৭ আগস্ট ২০১৯, বুধবার, ৯:৫৩

মশক নিবারণী দপ্তর মশাদের দখলে

পরিচালক বিদেশে, কর্মীদের কাজ নেই

নাম 'ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তর', কিন্তু মশা নিবারণের কোনো কার্যক্রমই নেই তাদের। উল্টো পুরো দপ্তরই যেন পরিণত হয়েছে মশা উৎপাদনের কারখানায়। অথচ সাত দশক আগে প্রতিষ্ঠার পর কী কর্মচঞ্চলই না ছিল এটির কার্যালয়! ডেঙ্গু এখন মূর্তিমান ত্রাস হয়ে উঠেছে সারাদেশে। এমন একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক দুই সপ্তাহ ধরে দেশের বাইরে রয়েছেন। অন্য কর্মচারীরাও সময় পার করছেন হেলেদুলে।

'নিস্কর্মা' এই মশক নিবারণী দপ্তরের অবস্থান রাজধানীর অরফানেজ রোড সংলগ্ন ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ঠিক বিপরীতে। গত সোমবার সরেজমিনে দপ্তরটিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটক বন্ধ। কিছু সময় ধরে ডাকাডাকির পর একজন নিরাপত্তাকর্মী এসে ফটক খোলেন। ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়ে মশার ওষুধের শত শত খালি ড্রাম। বলা যায়, পুরো প্রাঙ্গণই খালি ড্রামে পূর্ণ। কারও কোনো কাজ নেই বলে অফিসে তাদের উপস্থিতিও কম।

নিরাপত্তাকর্মী নাম-পরিচয় না দিয়ে জানালেন, এখানে ২৮১ জন কর্মচারী আছেন। এর মধ্যে সুপারভাইজার ৩৪ জন। বাকিরা একেবারেই নিম্ন শ্রেণির কর্মচারী। সিটি করপোরেশন ডাকলে তারা মশা মারায় সহযোগিতা করেন। প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তা আ ন ম ফয়জুল হক; একজন উপসচিব। কিন্তু মন্ত্রণালয়েই বেশিরভাগ সময় কাটান তিনি। খুব প্রয়োজন হলে এক-আধঘণ্টার জন্য দপ্তরে এসে ফের চলে যান। গত ২৬ জুলাই থেকে তিনি বিদেশে আছেন। কবে ফিরবেন, তা কেউ বলতে পারলেন না। অবশ্য নাম প্রকাশ না করে একজন জানালেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও পুষ্টি সেবা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশ সফরে গেছেন এই উপসচিব।

কয়েকজন কর্মী জানান, পরিচালক না থাকলে স্টোরকিপার গিয়াস উদ্দিনই সব নির্দেশনা দেন। কিন্তু ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) একটি মিটিং থাকায় তিনি সেখানে গেছেন। তার ফোন নম্বরও দিতে পারলেন না কেউ। অফিসের কেউই পরিচয় দিয়ে কথা বলতে আগ্রহ দেখালেন না।

কয়েকজন জানান, এক সময় ঢাকায় খুব ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ছিল। এ জন্য ১৯৪৮ সালে ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তর প্রতিষ্ঠা করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। সে সময় ম্যালেরিয়া মোকাবেলায় পুরো ভূমিকাই রাখত এই দপ্তর। অনেকেই কাজ করতেন। মশা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৭২ সালে দপ্তরটির ৩৩৮ জনবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেয় সরকার। ১৯৮১-৮২ সালে এ বিভাগকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসা হয়। পরে ঢাকা সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে দেওয়া হয়। এভাবে সংস্থাটি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলতে শুরু করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী বলেন, তাদের কাজ মশা নিধন করা। অথচ তাদের কোনো ক্ষমতাই নেই। পুরো দপ্তর এখন স্রেফ মশার ওষুধ রাখার গোডাউনে পরিণত হয়েছে। সিটি করপোরেশন কী পরিমাণ ওষুধ রাখল, কতটা নিয়ে গেল, তার হিসাব রাখা ও তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী মশা মারার ওষুধ বিভিন্ন জোনে বিতরণ করাই এখন তাদের কাজ।

কয়েকজন কর্মচারী জানান, তাদের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে বেতন দেওয়া হয়। এতে তারা সন্তুষ্ট নন। কারণ মাঝেমধ্যেই তাদের বেতন-ভাতা পেতে দেরি হয়। সিটি করপোরেশন তাদের কার্যক্রম মনিটর করলেও জোরালো কোনো নজর নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ও এ দপ্তরের ব্যাপারে উদাসীন। অনেকটা অভিভাবকহীনই বলা যায় এ দপ্তরকে।

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়ে সারি সারি খালি ড্রাম (ব্যারেল)। উঁচুতে টিলার মতো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কোনোটা মরিচা ধরে ফুটো হয়ে গেছে, কোনোটা ফেটে গেছে। কোনোটির ভেতরে-বাইরে পানিও জমে আছে। সব মিলিয়ে ড্রামগুলোয় মশার বংশবিস্তারের বেশ অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কর্মচারীরা বললেন, অনেক খালি ড্রাম জমার পর সিটি করপোরেশন নিলাম ডেকে ব্যারেলগুলো বিক্রি করে দেয়। গত চার বছর ধরে নিলাম না হওয়ায় ড্রামগুলো খোলা জায়গায় পড়ে আছে। সেখানে গজিয়ে উঠেছে লতাগুল্ম, ঘাস, গাছপালা, ঝোপঝাড়।

কর্মচারীরা জানান, ভেতরে একটা স্টোর রুম আছে। সেখানে কিছু ড্রামে মশার ওষুধ রাখা আছে। সিটি করপোরেশন চাইলে সেখান থেকে ওষুধ সরবরাহ করা হয়। পুরনো ড্রামগুলো তাদের কয়েকবার সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। তাতে সাড়া মেলেনি।

https://samakal.com/bangladesh/article/1908533/