ডেঙ্গুর শিকার শিশু। ছবিটি ঢাকা শিশু হাসপাতাল থেকে তোলা হ নয়া দিগন্ত
৩১ জুলাই ২০১৯, বুধবার, ২:৪৮

দ্রুত ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সবার ছুটি বাতিল

সারা দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। নতুন নতুন এলাকায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের খবর আসছে। ঢামেক হাসপাতাল ও বরিশালে শেবাচিম হাসপাতালে গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চারজন মারা গেছেন। এ দিকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করেছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার দফতরে পৃথক মনিটরিং সেল গঠন করেছেন।

সিনিয়র প্রতিবেদক হামিম উল কবির জানিয়েছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নজিরবিহীন। প্রতিদিনই আগের রেকর্ড ভঙ্গ করছে। চলতি বছর শুধু জুলাই মাসে যত ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এর আগে কখনো সারা বছর এত মানুষ আক্রান্তও হয়নি। আবার গতকাল যত সংখ্যক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এর আগে এক বছরেও এত মানুষ আক্রান্ত হয়নি। সরকারি হিসাব অনুযায়ী গতকাল সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এক হাজার ৩৩৫ জন। ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে মোট ১৫ হাজার ৩৬৯ জন।

এ দিকে সরকারিভাবে নিশ্চিত করা না হলেও সোমবার রাতে এবং গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই দুইজন মারা গেছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। এদের মধ্যে একজন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন উপ-সচিবের স্ত্রী রয়েছেন। তিনি ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

ভাইরোলজিস্টরা বলছেন, এবার ডেঙ্গুতে মহিলার চেয়ে পুরুষের আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ১৬ থেকে ৩০ পর্যন্ত বয়সীরা বেশি। এ বয়সীরা ছাত্র ও কর্মজীবী। এরা বাইরে বেশি থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা: সাইফ উল্লা মুন্সি জানিয়েছেন, প্রথমবার আক্রান্তের পর ডেঙ্গুর একই সেরুটাইপ বহন করছে এমন এডিস মশা কামড় দিলে নতুন করে ডেঙ্গু জ্বরে ভুগবেন না কেউ। কিন্তু অন্য সেরুটাইপ বহন করছে এমন এডিস মশা কামড়ালে ডেঙ্গু জ্বর হবে এবং তখনই রোগী মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হবে। বর্তমানে হেমোরেজিক ও শক সিনড্রোমে যারা ভুগছেন সেসব রোগী আগের চেয়ে ভিন্ন সেরুটাইপ বহন করছে এমন মশায় আক্রান্ত হয়েছেন বলেই রোগী মারাত্মক অবস্থান সম্মুখীন। অধ্যাপক সাইফ উল্লা বলেন, মশা যেন কাউকে কামড়াতে না পারে সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে এবং সব সময় মশারির ভেতরে ঘুমাতে হবে।

এ দিকে ভয়াবহ আকারে ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জাহিদ মালেক দেশে নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তিনি ১০ দিনের জন্য মালয়েশিয়া গেছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে মন্ত্রণালয়ের কাজের বাইরে তিনি তিন দিন কক্সবাজারেও সময় কাটিয়েছেন।

এ দিকে ডেঙ্গু পরীক্ষা যেন সহজ হয় সেজন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ডেঙ্গু এনএস১, আইজিজি ও আইজিএম শনাক্তকরণের কিট ও রিএজেন্ট দ্রুত ছাড়করণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সব কাস্টমস হাউজের কমিশনারদের কাছে গতকাল মঙ্গলবার ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদশে ২০০০ সালে প্রথম যখন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হয় তখন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল পাঁচ হাজার ৫৫১ জন। ২০০২ সালে ছয় হাজার ২৩২ জন, ২০০৪ সালে তিন হাজার ৯৩৪ জন, ২০০৬ সালে দুই হাজার ২০০ জন, ২০১৫ সালে তিন হাজার ১৬২ জন, ২০১৬ সালে ছয় হাজার ৬০ জন, ২০১৭ সালে দুই হাজার ৭৬৯ জন এবং ২০১৮ সালে ছিল সাত হাজার ৯২১ জন।

