৩০ জুলাই ২০১৯, মঙ্গলবার, ১২:০৫

“নেই কাজ তো খই ভাজ”

তোফাজ্জল হোসেন কামাল : ‘মশা’ মারা বা নিবারণের সরকারি দফতরটির নাম ‘মশক নিবারণ দফতর’। রাজধানীর লালবাগে ৭০ বছর আগে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ঢাকার মশা নিবারণ-মারার জন্যই ওই দফতরটির প্রতিষ্ঠা। কিন্তু যে উদ্দেশে তার প্রতিষ্ঠা সে কাজ করছে না দফতরটি। জনবল যাইই আছে , তাদের কাজ বছরের পর বছর বসে বসে বেতন-ভাতা গোনা। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন যখন মশা মারতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন এই দফতর করে যাচ্ছে শুধুই প্রশাসনিক কাজ। দফতর সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য , মশা দমনের মূল লক্ষ্য নিয়ে এটি প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে এই দফতরের কাজে প্রাণচাঞ্চল্য থাকলেও বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে সুনসান নীরবতা। এখন শহরের মশা দমনের কাজে নয়, সিটি করপোরেশনের মশার ওষুধের খালি ড্রাম সংরক্ষণের গোডাউন হিসেবে ব্যবহার হয় এই দফতরটি। প্রবাদ বাক্যের মতো , ওই দফতরটির অবস্থা “ নেই কাজ তো খই ভাজ”।

লালবাগের ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে একটু সামনে এগুলেই হাতের ডান পাশে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়, লাল রঙে বড় করে লেখা ‘মশক নিবারণী দফতর’। মূল ফটকের গায়েও ছোট করে দফতরের নামের দুটি মনোগ্রাম দেখা যায়। ভেতরে প্রবেশ করেই চোখে পড়ে সারি সারি হাজার খানেক খালি ড্রাম। এর মধ্যে কিছু ড্রাম আবার রোদ বৃষ্টিতে মরিচা পড়েছে। এর ভেতরে এবং ফাঁকে ফাঁকে জমে আছে বৃষ্টির পানি এবং কিছু কিছু জায়গায় জন্মেছে আগাছা। প্রতিটি ড্রামের ধারণ ক্ষমতা ২০০ লিটার। দুই সিটি করপোরেশনের মশা মারার ওষুধের খালি ড্রাম এখানে রাখার কথা জানা গেলেও সরেজমিন দেখা যায় বেশিরভাগ ড্রামের গায়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি উল্লেখ করা।  

এই দফতরের সীমানার ভেতরেই দুইতলা বিল্ডিং রয়েছে। এই বিল্ডিংয়ের ভেতরে এই দফতরের প্রশাসনিক কার্যক্রম চলে। বিল্ডিংয়ের ভেতর নিচতলায় ঢাকা মশক নিবারণী দফতর সরকারি কর্মচারী সমিতির অফিস। সিঁড়ি বেয়ে দুই তলায় উঠতেই দেখা যায় কর্মচারীদের অফিস কক্ষ। এরকম কক্ষ আছে ১৭টি। এই অফিস চলে মূলত তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী দিয়েই। তবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এই দফতরে নিয়োজিত থাকেন। 

 খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৪৮ সালে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে মশক নিবারণী দফতরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে একজন সিভিল সার্জন সহকারী পরিচালক পদে এখানে দায়িত্ব পালন করতেন। ১৯৮০ সালের পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়া হয় এই দফতর। এরপর ১৯৯০ সাল থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে দফতরের মাঠকর্মী, কীট সংগ্রাহক ও পরিদর্শকেরা কাজ শুরু করেন।

