২৯ আগস্ট ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৩:৪০

মেগা প্রকল্প নিয়ে জাবিতে যা হচ্ছে

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ পাওয়ার পর থেকেই নানা অস্বচ্ছতার অভিযোগ করে আসছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অপরিকল্পিত মাস্টারপ্ল্যান, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, ছাত্রলীগের টেন্ডার ছিনতাইসহ নানা-অনিয়ম নিয়ে চলছে লাগাতার আন্দোলন। সর্বশেষ প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও অপরিকল্পিতভাবে গাছকাটা, ছাত্রলীগকে দুই কোটি টাকা প্রদান ও সাংবাদিক লাঞ্ছনার ঘটনায় ক্যাম্পাস অশান্ত হয়ে ওঠেছে। বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশে।

গত বছর ২৩শে অক্টোবর একনেকে অনুমোদন পায় জাবির অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প। এ মেগা প্রকল্পের প্রথম ধাপে ছেলেদের তিনটি ও মেয়েদের তিনটি হলের নির্মাণ কাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ১লা মে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের প্রথম ১৫ দিন ব্যাংকে কোন সিডিউলই পাওয়া যায়নি।
সিডিউল ক্রয়ে ভঙ্গ করা হয় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন। এছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ই-টেন্ডার আহ্বানের দাবি জানালেও অদৃশ্য কারণে সনাতন পদ্ধতিতেই টেন্ডার আহ্বান করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এদিকে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে দরপত্রের সিডিউল ছিনতাইয়ের অভিযোগ তোলে বনানীর ইউনাইটেড কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ২৩শে মে সিডিউল ক্রয় করে ফেরার পথে ছাত্রলীগ পরিচয় দিয়ে ২০-৩০ জন্য যুবক তাদের কাছ থেকে দরপত্র সিডিউল ছিনতাই করে। ভিসি বরাবর লিখিত অভিযোগ দিলেও এ ব্যাপারে কোন তদন্ত কমিটি গঠন করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষে গত ৩০শে জুন ছেলেদের তিনটি ও মেয়েদের দু’টি হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। উদ্বোধনের পর অপরিকল্পিতভাবে হল নির্মাণের প্রতিবাদে ৮ই জুলাই থেকে আন্দোলনে নামে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ঐক্যমঞ্চ।

আন্দোলনের প্রেক্ষিতে উন্নয়ন প্রকল্পের মহাপরিকল্পনা জনসম্মুখে আনার আশ্বাস দেন ভিসি। এর প্রেক্ষিতে গত ১৭ই জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে উন্মুক্ত আলোচনা সভা আহ্বান করা হয়।

এতে মহাপরিকল্পনার একটি এনিমেশন ভিডিও প্রদর্শন করলে তার নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে আপত্তি জানান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। পরিকল্পনাটি পূনর্বিন্যাস না হওয়া পর্যন্ত উন্নয়ন কাজ বন্ধ রাখারও অনুরোধ করেন তারা। সভায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বক্তব্য চলাকালে উত্তেজনা ও উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় শুরু হলে অপ্রত্যাশিতভাবে আলোচনা শেষ করেন ভিসি ফারজানা ইসলাম।

অন্যদিকে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুরোধকে উপেক্ষা করে মেয়েদের হলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের টারজান পয়েন্টের পাশে নির্ধারিত স্থানে গাছ কাটা শুরু হয়। এর প্রেক্ষিতে ১লা আগস্ট ভিসির সঙ্গে দেখা করতে যায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ঐক্যমঞ্চ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পরিকল্পনা পর্যালোচনা ছাড়া কাজ শুরু না করার অনুরোধ জানান। সে সময় ক্যাম্পাস বন্ধের মধ্যে গাছ না কাটার আশ্বাস দেয়া হলেও ৩রা আগস্ট একই স্থানে ফের গাছ কাটা শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

আবারও শুরু হয় আন্দোলন। আন্দোলনের মুখে ২১শে জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প কার্যক্রম নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে প্রশাসন। ১৪ সদস্যের এই কমিটির প্রধান করা হয় নগর অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদকে। একবার বৈঠক করা ছাড়া দৃশ্যত কোন কাজ করেনি এই কমিটি।

বিশেষজ্ঞ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমি কমিটির প্রধান হয়েছি। যদিও আমি দায়িত্ব নিতে চাইনি। আমরা মূলত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কি কি করছে তার ধারণা নেবো। রবীন্দ্রনাথ হলের মাঠটা যাতে বাঁচানো যায়, সেদিকেও ভাবছি।

তিনি বলেন, এখানে প্রকল্পগুলো আলাদা আলাদা পাশ হয়েছে। পরে তা সমন্বয় করা হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানের সমস্ত কম্পোনেন্ট (উপাদান) এখানে অনুপস্থিত। তবে বার্ড ওয়ে, লেকরক্ষা এসব বিষয় মাথায় রাখা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রকল্প প্রস্তাবের ভিত্তিতে টাকা দেয়া হয়েছে। ফলে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। মাস্টারপ্ল্যান করার আগে সবার জানা থাকলে হয়তো এখন যে প্রশ্নগুলো ওঠছে, তা উঠতো না বলেও মন্তব্য করেন এই শিক্ষক।