জুলাই মাসই ডেঙ্গুর শেষ মওসুম নয়। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরেও সমানতালে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা থাকবে। কারণ এ সময়টাতেও বেশ বৃষ্টি থাকবে। আবার আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্ট বন্যা কমতে থাকবে। সেখানে গর্তে, খানা-খন্দকে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশা ডিম ছাড়বে এবং তখন গ্রামেও এই রোগ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আসন্ত ঈদে যারা ঢাকা থেকে গ্রামে যাবেন তাদের মাধ্যমেও ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

গতকাল দুপুর পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই ২২১ জন রোগী ভর্তি হয়েছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে। মিটফোর্ডে ১০৫ জন, শিশু হাসপাতালে ৪৮ জন, হলিফ্যামিলি হাসপাতালে ৪২ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দীতে ৬১ জন, বারডেমে ১৭ জন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬ জন, পুলিশ হাসপাতালে ৩৩ জন, মুগদা হাসপাতালে ৬৩ জন, বিজিবি হাসপাতালে দুইজন, কর্মিটোলা হাসপাতালে ৯০ জন অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালে ২৬৬ জন। অবশিষ্ট ৩৬১ জন রাজধানী ঢাকার বাইরের আট বিভাগের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর, বিভাগীয় কার্যালয় এবং জেলাপর্যায়ের কর্মরতদের মাঠপর্যায়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ, আইভি ফ্ল্রইড (স্যালাইন) ওআরএস, ডেঙ্গু শনাক্তকরণের কিট এবং এর পর্যাপ্ত রি-এজেন্ট সরবরাহ ও নির্ধারিত অতিরিক্ত মূল্যে যাতে বিক্রি করা না হয় তা নিবিড় পর্যবেক্ষণ করার জন্য ওষুধ প্রশাসনের মহাপরিচালক নির্দেশ দিয়েছেন।

ডেঙ্গু বিষয়ে গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে। এতে বিষয়ের উপর উপস্থাপনা করেন ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা: সাইফ উল্লাহ মুন্সি। উপস্থিত ছিলেন ভিসি অধ্যাপক ডা: কনককান্তি বড়–য়া, প্রোভিসি অধ্যাপক শাহানা আখতার রহমান, প্রোভিসি অধ্যাপক রফিকুল আলম প্রমুখ।

বিশেষ সংবাদদাতা জানান, সারা দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করেছে সরকার। একই সাথে অন্যান্য বিভাগের কর্মীদেরও এবার ঈদুল আজহার ছুটি নেয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। একই সাথে চলমান ডেঙ্গু রোগসংক্রান্ত জনভোগান্তি নিরসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চলমান কর্মকাণ্ড তদারকি করতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক তার নিজ দফতরে ডেঙ্গুরোগ সংক্রান্ত ‘মিনিস্টার মনিটরিং সেল’ গঠন করেছেন।

গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে ডেঙ্গু প্রতিরোধ, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা ও গুজব প্রতিরোধ সংক্রান্ত এক পর্যালোচনা সভায় এসব সিদ্ধান্তের কথা জানান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব শেখ মজিবুর রহমান (সংস্কার ও সমন্বয়)। সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ঈদের ছুটি তো একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান। তারপরও ঈদের ছুটির ব্যাপারে প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছুটি ক্যান্সেল করা হয়েছে। যেমনÑ স্বাস্থ্য বিভাগ। স্বাস্থ্য বিভাগে যেসব কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট, তাদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে সভায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাস ও কর্মস্থল পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্কুলের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বাতিল করা হয়েছে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে মহামারি ঘোষণা করা হবে কি নাÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যখন একেবারেই ম্যানেজমেন্টের বাইরে চলে যায়, এ রকম পর্যায়ে এখনো আসেনি। কোনো স্থানে ব্যবস্থাপনার বাইরে চলে গেছে, এ রকম কোনো তথ্য নেই। ডেঙ্গু মোকাবেলায় চিকিৎসকের স্বল্পতার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, যেসব চিকিৎসক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সে আছেন, তাদের প্রশিক্ষণ বাতিল বা স্থগিত করে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত করা হবে। হাসপাতালে জায়গা ও বেডের স্বল্পতা দূর করতে যেসব হাসপাতাল এখন ব্যবহার হচ্ছে না সেগুলো

সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ডেঙ্গু চিকিৎসার ফি নিয়ে কথা হয়েছে কি নাÑ জানতে চাইলে মুজিবুর রহমান বলেন, সাধারণ ডেঙ্গুর ইনভেস্টিগেশন যেটা হয় সেটা অনেক বেশি, দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। এটা কমিয়ে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা এবং মোট এক হাজার ৪০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এটা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সচিব বলেন, ক্রমান্বয়ে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। মানুষ ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। সরকারের ত্রাণ-তৎপরতা অব্যাহত আছে। জেলায় জেলায় ডিসি, এসপি, ইউএনওরা এই কাজ সমন্বয় করছেন। এখন পুনর্বাসনের জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

বরিশাল ব্যুরো জানায়, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে দুই যুবক মারা গেছেন। তারা হলেন বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর গ্রামের নাসির খানের ছেলে আসলাম খান (২৪) ও পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার গোসনতারা গ্রামের আদম আলীর ছেলে সোহেল (১৯)।
গতকাল সকালে বিষয়টি নিশ্চিত করে হাসপাতালে পরিচালক ডা: বাকির হোসেন জানান, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আসলাম খান সোমবার রাতে শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি হন এবং গতকাল ভোররাত সোয়া ৩টার দিকে মৃত্যুবরণ করেন। অপর দিকে সোহেল সোমবার রাতে শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গতকাল ভোররাত পৌনে ৪টার দিকে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি আরো জানান, উভয়রোগী ঢাকা থেকে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে শেবাচিমে ভর্তি হয়েছিলেন।

সূত্র মতে, গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শেবাচিম হাসপাতালে ২৪ জন রোগী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। আর এ পর্যন্ত শেবাচিম হাসপাতালে মোট ৬৩ জন রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসার মাধ্যমে ৩৭ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

খুলনা ব্যুরো জানায়, খুলনার হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। সরকারি পর্যায়ে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা জেনারেল (সদর) হাসপাতাল, বেসরকারি সিটি মেডিক্যাল, গাজী মেডিক্যাল ও ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। খুলনা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে জানা গেছে, সোমবার পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৭৩। এর মধ্যে দুই রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তবে রোগীদের বেশির ভাগই ঢাকা থেকে আক্রান্ত হয়ে এসেছেন বলে জানানো হয়। খুমেকে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড, পৃথক মেডিক্যাল টিম ও ডেঙ্গু সেল গঠন করা হয়েছে। মেডিক্যাল বোর্ড সদস্য মেডিক্যাল বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার পার্থ প্রতিম দেবনাথ জানান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রশিক্ষণ না থাকলেও খুলনা মেডিক্যালে সঠিকভাবে ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট করা হচ্ছে। প্রথমে জ্বর নিয়ে আসা রোগীদের ডেঙ্গু কীটের মাধ্যমে ফ্রি রোগ নির্ণয় করা হচ্ছে। এরপর ডেঙ্গুর স্তর অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সরকারি দু’টি হাসপাতালে ডেঙ্গু সন্দেহে ফ্রি পরীক্ষা করায় অনেকেই সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছে। বেসরকারি খুলনা সিটি মেডিক্যাল ও হাসপাতাল, গাজী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, আদ দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে।

ময়মনসিংহ অফিস জানায়, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ৬৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ২৫ জন। এরা সবাই ঢাকায় আক্রান্ত হয়ে ময়মনসিংহে আসার পর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা: লক্ষ্মী নারায়ণ মজুমদার জানান, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের অবস্থা এখন আগের চেয়েও ভালো। মেডিসিন বিভাগের পাঁচটি ওয়ার্ডে তাদেরকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার থেকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিনামূল্যে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ রক্ত পরীক্ষা শুরু হয়েছে। সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত হাসপাতালের আউটডোরে এবং বেলা ২টার পর হাসপাতালের ওয়ানস্টপ সার্ভিসে রক্ত পরীক্ষা সেবা প্রদান করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

