৮ আগস্ট ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১২:৩৯

১০ সংস্থার হেলাফেলায় ঢাকায় বেড়েছে এডিস

শীর্ষে দুই সিটি ও ঢাকা ওয়াসা

রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু জ্বর মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ার পেছনে কেবল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনই দায়ী নয়, রাজধানীর আরও অন্তত আটটি সেবা সংস্থাও দায়ী। তাদের উদাসীনতা, দায়িত্বে অবহেলা আর হেলাফেলার কারণেই রাজধানীতে এডিস মশার এই বাড়বাড়ন্ত। এসব সংস্থা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে সিটি করপোরেশনের সীমাহীন ব্যর্থতার পরও ডেঙ্গুর দৌরাত্ম্য এত ভয়াবহ আকারে দেখা দিত না। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান এডিস মশা প্রতিরোধে অতীতের মতো এখনও কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। এমনকি এ ক্ষেত্রে তাদের কিছু করণীয় আছে বলেও মনে করে না তারা। দুই সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি উদাসীনতা দেখানো এসব সংস্থার মধ্যে রয়েছে ঢাকা ওয়াসা, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত অধিদপ্তর, রাজউক, রিহ্যাব, সড়ক বিভাগ, তিতাস ও বিটিসিএল।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান সমকালকে বলেন, মশার বংশ বিস্তারের উর্বর ক্ষেত্র রাজধানীর বদ্ধ জলাশয়। বিশেষ করে খাল, বক্স কালভার্ট ও ড্রেন। কিন্তু ঢাকা ওয়াসা এদিকে তেমন নজর দেয় না। নজর দিলে খালে পানিপ্রবাহ থাকত। মশার এত দৌরাত্ম্য দেখা দিত না। তিনি বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দায়িত্ব ভবনগুলোর নির্মাণকাজ তদারকি করা। তারা এটা কখনোই যথাযথভাবে করে না। ফলে নির্মাণাধীন ভবনগুলো এডিস মশার উর্বর উৎপাদন ক্ষেত্রে পরিণত হয়। বর্তমানে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। এ কাজের কারণে অনেক স্থানে পানি জমে থাকছে। কিন্তু নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো সেদিকে কোনো নজর দেয়নি। এভাবে রাজউক, গণপূর্ত অধিদপ্তর, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান কখনোই এদিকে নজর দেয়নি। এতে পুরো রাজধানীই মশার বংশ বিস্তারের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থার তদারকি নিয়ে সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার মধ্যে টানাহেঁচড়া রয়েছে। তাই বর্ষা মৌসুম শুরু হলেও ড্রেন, বক্স কালভার্ট ও খাল পরিস্কারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি ওয়াসা। এতে এগুলোতে পানিপ্রবাহ বলতে গেলে বন্ধ হয়ে গেছে এবং বদ্ধ পানিতে মশার বংশ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি পাইপলাইন স্থাপনের জন্য ঢাকা ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি করা স্থানগুলোতে একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমছে। সেখানে এডিস মশা ডিম পাড়ছে। এ ব্যাপারে সংশ্নিষ্ট ঠিকাদারদের সতর্ক করা হয়নি। এমনকি ডেঙ্গু ভয়াবহ হয়ে উঠলেও ওয়াসার পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ডেঙ্গুর ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের পৃথক কোনো পরিকল্পনা নেই। কর্তৃপক্ষও কোনো কিছু বলেনি। তিনি এ ব্যাপারে ড্রেনেজ সার্কেলের প্রকল্প পরিচালক শওকত মাহমুদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। শওকত মাহমুদ বলেন, প্রকল্পে যেসব কাজের উল্লেখ থাকে, সেগুলোর বাইরে তাদের কিছু করার থাকে না। ডেঙ্গুর জন্যও তাদের অতিরিক্ত কিছু করার সুযোগ নেই। তারা রুটিন ওয়ার্কগুলো করছেন।

সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষেরও ডেঙ্গু বিষয়ে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। বর্তমানে রাজধানীতেই জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ছয়টি বড় বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রতিটি প্রকল্পের অধীনে একাধিক বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে। এসব নির্মাণাধীন ভবনের বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ এডিস মশার উৎকৃষ্ট বাসস্থল ও প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। কিন্তু জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের বোর্ড সদস্য (কারিগরি ও সমন্বয়) এস এ এম ফজলুল কবির বলেন, তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এমনিতেই ডেঙ্গুর বিষয়ে সচেতন। তাই তাদের কোনো কমকর্তা-কর্মচারী বা তাদের পরিবারের সদস্যদের কেউ এখনও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি। তবে কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে, ঠিকাদাররা যেন নির্মাণকাজের সময় এ বিষয়ে খেয়াল রাখেন। অবশ্য মেসেজ তাদের কাছে পৌঁছেছে কি-না, তা চেক করা হয়নি।

