২৮ আগস্ট ২০১৯, বুধবার, ১:১১

লাইসেন্স খাদে, বিআরটিএ ঘুমে

রাজধানীসহ দেশজুড়ে গাড়ি চালানোর স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্বাভাবিক সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ভবিষ্যৎ চাহিদা নির্ধারণ করে আগাম ব্যবস্থা না নেওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আটকে আছে প্রায় আট লাখ লাইসেন্সপ্রার্থী। আবার লাইসেন্স সরবরাহের জন্য যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল বিআরটিএ, আগামী মাসে সেই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স সরবরাহ শেষ হচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন করে নানা প্রক্রিয়া শেষ করে লাইসেন্স পেতে প্রার্থীদের অপেক্ষা করতে হবে প্রায় ১৪ মাস। কিন্তু বিআরটিএ মধ্যবর্তী এ সংকট মোকাবেলায় এখনো কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পারেনি।

বর্তমানে শুধু মুদ্রণের জন্যই কেন্দ্রীয়ভাবে এক লাখ ৭৯ হাজার ৩৯৪টি লাইসেন্স দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলার আরো অন্তত ছয় লাখ আবেদনকারী লাইসেন্স পেতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আটকে আছে।

লাইসেন্স সরবরাহের জন্য বিআরটিএর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেড। চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির প্রতিদিন সরবরাহ করার কথা চার হাজার লাইসেন্স। এখন ভিআইপিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ২৫০টি লাইসেন্স সরবরাহ করা হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঘুষ না দিলে সাধারণ আবেদনকারীরা লাইসেন্স পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত বছর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের পর চাপের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটিকে অতিরিক্ত লাইসেন্স সরবরাহ করতে হয়েছে। এ অবস্থায় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ থাকলেও চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স সরবরাহ শেষ হচ্ছে আগামী মাসের মধ্যে। মধ্যবর্তী সংকট মোকাবেলায় প্রায় এক বছর আগে চিঠি দিয়ে বিআরটিএকে আগাম সতর্ক করেছিল টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ৬৪টি জেলার ৭২ এনরোলমেন্ট স্টেশনের স্থানীয় আবেদনকারীর তথ্য বিআরটিএর স্থানীয় কার্যালয় থেকে বিআরটিএর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে না। শুধু দালালদের মাধ্যমে যেসব লাইসেন্সের জন্য ঘুষ নেওয়া হয় তাদের তথ্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিআরটিএ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠানো হয়। বিআরটিএর অপারেটর ও দালালরা জেলায় জেলায় ফাইল আটকে রাখছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ছবি তোলার পর তিন

কর্মদিবসের মধ্যে কেন্দ্রীয় সার্ভারে সব তথ্য পাঠানোর কথা, কিন্তু তা পাঠানো হয় না।

কী পরিমাণ আবেদন জমা আছে তা আগে চিঠি দিয়ে জানতে চাওয়া হতো বিআরটিএ সদর দপ্তর থেকে। বর্তমানে তা-ও বন্ধ রয়েছে। প্রকৃত আবেদনকারীর অবস্থা না জানায় এবং ব্যবস্থা না নেওয়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে এ গভীর সংকট তৈরি হয়েছে। বিআরটিএর পরিচালক (প্রকৌশল) লোকমান হোসেন মোল্লা গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিআরটিএর স্থানীয় কর্মকর্তারা আমাদের কাছে যাতে মোট আবেদনকারীর তথ্য পাঠান তার জন্য তাগিদ দিয়ে চিঠি দেব। না পাঠালে তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেব। আমি দায়িত্বে আসার পর গত ফেব্রুয়ারিতে এজন্য চিঠি দিয়েছিলাম।’