দফতরের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই দফতরে ৩৪০ জনের মতো জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাদেরকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে নেওয়া হয় ১৯৭২ সালে। সেই মুহূর্তে মশা নিধন নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছিল। ১৯৮১-৮২ সালে এই বিভাগটিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসা হলেও তা কোনও এক অজানা কারণে সরাসরি ঢাকা সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে চলে আসে। সিটি করপোরেশন দুই ভাগ হয়ে যাওয়ার পর এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও ভাগ হয়ে যায় দুই সিটির ১০টি অঞ্চলে। এরপর প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্ব হারায় এবং শুধুমাত্র বসে বসে কর্মচারীদের বেতনভাতা, পেনশনের হিসাব করেই দিন যাচ্ছে। জনবলের দিক দিয়ে ২৮১ জন হলেও বর্তমানে মাত্র ১৩ জন অফিসে কাজ করেন এবং বাকিরা দুই সিটি করপোরেশনে ভাগ হয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন বলে জানান দফতরে থাকা কর্মচারীরা।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মচারী বলেন, এক সময় আমাদের কাজ ছিল মশা মারা। কিন্তু এখন আমরা শুধু ওষুধ সংরক্ষণ করি এবং দুই সিটির ১০টি অঞ্চলে বিতরণ করি। আমাদের যে জনবল ছিল তারা দুই সিটি করপোরেশনে ভাগ হয়ে কর্মী হিসেবে কাজ করছে। 

প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে থাকা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব আ ন ম ফয়জুল হক দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে ঢাকা মশক নিবারণী দফতর সরকারি কর্মচারী সমিতির সেক্রেটারি গিয়াসউদ্দিন জানান,  প্রতিষ্ঠার সময় ম্যালেরিয়া মোকাবিলা করতে ঢাকায় মশা মারার কাজ হাতে নেওয়া হয়েছিল। ম্যালেরিয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের মশা সব নিয়ে কাজ করতো প্রতিষ্ঠানটি। তখন সংস্থাটি বেশ জমজমাট ছিল। অনেক লোক কাজ করতেন। মশা নিয়ন্ত্রণে বেশ ভালো ভূমিকা পালন করতো এই প্রতিষ্ঠানটি।
তিনি আরও বলেন, কখন কীভাবে এই অবস্থা হলো জানা নেই। প্রতিষ্ঠানটির কাজই ছিল মশা নিধন করা। কিন্তু, এখন সেই ক্ষমতা নেই। আমরা শুধু ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্দেশনা অনুযায়ী মশা মারার ওষুধ বিভিন্ন জোনে বিতরণ করি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাছেই ব্যস্ত সড়কের পাশের এই অফিসের ভবনটিতে মানুষের যাতায়াত নেই বললেই চলে। প্রবেশের গেটটিও বেশির ভাগ সময় থাকে বন্ধ। যদিও এই অফিসের অধীনে কাজ করেন ২৮১ জন কর্মী। দোতলা ভবনটি নির্মিত হয়েছে ২০১০ সালে। এর আগ পর্যন্ত টিনশেড অফিস ছিল বলে জানান দফতরের এক কর্মচারী। তিনি বলেন,‘দফতরটি অনেক পুরনো। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি দোচালা টিনের ঘর ছিল। ২০১০ সালে পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়।’ দফতরের সীমানা প্রাচীরের ভেতরে চোখে পড়ে প্রচুর খালি ড্রাম। এসব ড্রামে মশা মারার ওষুধ থাকে । ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা মারার জন্য যে ওষুধ কেনে, সেগুলো এখানে মজুদ রাখা হয়। ওষুধের ব্যবহার শেষে ড্রামগুলোও এখানে রাখা হয়। তারাই পরে খালি ড্রামগুলো সরিয়ে নেয়।’

মশক নিবারণী দফতর নাম হলেও এ অফিসের লোকজন নিজেরা এখন আর মশা নিবারণের কাজ করেন না। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীনে মশা নিবারণের কাজ করেন। এমনকি মশা নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটির নেই কোনও গবেষণা কার্যকর্ম, নেই মশা মারার কোনও যন্ত্র। দফতরটির বেশির ভাগ কর্মীই কাজ করেন দুই সিটি করপোরেশনের অধীনে।

মশক নিবারণী দফতর সূত্রে জানা গেছে, এই অফিসের জনবল কাঠামো অনুসারে ৩৯৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার কথা। তবে বর্তমানে প্রায় ১০৫টি পদ শূন্য রয়েছে। দফতরের ২৮১ জন কর্মী ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে কাজ করছেন। এই ২৮১ জনের মধ্যে ক্রু আছেন ২৬৭ জন,যারা সিটি করপোরেশনের মশা ছিটানোর স্প্রে মেশিন পরিচালনা করেন। ক্রুদের তদারকির জন্য রয়েছেন ১০ জন সুপারভাইজার। দুই করপোরেশনের ১০টি অঞ্চলে কাজ করেন তারা। এছাড়াও রয়েছেন কয়েকজন ইনসেক্ট কালেক্টর (আইসি)। তবে সিটি করপোরেশনের অধীনে কাজ করলেও কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে এই দফতর।

