকার কথা থাকলেও ভারতীয় ব্যবসায়ীরা শুরু থেকে অসংখ্য নিষিদ্ধ ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পণ্যসামগ্রী সীমান্তেহাটে অবাধে বিক্রি করে আসছে। এ নিয়ে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশীরা। মূল্য তালিকা না থাকায় অতিরিক্ত দাম হাঁকিয়ে নেয়ারও অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বিক্রির অভিযোগ করলেও ক্রেতাদের প্রতিকার না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তারপরও প্রতিদিনই দেশের দূর-দূরান্তের জেলা-উপজেলা থেকে মানুষের সমাগম বাড়ছে সীমান্তহাটে। সীমান্ত বাজার থেকে দু’ দেশের পাঁচ কিলোমিটার এলাকার বাসিন্দারা তাদের স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শাকসবজি, বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী, কোমল পানীয়, বাঁশ বেত, গামছা, লুঙ্গিজাতীয় পণ্য, কৃষি উৎপাদন সামগ্রীর মধ্যে দা,লাঙ্গল, কুড়াল, শাবল ইত্যাদি এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিক গার্মেন্ট সামগ্রী, মেলামাইনসহ নির্দিষ্ট কিছু পণ্য বেচাকেনার কথা বলা হয়েছিল। বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা মাছ, শুঁটকি, মুড়ি-চানাচুর, বিস্কুটসহ অল্প সংখ্যক কিছু হাতেগোনা কয়েকটি পণ্য বিক্রি করছেন।

জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর ভারতের ত্রিপুরার শ্রীনগরের কৃঞ্চনগর পঞ্চায়েত ভবনে দু’ দেশের মধ্যে বৈঠকের পর মোকামিয়া সীমান্তহাটের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠকের পর ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি ফেনীর ছাগলনাইয়ার মোকামিয়ায় ও ভারতের ত্রিপুরার শ্রীনগর সীমান্ত এলাকায় জিরো পয়েন্ট থেকে দু’ দেশের জায়গায় স্থাপিত বর্ডারহাটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের ও ভারতের তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী। সীমান্তহাট চালুর মাধ্যমে কাঁটাতারে বাধায় বিচ্ছেদে পড়া সীমান্তবর্তী দু’ দেশের নাগরিকদের মিলন মেলায় সীমান্তহাট দারুণ ভূমিকা রাখবে বলে আশায় বুক বেঁধেছিলেন সীমান্তবাসীরা। দু’ দেশের কয়েক যুগের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নাড়ীর টানে সীমান্তবর্তী মানুষকে কাছাকাছি এনে দিয়েছে সীমান্তহাট। কিন্তু শুরু থেকে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা দু’ দেশের মধ্যে পণ্য বিক্রির শর্ত না মানা, ভারতীয় কাস্টমসের বাধার কারণে ভারতীয় ক্রেতারা চাহিদা মতো বাংলাদেশী পণ্য না কেনায় বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগে সীমান্তহাট বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের ধর্মঘটে অচল হয়ে কয়েক হাটবার বাজার বসেনি। অচলতা নিরসনে দু’ দেশের মধ্যে বৈঠকে বাধা অপসারণের কথা বলা হলেও কার্যত ভারতীয়রা চাহিদামতো পণ্য না কেনায় বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা এখনো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে সীমান্তহাটে ভারত কোটি কোটি টাকার পণ্য বিক্রির মাধ্যমে একতরফা বাণিজ্য সুবিধা নিচ্ছে বলে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের অভিযোগ।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/435947/