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সংকট উত্তরণের জন্য চুক্তির অতিরিক্ত ৩০ শতাংশ লাইসেন্স সরবরাহের জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটিকে চাপ দিলেও প্রস্তাবটি গতকাল পর্যন্ত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে পাঠানো হয়নি। প্রস্তাবটি এক মাসের মধ্যে অনুমোদন হলেও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত লাইসেন্স ছয় মাসের আগে সরবরাহ করতে পারবে না বলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ ছাড়া প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচ বছরের জন্য নতুন ৩৫ লাখ লাইসেন্স সংগ্রহের জন্য বিআরটিএ গত ২১ জুলাই দরপত্র আহ্বান করেছে। এরই মধ্যে দুইবার দরপত্রের সময় বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ সময় বাড়িয়ে করা হয়েছে আগামী ৪ সেপ্টেম্বর। এই দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগবে অন্তত আট মাস। আট মাসে দরপত্র চূড়ান্ত হওয়ার পর চুক্তি হবে বিআরটিএর সঙ্গে। তারপর লাইসেন্স সরবরাহ করতে লাগবে কমপক্ষে ছয় মাস। অর্থাৎ নতুন করে লাইসেন্স পেতে অপেক্ষা করতে হবে অন্তত ১৪ মাস।

নিবন্ধিত গাড়ি ও সরবরাহ করা লাইসেন্সের বিষয়ে বিআরটিএর পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, দেশে পাঁচ লাখ ২৯ হাজার ১১৬টি গাড়ি বৈধ লাইসেন্স ছাড়া চালানো হচ্ছে। গত জুলাই পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত হয় ৪১ লাখ ছয় হাজার ৯৩৪টি গাড়ি। একই সময়ে লাইসেন্স দেওয়া হয় ৩৫ লাখ ৭৭ হাজার ৮১৮টি।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে জানা গেছে, ৩৯ শতাংশ ভারী গাড়ির চালকের বৈধ লাইসেন্স নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারী যানবাহনের ক্ষেত্রে গাড়ির তুলনায় আড়াই থেকে তিন গুণ বেশি চালক থাকা জরুরি। বিভিন্ন পরিবহন সমিতি ও ইউনিয়নের হিসাবে বাস, মিনিবাস, ট্রাক, পিকআপ, লরি, অটোরিকশার চালক থাকে একাধিক। বাস্তবে দেশে অবৈধ চালক আছে কমপক্ষে ১৬ লাখ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে, একটি গাড়ির বিপরীতে দেড়জন চালক থাকতে হয়। আমাদের দেশে গাড়ির সমসংখ্যক চালকই নেই। সড়কে দুর্ঘটনা রোধে গাড়ির অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণে দরকার বৈধ চালক।’

রাজধানীতে বেড়েছে অ্যাপভিত্তিক মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও অটোরিকশা। ঢাকায় নিবন্ধিত বিভিন্ন ধরনের গাড়ির ৬০ শতাংশই মোটরসাইকেল। জরিমানার ভয়ে লাইসেন্স পেতে বিআরটিএ কার্যালয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে চালকরা। রাজধানীতে এ ধরনের গাড়ির বেশির ভাগ চালকের কাছে বৈধ লাইসেন্স আছে কি না তা যাচাই না করেই উঠে পড়ছে যাত্রীরা। পথে চলতে গিয়ে পড়ছে দুর্ঘটনায়। গত ১৮ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁও মোড়ে অপেক্ষারত অটোরিকশা ঢাকা মেট্রো থ-১৩-৫০০৮-এর চালক মহিব উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বৈধ লাইসেন্স দেখাতে পারেননি। মহিব জানান, লাইসেন্স পেতে আবেদন করেছেন। ছবি ও আঙুলের ছাপ দিয়েছেন বিআরটিএ ইকুরিয়া কার্যালয়ে গত ১০ জুলাই, কিন্তু কবে লাইসেন্স সরবরাহ করা হবে তা জানানো হয়নি।

রাজধানীর মিরপুরে বিআরটিএ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত জুন থেকে লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রয়েছে। ওই কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (প্রকৌশল) মোহাম্মদ আলী আহসান মিলন বলেন, ‘জুন মাস থেকে আমরা লাইসেন্স দিতে পারছি না প্রিন্ট না হওয়ায়। সব প্রক্রিয়া শেষ করার পরও ১৭ হাজার ২২২ আবেদনকারীর লাইসেন্স দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