মাদারীপুর সংবাদদাতা জানান, মাদারীপুর জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে নেই ডেঙ্গু জ্বর শনাক্ত করার যথাযথ ব্যবস্থা। রোগীদের অভিযোগÑ প্রাইভেট ক্লিনিক থেকে প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও সরকারি হাসপাতাল থেকে কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না তারা। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক বিরাজ করছে।

মাদারীপুর সদর হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ৭ দিনে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ডেঙ্গু জ¦রের জীবাণু নিয়ে ১৩ জন রোগী মাদারীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি হন। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় আরো তিনজন ভর্তি হয়েছে। তাদেরকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। পরে তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে।

বান্দরবান সংবাদদাতা জানায়, পার্বত্য জেলা বান্দরবানেও ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত তিনজন শনাক্ত হয়েছেন। তার মধ্যে বান্দরবান সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে একজনকে। অন্য দুইজন চট্টগ্রাম মেডিকল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সদর হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন ঢাকার নটরডেম কলেজের ছাত্র রেমিউচিং মারমা (১৬) অসুস্থতা নিয়ে বান্দরবানে আসার পর তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। তাকে দ্রুত সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়। অন্য দিকে শহরের বালাঘাটা এলাকার বিজয়ন তঞ্চঙ্গা ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর তাকে শহরের ইমানুয়েল হাসপাতাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।

বান্দরবান সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম জাহাঙ্গীর জানিয়েছেন শহরে ডেঙ্গু সচেতনতা নিয়ে মাইকিং করা হচ্ছে এবং এ পর্যন্ত তিনজন রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। জেলা প্রশাসক দাউদুল ইসলাম জানিয়েছেন ডেঙ্গু রোগ যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে পাশাপাশি ঢাকা থেকে আসা যাত্রীবাহী বাসগুলোতে মশা নিধনের স্প্রে ব্যবহারের জন্য বলা হয়েছে। এ দিকে বান্দরবান সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্ত করণের সরঞ্জাম ও পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় সমস্যায় পড়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

ফরিদপুর সংবাদদাতা জানান, ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে গত নয় দিনে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ৫০ জন রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। এসব রোগীদের বেশির ভাগই ঢাকা থেকে আক্রান্ত হয়ে ফরিদপুরে এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৪৭ জন। এদের মধ্যে অবস্থা গুরুতর হওয়ায় দুইজন রোগীকে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া গত দু’দিনে চারজন ডেঙ্গু জ্বরের রোগী চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

কলারোয়া (সাতক্ষীরা) সংবাদদাতা জানান, সাতক্ষীরার কলারোয়ায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ২ রোগী শনাক্ত হয়েছেন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, কলারোয়া পৌর সদরের গদখালি গ্রামের শফিকুল ইসলামের ছেলে শিবলি সাদিক (৩০) ও উপজেলার কেড়াগাছি ইউনিয়নের পাঁচপোতা গ্রামের সিরাজুলের মেয়ে সোনিয়া খাতুন (২৭) জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। রক্তের পরীক্ষাসহ অন্যান্য পরীক্ষা শেষে দেখা যায় দু’জনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। কলারোয়া হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) ডা: শফিকুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে সাংবাদিকদের জানান, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের আলাদা বেড, পর্যাপ্ত ঔষধ দিয়ে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামে জেলা জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার চালু করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, গত তিন দিনে আরিফুল হাসান, আব্দুল্লাহ আল মামুন, আলী আহমেদ, আমিনুল ইসলাম ও খাইরুল ইসলাম নামে ৫ জন ঢাকায় ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে কুড়িগ্রামে এসে হাসপাতালে ভর্তি হন।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: আবু মো: জাকিরুল ইসলাম জানান, আমরা ইতোমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য মেডিসিন ওয়ার্ডে ডেঙ্গু কর্নার চালু করেছি। আক্রান্ত রোগীদের মশারির ভেতর রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আরো রোগী এলেও কোনো সমস্যা হবে না বলেও তিনি জানান।

