মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচে বেষ্টনীর মধ্যে চলছে মাদক বেচাকেনা। ঝুপড়ির মতো ঘরগুলোতে দিনে রাতে চলে মাদক সেবন। গতকাল দুপুরে মালিবাগ এলাকা থেকে তোলা ছবি -মতিউর সেন্টু
২৯ আগস্ট ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৩:২৮

অরক্ষিত ফ্লাইওভার

নগরীর যানজট নিরসন ও পরিবহন সেবায় স্বস্তি আনতে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলেও পুরোপুরি স্বস্তি মেলেনি। বর্তমানে ফ্লাইওভারগুলো এক আজানা আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো ফ্লাইওভারের উপরের অংশ ভেঙে একাকার হয়ে আছে। নোংরা ময়লা আবর্জনায় পরিবেশ হয়ে আছে কলুষিত। রাতে বাতি না জ¦লায় অন্ধকারে ভুতুড়ে পরিবেশে প্রায়ই ঘটছে ছিনতাই, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনা। বেপরোয়া গতির কারণে প্রায়শঃ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে। এ ছাড়া ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা দখল করে মাদকের আখড়া, হাট-বাজার, গাড়ির স্ট্যান্ড, অবৈধ পার্কিংসহ ঘোড়ার আস্তাবল গড়ে তুলেছে দুর্বৃত্তরা। ফ্লাইওভার উপর দিয়ে ভারী মালামালবহনকারী লরি, পাথরবোঝাই ট্রাক ও ট্রেইলর চলাচলের কারণে এগুলোর স্থায়িত্বও হুমকির মুখে। ভুক্তভোগী ও নগর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট নগর কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি না থাকায় ফ্লাইওভারগুলো অরক্ষিত ও অপরাধের কেন্দ্র হয়ে পড়েছে।

ভুক্তভোগীরা ও নগর সংশ্লিষ্টরা বলেন, ফ্লাইওভারগুলো ঘিরে সক্রিয় রয়েছে অনেকগুলো সংঘবদ্ধ অপরাধাী চক্র। ফ্লাইওভারে উপরে ছিনতাই, খুন, বেপরোয়া গতির প্রতিযোগিতা এবং এর বাইরে নিচের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে মাদক ও অপরাধের আখড়া। বেশিরভাগ ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা দখল করে দোকান, অবৈধ পার্কিং, ফলের দোকান, মাছের হাট বসিয়ে চলছে লাখ লাখ টাকার সিন্ডিকেট বাণিজ্য। অপরাধী ও ছিনতাইকারীদের ভয়ে রাতে ফ্লাইওভার ব্যবহারকারী প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল আরোহীরা যখন-তখন বিপদে পড়ছেন। ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীরা অন্ধকারে ফ্লাইওভারের উপর গাড়ি পার্কিং করে ছিনতাইয়ের জন্য অপেক্ষা করে।

সর্বশেষ গত রোববার রাজধানীর মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভারে এক পাঠাও চালককে গলাকেটে তার মোটরসাইকেল ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মিলন নামে (৩৫) ওই চালকের মৃত্যু হয়। এছাড়া মঙ্গলবার খিলগাঁও ও শাজাহানপুর থানাধীন ফ্লাইওভারের উপর থেকে কিশোর অপরাধে জড়িত ১৩ জন কিশোরকে আটক করেছে র‌্যাব।

শাহাজাহানপুর থানার ওসি মোহাম্মদ শহিদ বলেন, প্রাথমিকভাবে এটিকে ছিনতাইয়ের ঘটনা মনে হচ্ছে। নগরীর সক্রিয় পেশাদার ছিনতাইকারীরা এর সাথে জড়িত থাকতে পারে। ফ্লাইওভারের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহসহ আশপাশের তথ্যাদি যাচাই করে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। এর আগে গত জুলাই মাসে হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে মোটরসাইকেলযোগে কাজলার বাসায় যাওয়ার পথে সায়েদাবাদ এলাকায় ৪ ছিনতাইকারির কবলে পড়েন নিখিল ভদ্র নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা।