বিভিন্ন সময়ে ঢাকা মশক নিবারণী দফতরটি বিলুপ্তির প্রস্তাব উঠেছিল বলে জানান এখানকার লোকজন। তারা  বলেন, ‘ঢাকা মশক নিবারণী দফতরটি এখন আর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মশা নিবারণ করে না। সিটি করপোরেশনের অধীনে আমাদের কর্মীরা কাজ করেন। আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সবাই রাজস্ব খাতভুক্ত। দফতরটি বিলুপ্ত হলে তাদের ভবিষৎ কী হবে, এত কর্মী মন্ত্রণালয়ের সংযুক্ত করার প্রয়োজন আছে কিনা এসব বিষয় ভাবা হচ্ছে।’তারা বলেন, ‘এক সময় এখানে মশা নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার প্রস্তাব উঠেছিল, পরে তার আর বাস্তবায়ন হয়নি। এখন সিটি করপোরেশনকে আমরা সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সিটি করপোরেশনের আওতা ও ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও বাড়েনি মশক নিবারণী দপ্তরের লোকবল ও কাজের পরিধি। সিটি করপোরেশনের (তখন পৌরসভা ছিল) অধীনে এতটা বছর কাজ করায় দপ্তরটি মশা নিধনের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। অস্থায়ী ভিত্তিতে ও প্রেষেণে প্রধান কর্মকর্তা নিয়োগ হওয়ায় দপ্তরটিকে কর্মমুখী করতে উদ্যোগ নেয়নি কেউ। দপ্তরের পুরনো কর্মীরা বলছেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানটি কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে এর কার্যক্রমই নেই। 
সিটি করপোরেশনের পেটে

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৪৮ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে মশক নিবারণী দপ্তরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮১ সালের শেষ দিকে তা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হয়। সেই থেকে প্রথমে পৌরসভা এবং পরে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে রাজধানীর মশা নিধনে কাজ করে যাচ্ছে দপ্তরটি। প্রথমে ৩৯৬ কর্মকর্তা-কর্মীর একটি কাঠামো করে দপ্তরটিকে অধিদপ্তরে পরিণত করে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন হয়নি। 

সূত্র জানায়, প্রথমে দপ্তরের প্রধান পদটি পরিচালক ছিল। পরে সহকারী পরিচালক করা হয়। এই পদে পঞ্চম গ্রেডের একজন চিকিৎসকের দায়িত্বে থাকার কথা। কিন্তু এখন একজন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব  ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্বে আছেন।

বহু বছর ধরে চাকরি করেন, এমন এক কর্মী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আগে থেকেই মশক নিবারণী দপ্তরকে অন্য প্রতিষ্ঠানে পেটে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়েও আমরা এখন আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে! বসে বসে বেতন নেব-এমন চিন্তা থেকে কেউ কথা বলেনি। সিটি করপোরেশন কোড অনুযায়ী যে সাহায্য মঞ্জুরি খাত থেকে টাকা পায়, আমরাও সেখান থেকে পাই। ফলে সিটি করপোরেশন নিজেদের স্বার্থে এই দপ্তর ব্যবহার করছে।’
সম্পদও দখল হয়ে গেছে

ঢাকেশ্বরী মন্দির সংলগ্ন ১০ ঢাকেশ্বরী ১.৩৯ একর জমির মশক নিবারণী দপ্তরের জায়গার অনেকটাই বেদখল হয়ে গেছে। কর্মীরা জানান, দপ্তরের জায়গায় ফায়ার সার্ভিস ও ঢাকা ওয়াসার স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় লোকজন ওরিয়ন্টন ক্লাব নামে একটি সংগঠনের ব্যানারেও কিছু জায়গা দখল করেছে। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী সংস্থার জায়গা দখল করে গ্যারেজ ও কারখানা গড়ে তুলেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। অথচ দখল হওয়া জমির খাজনাও মেটায় মশক নিবারণী দপ্তর।

https://www.dailysangram.com/post/384647