মৌলভীবাজার সংবাদদাতা জানান, মৌলভীবাজারে ডেঙ্গু জ্বর আক্রান্তরা হলেন, কাজিরগাঁও এলাকার সুমি চক্রবর্তী (২৩), কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর চা বাগানের রাজকুমার (১৮), মৌলভীবাজার শহরের সৈয়ারপুর এলাকার সালামা (২০), পিংকু পাল (২৭), মৌলভীবাজার সদর উপজেলার দক্ষিণ বাড়ন্তি গ্রামের লিজা বেগম (২১) ও মোকামবাজার গ্রামের শেখ মুজাহিদ (২৬)। মৌলভীবাজার পলিটেকনিক্যাল কলেজেরর ছাত্র রহমান আলী (২২), বিজিবি সদস্য সাজ্জাদ হোসেন (৩৯), মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ঘাগটিয়া গ্রামের বিপুল দাস (৩৭), আমতৈল গ্রামের মোমেন খান (২০), হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার দারাগাঁও গ্রামের আরিফ হোসেন (১৭)। মৌলভীবাজারের দক্ষিণ মুলাইম গ্রামের জাবেদ হোসেন (৩৫)।

নওগাঁ সংবাদদাতা জানান, নওগাঁ সদর জেনারেল হাসপাতালে গতকাল ৫ জনসহ গত চার দিনে ৯ ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে তিনজনকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। দুইজন নারী নওগাঁ শহরে তাদের নিজ বাসভবনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চারজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত ৯ রোগীর ৮জনই ঢাকায় এডিস মশার আক্রমণে জ্বর নিয়ে নওগাঁ আসেন। একজন নওগাঁতেই আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত জেলার ১০ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ নওগাঁ সদর জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার কোনো ডিভাইস না থাকায় শহরের বেসরকারি ২টি ক্লিনিকে ডেঙ্গু পরীক্ষা ও শনাক্ত করা হচ্ছে।
নওগাঁর প্রবীণ সাংবাদিক ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট শেখ আনোয়ার হোসেন বলেন, নওগাঁ হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় তিনি তার স্ত্রীর ডেঙ্গু পরীক্ষা শহরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে করিয়েছেন।
ডেঙ্গু পরীক্ষার ডিভাইস না না থাকার কথা স্বীকার করে নওগাঁ সদর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: রওশনআরা খানম বলেন, ডিভাইস আনতে ঢাকায় লোক পাঠানো হয়েছে। আগামী ঈদে ঢাকা থেকে আসা লোকজনের মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ারও শঙ্কা ব্যক্ত করেন। তিনি ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বাসগুলোতে এডিস মশা নিধনকারী স্প্রে করার পরামর্শ দেন।

নড়াইল সংবাদদাতা জানান, নড়াইলে দুই শিশুসহ চারজন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গতকাল দুপুরে দুই শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরা হলোÑ নড়াইল সদর উপজেলার মুলিয়া ইউনিয়নের ননীক্ষীর গ্রামের গৌরাঙ্গ বিশ্বাসের মেয়ে বিপাশা বিশ্বাস (৮) এবং লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া ইউনিয়নের তালবাড়িয়া গ্রামের রাকিবুলের ছেলে মেহেদি হাসান (৮)।

সদর হাসপাতালের আরএমও আ ফ ম মশিউর রহমান জানান, ওই দুই শিশু স্থানীয় ভাবে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া সোমবার বিকেলে ভর্তি হওয়া দু’জন ঢাকা থেকে আক্রান্ত হয়ে এখানে এসেছেন। ডেঙ্গু প্রতিরোধে একটি মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত আছে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষও খোলা হয়েছে।

মুকসুদপুর-গোপালগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, গোপালগঞ্জে প্রতিনিয়ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ১৪ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে জেলা সদরে সাতজন, মুকসুদপুরে চারজন এবং টুঙ্গিপাড়ায় তিনজন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। এ দিকে গোপালগঞ্জের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগ নির্ণয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। যে কারণে বাইরের ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে আক্রান্তদের।

ঝিনাইদহ সংবাদদাতা জানান, ঝিনাইদহে বাড়ছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৫ জন রোগী। এ পর্যন্ত হাসপাতালে মোট ২১ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।

হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা: মোকাররম হোসেন জানান, ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে এ পর্যন্ত যে সব রোগী ভর্তি হয়েছেন তার বেশির ভাগ ঢাকা থেকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/429431/