সূত্র মতে, মহাখালী, রমৗচাক ও যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে মাসে গড়ে ১৫ থেকে ২০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। তবে বেশিরভাগ ভুক্তভোগি থানায় অভিযোগ করেন না।

গত মঙ্গলবার রাজধানীর খিলগাঁও ও শাজাহানপুর থানাধীন ফ্লাইওভারের উপর থেকে কিশোর অপরাধে জড়িত ১৩ জন কিশোরকে আটক করেছে র‌্যাব-৩ এর একটি দল। পরে প্রত্যেককে ৫০০ টাকা জরিমানা করে মুচলেকা নিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ফ্লাইওভারের উপরে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে নানা অপরাধে জড়িত থাকায় তাদের আটক করা হয়। এছাড়া ২০১৭ সালে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের ওপর এক তরুণীর বস্তাবন্দি লাশ ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে কুড়িল ফ্লাইওভারে চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে বাস থেকে পড়ে নাসরিন আক্তার নামে এক তরুণী নিহত হয়। ২০১৪ সালের থার্টি ফার্স্ট নাইটে মহাখালী ফ্লাইওভারে চলন্ত গাড়ি থেকে সন্ত্রাসীরা রেজাউল করিম নামে এক যুবককে খুন করে লাশ ফেলে দেয়। একই বছর অক্টোবরে একই ফ্লাইওভার থেকে জেসমিন সুলতানা নামে এক মহিলার লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময় আরও অনেক ঘটনা ঘটে।

সরেজমিন কয়েকটি ফ্লাইওভার ঘুরে দেখা গেছে, কুড়িল ফ্লাইওভারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ময়লা আবর্জনা। কুড়িল প্রান্ত থেকে ওঠার সময় দুদিকে বড় বড় গর্ত। উপরের সিমেন্ট উঠে গিয়ে বড় বড় খানাখন্দ। এ ছাড়া ফ্লাইওভারের উপরে পড়ে আছে ময়লার স্তুপ। চলন্ত গাড়ি থেকেও দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। দেখলেই বোঝা যায়, এই ফ্লাইওভারের উপরে কোনো নজরদারি নেই। সে কারণে যার যেমন খুশি ময়লা আবর্জনা ফেলে যায়। কুড়িল এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাতের অন্ধকারে অনেকেই ফ্লাইওভারের উপর ময়লা ফেলে যায়। সেই ময়লাগুলো জমে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারের একই দশা। এখানেও ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করা হয় না। ফ্লাইওভারের উপরে জমে আছে গাড়ির কাঁচ। আর বৈদ্যুতিক বাতি না জ্বলায় রাতে মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারটিতে ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তবে ব্যতিক্রত শুধু যাত্রাবাড়ি-গুলিস্তান মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। এখানে প্রতিদিন প্রতি ঘণ্টায় পরিচ্ছন্নকর্মীরা ব্যস্ত সময় কাটায়।

ফ্লাইওভারের নিচের বেশিরভাগ জায়গা অবৈধ দখল হয়ে আছে। শুধু মহাখালী এবং বনানী ফ্লাইওভার নিচের অংশ এখনো ফাঁকা দেখা আছে। বেশিরভাগ ফ্লাইওভারের নিচে লেগুনা স্ট্যান্ড, টিকেট কাউন্টার, কাঁচা বাজার, সবজি ও মাছের বাজার, বাস, মাইক্রোবাস, জিপ, প্রাইভেটকারের গ্যারেজ ও গাড়ি মেরামতের জায়গা বানানো হয়েছে। মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নিচে চায়ের দোকান, অবৈধ পার্কিং, ফলের দোকানসহ অন্যান্য স্থাপনা। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে ঘোড়ার আস্তাবল, বাসস্ট্যান্ড জুতার দোকান, মুদি দোকান এমনকি সবজি ও মাছ-মাংসের বাজার বসানো হয়েছে।

