মুগদা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের ভিড় নয়া দিগন্ত
২৯ জুলাই ২০১৯, সোমবার, ১২:১২

ডেঙ্গু ছড়িয়েছে সারা দেশে

ঘণ্টায় ৩৪ জনের বেশি আক্রান্ত : ঢাকাতেই ১০ হাজার, ঝালকাঠিতে শিক্ষিকার মৃত্যু

ডেঙ্গুর সব রেকর্ড ভঙ্গ হলো গতকাল রোববার। দেশে প্রতি ঘণ্টায় ৩৪ জনের বেশি লোক ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছে। ডেঙ্গু রোগী ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে আক্রান্তরা ভর্তি রয়েছেন। ঢাকার বাইরে ইতোমধ্যে কয়েকজন মারাও গেছেন। ২০০০ সাল থেকে ব্যাপক ভিত্তিতে ডেঙ্গুর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে গতকালই একদিনে ৮২৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এই ৮২৪ জনসহ চলতি বছর মোট ১১ হাজার ৬৫৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গতকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন দুই হাজার ৯২১ জন। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেন আট হাজার ৭২৫ জন। ২০০০ সালে ডেঙ্গুর প্রকাশ শুরুর পর থেকে গত বছর সর্বোচ্চ ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্ত হয়েছিল। সরকারি তথ্য অনুসারে, গত বছর মারা গেছে ২৬ জন। কিন্তু ২০০০ সালে প্রথম ব্যাপক ভিত্তিতে ডেঙ্গু শুরু হওয়ায় মারা যায় সর্বোচ্চ ৯৩ জন। তখন অধিকাংশ চিকিৎসকের কাছে ডেঙ্গু ভাইরাসের নামটাই অপরিচিত ছিল এবং তারা জানতেন না কিভাবে চিকিৎসা দিতে হয়।

গবেষকরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গু সন্দেহ নিয়ে যেসব পরীক্ষা করা হচ্ছে এর এক-তৃতীয়াংশই ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে ল্যাবরেটরি টেস্টে প্রমাণিত। গতকাল রোববার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা: সাইফ উল্লাহ মুন্সি জানিয়েছেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত ২৫ জুলাই পর্যন্ত এখানকার ভাইরোলজি বিভাগে মোট তিন হাজার ৫৭০ জন রক্ত পরীক্ষা করান ডেঙ্গু সন্দেহে। এদের মধ্যে পরীক্ষায় এক হাজার ১৬৭ জন ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই এক হাজার ১৬৭ জনের মধ্যে এনএস-১ পজিটিভ পুরুষ ৭০৭ জন এবং এনএস-১ পজিটিভ মহিলা ছিল ২৬০ জন। দেখা যাচ্ছে মহিলাদের চেয়ে ডেঙ্গু ভাইরাসে পুরুষের সংখ্যা বেশি। আবার আইজি-এম পজিটিভ পুরুষ ও মহিলার সংখ্যা ছিল ২০০ জন।

গতকাল দুপুর পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই ১৯৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। মিটফোর্ডে ৭২ জন, শিশু হাসপাতালে ২৬, হলিফ্যামিলি হাসপাতালে ৩৭, শহীদ সোহরাওয়ার্দীতে ৩২, বারডেমে ১৭, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ জন, পুলিশ হাসপাতালে ২১, মুগদা হাসপাতালে ৬৭, বিজিবি হাসপাতালে ৬, কুর্মিটোলা হাসপাতালে ৩২ জন অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালে ১৬৮ জন। অবশিষ্ট ১৪১ জন ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ঝালকাঠির রাজাপুরে গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত এক স্কুলশিক্ষিকা মারা গেছেন। বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে ৫৬ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চিকিৎসকসহ ১৫ জন নতুন করে ভর্তি হয়েছেন। কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৫ জন ভর্তি রয়েছেন। বরগুনার হাসপাতালে ১০ জনকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। যশোর জেনারেল হাসপাতালে গতকাল ২২ রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ১৯ জন। কক্সবাজারে গত ১৩ দিনে অন্তত ১৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি জাবির এক শিক্ষার্থীকে শনিবার চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি মারা যান। নীলফামারী সদর হাসপাতালে এখন দুই রোগী ভর্তি আছেন।

অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সি আরো জানান, আমাদের ল্যাবরেটরিতে মোট এক হাজার ৭৪১ জনের আইজি-এম টেস্ট করা হয়েছিল। এই সংখ্যক মানুষের মধ্যে ২০০ জন আইজি-এম পজিটিভ পাওয়া গেছে। তিনি জানান, ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার পাঁচ দিন পর কেউ আসলে তাদের এনএস-১ না করে আইজি-এম টেস্ট করানো হয়। তিনি জানান, ডেঙ্গু চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধটা খুবই সহজ। প্রতিরোধ করতে পারলে এমন ব্যাপক ভিত্তিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হতো না মানুষ। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন হয়তো ঘরে-বাইরে মশার ওষুধ ছিটিয়ে যেতে পারবে কিন্তু ঘরের মশা তারা মারতে পারবে না। ঘরের মশামুক্ত পরিবেশ নাগরিকদেরই নিশ্চিত করতে হবে। অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সি জানান, ডেঙ্গু মশার জন্য আদর্শ সময় এটাই। এ সময় পরিবেশের তাপমাত্রা ৮০ থেকে ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত থাকে। এ তাপমাত্রায় এডিস মশার ডিম থেকে লার্ভা ফুটতে সহজ হয়। আবার এই পরিমাণ তাপমাত্রায় পরিবেশে আর্দ্রতা সৃষ্টি হয়। এডিস মশার ডিম ফোটার জন্য আর্দ্রতাও প্রয়োজন।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মাহবুবুর রহমান নামের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, চলতি বছর এত বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক কম। তিনি বলেন, রোগীরা আরেকটু বেশি চিকিৎসকদের সহযোগিতা করলে এই আটজনের মৃত্যুটাও ঠেকানো যেতো। তারা যদি দেরি না করে সময় মতো হাসপাতালে চলে আসতে পারতেন তাহলে ওই মূল্যবান জীবনগুলোও রক্ষা করা যেতে পারত।
ঢাকাতে ১০ হাজার মানুষ আক্রান্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক মন্তব্য করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। তবে এর মধ্যে সাত থেকে আট হাজার ডেঙ্গু রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। গতকাল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল পরিদর্শনকালে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মেয়র এ কথা বলেন। মেয়র বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। দিন যাচ্ছে একটু একটু করে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রতিদিনই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সরকারের সব সংস্থার সমন্বয়ে ও সিটি করপোরেশনসহ সবাই এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, নাগরিকরা যেন ভেঙে না পড়েন, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে না পড়েন, আশাহত হয়ে না পড়েন সেজন্য আমরা বলতে চাই আমাদের যে চিকিৎসক রয়েছেন, যে হাসপাতালগুলো রয়েছে, তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন রোগীদের সারিয়ে তোলার জন্য। তিনি বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন চলতি সপ্তাহ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে অ্যারোসল স্প্রে বিতরণ করবে।

শিগগিরই ডেঙ্গু থেকে মুক্তি : স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, এডিস মশা নিধনে সরকারের সব সংস্থাসহ দুই সিটি করপোরেশন ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে-ময়দানে কাজ করছে। শিগগিরই ভয়াবহ এডিস মশা থেকে পরিত্রাণ পাবো। গতকাল রাজধানীর আজিমপুর দক্ষিণ কলোনি মাঠে মশক নিধন কর্মসূচি উদ্বোধনের সময় তিনি এ কথা বলেন। এ সময় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন ও যারা আক্রান্ত তাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এডিস মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ে ভয়ের বা আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। এডিস মশা শুধু আমাদের দেশেই নয় ভারত, থাইল্যান্ড, সিংঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশেই এ সময় প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। মন্ত্রী বলেন, সাধারণত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত এর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। সেপ্টেম্বর মাস থেকে এমনিতেই কমে আসবে।

