৫ আগস্ট ২০১৯, সোমবার, ৩:৩৯

নাজুক অবস্থায় ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান

আজ জরুরি বৈঠক ডেকেছেন অর্থমন্ত্রী

ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই অবস্থা নাজুক। এর মধ্যে ১২টি প্রতিষ্ঠান ‘রেড জোন’ বলে বিবেচিত তালিকায় চলে গেছে। এগুলো এখন আমানতকারীদের অর্থও নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না। ইতোমধ্যে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ‘পিপলস লিজিং কোম্পানি’ অবসায়ন করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এই প্রতিষ্ঠানে একজন অবসায়ক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন ব্যাংক বহির্ভূত নেন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে জরুরি বৈঠক ডেকেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আজ বিকেল ৩টায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এই সব প্রতিষ্ঠানের এমডি ও চেয়ারম্যানদের থাকতে বলা হয়েছে।

জানা গেছে, উচ্চ সুদ দেয়ার আশ্বাস দিয়েও যেসব লিজিং কোম্পানি আমানতকারীদের সুদসহ অর্থ ফেরত দিতে পারছে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সাথে যেসব অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত তাদের কিছু দিকনির্দেশনা দেবেন অর্থমন্ত্রী। এসব প্রতিষ্ঠানে বিশেষ অডিট বা নিরীক্ষা কার্যক্রম চালানোর ঘোষণাও আসতে পারে আজকের বৈঠকে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে বলা হবে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নিয়ে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে। খেলাপি ঋণ, প্রভিশন সংরক্ষণ, মূলধন পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন সক্ষমতা বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাল, হলুদ ও সবুজ তালিকাভুক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে হলুদ তালিকায় রয়েছে ১৮টি প্রতিষ্ঠান। মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে সবুজ বা সবচেয়ে ভালো তালিকায়। লাল তালিকা হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত কিছু লিজিং কোম্পানি গ্রাহকদের আমানতের বিপরীতে সুদ পরিশোধ করা তো দূরের কথা মূল টাকা ফেরত দিতে পারছে না। শুধু তাই নয়, আমানত ফেরত পেতে গ্রাহকরা নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে তাদের কাছে বেশ কয়েকটি অভিযোগ এসেছে। কয়েকটি অভিযোগ আবার বেশ গুরুতর। তাই এখুনি আইন ভঙ্গকারী এই লিজিং কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ আইন অনুযায়ী লিজিং ফার্মগুলো গ্রাহকদের আমানতের টাকা মুনাফাসহ ফেরত দিতে বাধ্য।
এর আগে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ফজলুর রহমান স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে ‘বিভিন্ন লিজিং কোম্পানিতে গ্রাহকদের আমানতকৃত টাকা ফেরত প্রদান না করা/ফেরত প্রদানে নানা ধরনের হয়রানির অভিযোগ’ শীর্ষক একটি চিঠি দেয়া হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যবসা করার লক্ষ্যে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন লিজিং কোম্পানি গ্রাহকদের মেয়াদি আমানতের টাকা যথাসময়ে ফেরত না দেয়া বা ফেরত প্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির অভিযোগ মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নানাভাবে আলোচিত হচ্ছে। ভুক্তভোগি গ্রাহকগণ বিভিন্ন সময়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে প্রতিকারের জন্য বারবার আবেদন করেছেন।

চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, এমন পরিস্থিতির মধ্যেও বিভিন্ন লিজিং কোম্পানি উচ্চহারে সুদ প্রদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রদান অথবা মোবাইল এসএমএস প্রদানের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে লিজিং কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমের বিষয়ে জনগণ বিভ্রান্ত হচ্ছে। ভুক্তভোগী গ্রাহকদের প্রতিকার প্রদানের স্বার্থে এ ধরনের কার্যক্রম খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এ ছাড়া গ্রাহকদের মেয়াদপূর্ণ হওয়া আমানতের অর্থ সুদসহ ফেরত প্রদানের বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক হয়ে পড়েছে। চিঠিতে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, অভিযুক্ত লিজিং কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে আমানত সংগ্রহ করে আসছে। এমনকি তারা গ্রাহকদের মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে উচ্চ সুদের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন মেয়াদে আমানত সংগ্রহ করে, যা তারা করতে পারেন না। এসব লিজিং ফার্মের বেশ কয়েকটির আর্থিক অবস্থা আবার বেশ খারাপ। তাই গ্রাহকদের বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ৩৫টি লিজিং কোম্পানি প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করছে। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ শিল্পখাতে বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং আবাসন খাতসহ অন্যান্য খাতে তারা বিনিয়োগ করে থাকে। লিজিং কোম্পানিগুলো কোনো চেক, ডিমান্ড ড্রাফট বা পেঅর্ডার ইস্যু বা বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবসা করতে পারে না।

এর আগে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ফাস্ট ফাইন্যান্স লিমিটেডের বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়ম ধরা পড়ে। এ ছাড়াও পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অ-ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিআইএফসি, পিপলস লিজিং ও ফার্স্ট ফাইন্যান্সের। বিআইএফসির মোট ঋণের ৯৬ শতাংশ খেলাপি। কোনো পরিচালন আয় না থাকায় প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ছয় কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির। কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকার মূলধন রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিআইএফসিতে রয়েছে মাত্র ২৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে পিপলস লিজিংয়ের। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয় ৫০ কোটি টাকা। আর ফার্স্ট ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। প্রয়োজনের তুলনায় প্রতিষ্ঠানটির মূলধন কম রয়েছে ২০ কোটি টাকা। প্রভিশন ঘাটতির কারণে জরিমানাও গুনতে হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটিকে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/430725/