একই অবস্থা গণপূর্ত অধিদপ্তরের। রাজধানীসহ সারাদেশের প্রায় সর্বত্রই কমবেশি এদের কাজ চলছে। এর মধ্যে রাজধানীতেও বর্তমানে হাফডজন প্রকল্প চলমান। কিন্তু এখান থেকেও এ ধরনের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দে বলেন, এ ব্যাপারে অফিসিয়ালি কোনো নির্দেশনা দেওয়া না হলেও প্রত্যেক প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে সচেতন থাকতে বলা হয়েছে।

ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ডেভেলপার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণাধীন ভবনে অভিযান চালিয়ে অর্ধশতাধিক ভবনে এডিস মশার লার্ভা ও মশা পেয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত ২৪ জুলাই এক দিনেই ২২টি ভবনের মালিককে সাড়ে চার লাখ টাকা জরিমানা করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে অর্ধশতাধিক ভবন মালিককে জরিমানা করে দুই সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে তমা কনস্ট্রাকশনের একটি ভবনে এডিস মশা ও লার্ভা পাওয়ায় এবং মশার প্রজনন উপযোগী পরিবেশ পাওয়ার দায়ে একজন কর্মীকে সাত দিনের কারাদণ্ডও দিয়েছেন আদালত। গত শনিবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নগর ভবনের বেসমেন্টেও এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। নগর ভবনটি নির্মাণ করছে ইউনাইটেড গ্রুপ। ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই লাখ টাকা জরিমানাও করেন।

এতকিছুর পরও ভবন মালিক বা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সচেতনতা ফিরে আসেনি বলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের অভিমত। তিনি বলেন, এডিস মশার লার্ভা পাওয়া ভবনের মালিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আরও কঠোর হতে হবে। কারণ ডেঙ্গু ব্যাপকাকার ধারণ করলেও তাদের মধ্যে সচেতনতার মাত্রা বাড়ছে না।

এদিকে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) পক্ষ থেকেও ডেভেলপারদের সচেতন করা হয়নি। কোনো নির্দেশনাও দেয়া হয়নি। তবে রিহ্যাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত হোসেন বলেন, ৬ আগস্ট তারা ডেঙ্গু বিষয়ে একটি সচেতনতা র‌্যালি করার উদ্যোগ নিয়েছেন। সিআর দত্ত রোডে অবস্থিত রিহ্যাব কার্যালয়ের সামনে থেকে এ র‌্যালি শুরু হবে। সেখান থেকে ডেভেলপারদের এ ব্যাপারে বার্তা দেয়া হবে।

রাজধানীকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার দায়িত্বে নিয়োজিত রাজউকের পক্ষ থেকেও কোনো তদারকি কার্যক্রম নেই। তারা একেবারেই উদাস হয়ে বসে আছে। রাজউকের সচিব সুশান্ত চাকমা বলেন, এডিস মশা বা ডেঙ্গু নিয়ে রাজউকের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। প্রায় একই কথা বলেন রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী রায়হানুল ফেরদৌস। এ ব্যাপারে তিনি কোনো নির্দেশনাও পাননি। কাউকে তিনি কোনো দিকনির্দেশনাও দেননি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, কোনো ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হলেই রাজউকের সংশ্নিষ্ট এলাকার অথরাইজড অফিসার ও ইন্সপেক্টরের উপস্থিত থেকে তদারকি করার কথা। তারা এটা কখনও করেন না। তাই হাজার হাজার নকশাবহির্ভূত ভবন গড়ে উঠেছে। আর এমন ভবনে পরিদর্শন করে এডিস মশার লার্ভার অস্তিত্ব খোঁজার চিন্তা তাদের ধারণারও বাইরে।

বর্তমানে কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সড়ক বিভাগ। মেট্রোরেল প্রকল্প এলাকায় খোঁড়াখুঁড়ির শেষ নেই। এসব খোঁড়াখুঁড়ি করা গর্তে বৃষ্টি হলেই পানি জমছে, যা এডিস মশার উৎকৃষ্ট প্রজননস্থল। উত্তরা থেকে মিরপুর হয়ে গুলিস্তান পর্যন্ত মেট্রোরেলের প্রকল্প এলাকার ভেতরের দৃশ্য দেখলেই বোঝা যায় তা। একই অবস্থা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ্রকল্প এলাকায়।

মশার বংশবিস্তার রোধে এসব প্রকল্পের নির্মাতা এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেও কোনো সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলা হয়নি। তিতাস ও বিটিসিএলও রাজধানীর অনেক এলাকায় বছরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করে। এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।

https://samakal.com/bangladesh/article/1908636/