অন্যদিকে, পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক জামাল উদ্দীন বলেন, মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে বিস্তারিত টার্ম অফ রেফারেন্স থাকতে হয়, যা সিন্ডিকেট কর্তৃক মনোনীত বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রণীত হয়ে সিন্ডিকেট ও সিনেটে পাশ হবে। মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য প্রকল্প পরিচালক ও প্রকল্প ব্যবস্থাপকও মনোনয়ন দিতে হয়, যার মধ্যে একজন অবশ্যই এ কাজে অভিজ্ঞ পরিকল্পনাবিদ হওয়া উচিত। কিন্তু এই প্রকল্পে সেসব অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

তিনি বলেন, মহাপরিকল্পনার কাজ বুঝে নেয়া ও মূল্যায়ন করার জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন টেকনিক্যাল মনিটরিং এন্ড ইভাল্যুয়েশন কমিটি থাকা আবশ্যক, যাতে একজন পরিকল্পনাবিদসহ পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, উদ্ভিদ ও প্রাণী বিশেষজ্ঞ, ভূগোলবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ, তথ্য ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, পানি বিশেষজ্ঞ, পরিবহন বিশেষজ্ঞ, অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও ভৌত অবকাঠামো প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ উপস্থিত থাকবেন। বাস্তবে এ ধরনের কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। মহাপরিকল্পনার কোন শর্তই এখানে মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন অধ্যাপক জামাল উদ্দিন।

এদিকে, আন্দোলন চলমান থাকাকালে ২৩শে আগস্ট সকালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের পাশে ছেলেদের হলের জন্য নির্ধারিত স্থানে গাছ কাটা শুরু হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জোরালো প্রতিবাদে নামে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন চলাকালেই ভিসির বাসভবনে প্রকল্প থেকে ছাত্রলীগকে ২ কোটি টাকা ভাগাভাগির প্রতিবেদন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। এই খবরে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। গঠন করা হয় অভিন্ন প্লাটফরম ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর।’

এ ব্যাপারে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ঐক্যমঞ্চের মুখপাত্র রায়হান রাইন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ঘিরে নির্মিতব্য হলগুলোর স্থান পুন:নির্ধারণ করে এমন জায়গা নিতে পারতো যাতে বেশি সংখ্যক গাছ কাটা না পড়ে। এতে সংকট অনেকটা কমতো। তারা সেটা করেনি। উল্টো প্রকল্পের টাকা লুটপাটের খবর পরিস্থিতিকে জটিল করেছে।

এদিকে ছাত্রলীগের সঙ্গে প্রশাসনের বৈঠকের খবর আন্দোলনে ঘি ঢেলে দেয়। আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করতে এ বৈঠক- এমন অভিযোগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দার ঝড় ওঠে।

ছাত্রলীগকে ২ কোটি টাকা প্রদানের অভিযোগের ব্যাপারে কথা বলতে গেলে ভিসি অফিসে লাঞ্ছনার শিকার হন জাতীয় দৈনিকের ২ জন সাংবাদিক। ভিসির এমন আচরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সারাদেশে নিন্দার ঝড় ওঠে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন নিন্দা জানায়। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজসহ ১৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাংবাদিক সংগঠন ভিসির এ ধরনের আচরণের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন বলেন, সংবাদমাধ্যমের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিদের জন্যও মুক্তপ্রকাশের আন্তর্জাতিক চার্টার ও প্রেস কাউন্সিলের আচরণবিধি প্রযোজ্য। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন কোন আচরণবিধি আলাদা করে নির্দিষ্ট করতে পারে না, যা ওই চার্টার ও আচরণবিধির সাংঘর্ষিক। সাংবাদিকতার মূলনীতি ও নৈতিকতা মেনে চলে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে ক্যাম্পাসের একজন সাংবাদিক যেন কোন চাপ ছাড়া সংবাদ-সংগ্রহ ও প্রকাশ করতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্বও সংশ্লিষ্ট সকলের।

সর্বশেষ ২৭শে আগস্ট আওয়ামী লীগের একাংশ, বিএনপি ও বামপন্থি শিক্ষকদের নিয়ে গঠন করা ত্রিদলীয় জোট ‘সম্মিলিত শিক্ষক সমাজ’ প্রকল্প নিয়ে ওঠা সব ধরনের দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার অভিযোগের বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন। দাবি অনুযায়ী তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখার আহবান জানান তারা।
এসব বিষয়ে ২ দিন ধরে চেষ্টা করেও ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

https://www.mzamin.com/article.php?mzamin=187938