কোন কোন ফ্লাইওভারে উঠতে ও নামার মুখের কাছাকাছি দূরত্বে পুলিশের উপস্থিতি দেখা গেলেও নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়ে তাদের উদাসীন দেখা গেছে। কোন ফ্লাইওভারের কাছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দেখা যায়নি। এমনকি সিটি করপোরেশন বা অন্য কোন সংস্থার সদস্যদেরও চোখে পড়েননি। তবে হানিফ ফ্লাইওভারের অবস্থা ব্যতিক্রম। বিভিন্ন পয়েন্টে টোল আদায়কারী সংস্থার লোকদের উপস্থিতি রয়েছে।

এলজিইডি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ফ্লাইওভার নির্মাণে এলজিইডি মন্ত্রণালয় সম্পৃক্ত থাকলেও এগুলো চালু হওয়ার পর তা দেখাশোনা করার দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। কিন্তু উভয় সিটি করপোরেশন দায়িত্ব নিলেও তারা যথাযথভাবে তদারকি না করায় অরক্ষিত হয়ে পড়েছে ফ্লাইওভারগুলো।

ভুক্তভোগীরা বলেন, নগরীর অন্যান্য রাস্তার চেয়ে ফ্লাইওভারের উপরে নজরদারি কম থাকায় অপরাধীরা ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধের জন্য নিরাপদ জোন হিসেবে বেছে নিয়েছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ফ্লাইওভারে যেখানে-সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা, মোটরসাইকেল দাড় করিয়ে আড্ডাবাজিসহ নানা সুযোগকে কাজে লাগায় অপরাধীরা। তারা বলেন, ফ্লাইওভারের কোন কোন জায়গায় একটি বাতিও জ্বলে না। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা থাকলেও এগুলো মেরামত করার উদ্যোগ নেই। লাইট নষ্ট থাকায় সন্ধ্যার পর ফ্লাইওভারের ওপরে ও নিচে ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

গুলিস্তানে আবুল কাশেম নামে এক দোকানী বলেন, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের পরিবেশ অনেক খারাপ। নিচ দিয়ে হাঁটা যায় না। চানখাঁরপুলের পর থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত পুরো রাস্তা জুরে ঘোড়া বেঁধে আস্তাবল বানানো হয়েছে। এ ছাড়া রাতের অন্ধকারে এই পথ দিয়ে চলতে গেলে প্রায়শঃ ছিনতাইর ঘটনা ঘটে।

মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের দুরবস্থা নিয়ে স্থানীয়রা বলেন, নিচের বেশিরভাগ জায়গা ভ্রাম্যমাণ মাদকসেবী আর পতিতারা দখল করে রেখেছে। দিন-রাত সব সময় এসব আখড়া থেকে মাদক কেনাবেচা ও অসামাজিক কার্যকলাপ চলে।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, দুই সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গাফেলতি রয়েছে। লাইটিং ও সিসি ক্যামেরা মনিটরিংয়ের পাশাপাশি স্পর্শকাতর ফ্লাইওভারগুলোর উভয়পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরি করা হলে অপরাধ অনেক কমবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কর্মকর্তারা জানান, ল্যাম্পপোস্টের খুঁটির গোড়া থেকে বিদ্যুতের তার কেটে নেয়ায় বাতি থাকলেও সেগুলো জ্বলে না। এছাড়া সিসি ক্যামেরা লাগিয়েও তা যথাযথ তদারকির অভাবে রক্ষা করা যাচ্ছে না। একবার লাগানোর পর থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই এসব লাইট ও ক্যামেরা চুরি হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্লাইওভারের কারণে নগরীর পরিবহনসেবা অনেক সহজ হলেও যথাযথ তদারকির অভাবে তা আতঙ্কে পরিণত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জিয়া খান বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে অপরাধ প্রতিহন ও অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, জনবল সঙ্কটের কারণে ফ্লাইওভারে সার্বক্ষণিক পুলিশ রাখা যাচ্ছে না। তবে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বদা কাজ করছে। লোকবল বাড়লে সার্বক্ষণিক পুলিশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/230257/