সিটি করপোরেশনে যার ওয়ার্ড যতবেশি পরিচ্ছন্ন ও এডিস মশামুক্ত থাকবে তাদের পুরস্কৃত করা হবে। এ জন্য আমরা বিভিন্ন ওয়ার্ডে কর্মকর্তা দিয়ে পরীক্ষা করে সেরা ওয়ার্ড ও কমিশনার নির্বাচন করব। ঢাকার মধ্যে ডেঙ্গুমুুক্ত ওয়ার্ডগুলোকে পুরস্কার দেয়া হবে। ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় সচিব হেলাল উদ্দিন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলহাজ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির, মোহাম্মদ সেলিম, হাজী তারিকুল ইসলাম সজিব, মোকাদ্দেস হোসেন জাহিদ, হাজী মো: দেলোয়ার হোসেন, আলহাজ হাসিবুর রহমান মানিক প্রমুখ।

ডিএনসিসি : আগামী সপ্তাহ থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সব মশক নিধনকর্মী ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন মেয়র মো: আতিকুল ইসলাম। গতকাল আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশে (এআইইউবি) আয়োজিত এক সেমিনারের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ কথা জানান। মেয়র বলেন, ইতোমধ্যে ডিএনসিসির অঞ্চল-১ থেকে অঞ্চল-৫ পর্যন্ত সব এলাকার মশক নিধনকর্মী, মশক সুপারভাইজার ও মনিটরিং কর্মকর্তাদের নাম ও মোবাইল নম্বর ডিএনসিসির ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। মেয়র নগরবাসীকে নিজ নিজ এলাকার মশক নিধনকর্মী, মশক সুপারভাইজার ও মনিটরিং কর্মকর্তার নাম ও মোবাইল নম্বর জেনে নিয়ে জবাবদিহিতার আওতায় আনার আহ্বান জানান। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ডা: জিন্নাত আলী, এআইইউবির ভিসি ড. কারমেন জেড লামাগনা উপস্থিত ছিলেন।
পরীক্ষার ফি নির্ধারণ : ডেঙ্গু পরীক্ষার হার নির্ধারণ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এখন থেকে ৫০০ টাকার মধ্যেই পরীক্ষা করা যাবে। কোনো পরীক্ষাই ৫০০ টাকার বেশি নিতে পারবে না। গতকাল রোববার স্বাস্থ্য অধিদফতরে ডেঙ্গু রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সংক্রান্ত জরুরি সভায় রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের স্বাস্থ্য অধিদফতরের বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সম্মেলন কক্ষে মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে আরো উপস্থিত ছিলেন অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা।

সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, এনএস১ পরীক্ষার জন্য লাগবে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। এর আগে এ পরীক্ষাটি করতে লাগত ১২০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা। আইজিএম ও আইজিই টেস্ট করতেও সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা নেবে। সিবিসি টেস্ট করতেও হাসপাতালগুলোকে নিতে হবে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। বেসরকারি হাসপাতালে এ পরীক্ষাটি করতে এতদিন নেয়া হয়েছিল এক হাজার টাকা। সিবিসির মধ্যে থাকবে আরবিসি, ডব্লিউবিসি, প্লাটিলেট ও হেমাটোক্রিট। এই মূল্য গতকাল রোববার থেকে কার্যকর হয়েছে।

ডেঙ্গু রোগীর জন্য সব প্রাইভেট হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একটি ওয়ান স্টপ সেন্টার চালু করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ডেঙ্গুর জন্য সব হাসপাতালেই বেডের সংখ্যা বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ।