তবে বিশেষ ক্ষেত্রে বিআরটিএর বিভিন্ন কার্যালয় থেকে জরুরি চিহ্নিত করে বিআরটিএ সদর কার্যালয়ে পরিচালকের (প্রকৌশল) দপ্তরে কিছু আবেদনের রেফারেন্স নম্বর পাঠানো হচ্ছে। পরে তা মুদ্রণের জন্য পাঠানো হয় টাইগার আইটির কাছে।

গত ১৮ আগস্ট বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৬ আগস্ট থেকে ১৭ আগস্ট ১২ দিনে ঈদুল আজহা উপলক্ষে যাতায়াতকালে দেশে ২০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২২৪ জন প্রাণ হারায়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এসব দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশের কারণ চালকের বেপরোয়া গাড়িচালনা। এর মধ্যে চালকদের বড় একটি অংশের বৈধ লাইসেন্স নেই। সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩৩ শতাংশ ঘটেছে মোটরসাইকেলচালকের বেপরোয়া গতিতে।

লাইসেন্স সরবরাহের হার কমে যাওয়ায় সংকট আরো প্রকট হবে বলে মনে করছেন বিআরটিএর কর্মকর্তারা। ২০১১ সালের নভেম্বর থেকে বিআরটিএ স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স দিচ্ছে গ্রাহকদের। এর জন্য চুক্তি হয় টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেডের সঙ্গে। প্রথম দফা চুক্তির আওতায় প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ বছরে ১১ লাখ ৫০ হাজার ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহের কথা ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে ওই সংখ্যক লাইসেন্স ছাড়াও অতিরিক্ত এক লাখ ৭২ হাজার লাইসেন্স সরবরাহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর দ্বিতীয় দফা চুক্তিতে ১৫ লাখ লাইসেন্স সরবরাহের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ১৩ লাখ ৮০ হাজার লাইসেন্স সরবরাহ করেছে।

গত বছর জুলাই-আগস্টে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর পুলিশ ও বিআরটিএর অভিযান বেড়ে গেলে জরিমানা-মামলা থেকে রেহাই পেতে বিআরটিএ কার্যালয়ে লাইসেন্সের আবেদনের স্তূপ হতে থাকে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে যাবার জন্য লাইসেন্স নিতে অতিরিক্ত চাপ পড়েছিল। লাইসেন্স নেওয়ার এই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান ড্রাইভিং লাইসেন্স সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের পাঁচ বছরের মধ্যে যে কার্ড দেওয়ার কথা ছিল তা দেওয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। ৪০ হাজার কার্ড এসেছে, আরো ৪০ হাজার কার্ড আসবে। এ ছাড়া বর্তমান সরবরাহকারীকে ৩০ শতাংশ লাইসেন্স কার্ড সরবরাহের প্রক্রিয়া দ্রুত চূড়ান্ত হবে বলে আশা করছি। সংকটের কারণে অনেক স্থানে লাইসেন্স বিতরণ করতে হচ্ছে ধীরে। আমরা নতুন লাইসেন্স সংগ্রহের জন্য দরপত্র আহ্বান করেছি। প্রক্রিয়া শেষ হতে ছয় মাস লাগবে। এই সময়ের মধ্যে সংকট মোকাবেলায় সাড়ে চার লাখ লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারব বলে আশা করছি।’

টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেডের স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রকল্পের পরিচালক এ বি এম মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং সৌদি আরবে গাড়িচালকের চাকরি নেওয়ার হিড়িকে লাইসেন্স দেওয়ার হার দ্বিগুণ হয়েছিল। বিআরটিএ ভবিষ্যৎ চাহিদা ও জোগান নিয়ে কোনো গবেষণা করেনি। বর্তমানে আমাদের কাছে আট হাজার লাইসেন্স আছে। ফ্রান্স থেকে এসেছে ৪০ হাজার। এভাবে দু-তিন ধাপে আমাদের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে সব লাইসেন্স কার্ড দিয়ে দেব আগামী মাসের মধ্যে। বাড়তি ৩০ শতাংশ লাইসেন্সের জন্য এখনো বিআরটিএ বা মন্ত্রণালয় লিখিত চিঠি দেয়নি।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/08/27/807729