রাজাপুরে শিক্ষিকার মৃত্যু : রাজাপুর (ঝালকাঠি) সংবাদদাতা জানান, ঢাকায় বেড়াতে গিয়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে এসে নিগার সুলতানা (৩৫) নামে এক কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষিকার মৃত্যু হয়েছে। নিগার সুলতানার গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির রাজাপুরের দক্ষিণ তারাবুনিয়া গ্রামে। নিগার ন্যাশনাল সার্ভিসের কর্মী হিসেবে রাজাপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে কর্মরত ছিলেন এবং ওই গ্রামের স্থানীয় একটি কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষাকতা করতেন। নিগার সুলতানার মামাতো ভাই ব্যবসায়ী মামুন জানান, ঢাকায় এক আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন নিগার। গত শুক্রবার সকালে বাড়িতে এলে জ¦র জ¦র অনুভব করলে পরের দিন শনিবার তাকে পাশের উপজেলা ভাণ্ডারিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোববার বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন। বরিশাল নেয়ার পথে নিগার সুলতানা অচেতন হয়ে যান এবং বরিশাল শেবাচিমে নিলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

বগুড়ায় ৫৬ ডেঙ্গু রোগী : বগুড়া অফিস জানায়, বগুড়ার হাসপাতালে প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বৃদ্ধির খবরে মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। গত ৪ জুলাই থেকে গতকাল রোববার দুপুর পর্যন্ত মোট ৫৬ জন ডেঙ্গু রোগী শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে গত দুই দিনে ছয়জন রোগী ছাড়পত্র নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। শনিবার দুপুর থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত ডাক্তার, সাংবদিকসহ ১৫ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। শজিমেক হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর জন্য একটি আলাদা ওয়ার্ড চালু করেছে এবং ১০ সদস্যের মেডিক্যাল টিম গঠন করেছে।

শজিমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ছয়জন নারীসহ ১৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে বর্তমানে ৩৬ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের চিকিৎসার জন্য মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার হালিমুর রশিদের নেতৃত্বে ১০ জন সদস্যের মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। বহির্বিভাগের সামনে হেল্প ডেস্ক খোলা হয়েছে।

শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাক্তার মো: আরিফুর রহমান তালুকদার জানান, ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তদের প্রথম ধাপে চিকিৎসা দেয়া হলেও দ্বিতীয় ধাপের চিকিৎসার কোনো সরঞ্জাম নেই। বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে জানানো হয়েছে। রোগীদের জাতীয় গাইড লাইন মোতাবেক চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

এ ছাড়া শহরের শামছুন্নাহার ক্লিনিকে চারজনসহ প্রাইভেট বিভিন্ন ক্লিনিকে আটজন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানান জেলা সিভিল সার্জন ডাক্তার গওসুল আজিম চৌধুরী।

কুষ্টিয়া মেডিক্যালে ১৫ জন : কুষ্টিয়া সংবাদদাতা জানান, কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত ১৫ জন ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত রোগী ঢাকা থেকে এসে ভর্তি হয়েছেন। আক্রান্ত রোগী ও তাদের স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা য়ায়, ঢাকা থাকাকালে তারা তিন-চার দিন আগে ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না নিতে পারায় বাধ্য হয়ে তারা কুষ্টিয়া হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কর্তব্যরত চিকিৎসক ও সেবিকাদের সাথে কথা বলে জানা যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সবাই শঙ্কা মুক্ত আছেন। কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যবিশিষ্ট মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার তাপস কুমার পাল জানান, বর্তমান আক্রান্ত অবস্থায় ভর্তি আছে রেবেকা খাতুন (২৬), সুস্মিতা খাতুন (২৮), লুৎফর নাহার (৩৫), তানভীর (২৮), আরজিনা (২৬), রাসেল (২৫), ফয়সাল (৩০), সেলিম (৩০), মুন্নু (২৭), জীবন (২৫), রাশিদুল (৩৫), প্রতাপ (২৫) ছাড়াও আট মাস বয়সী যমজ দুই ভাই আবিব ও সাঈদ রয়েছে। তাদের অধিকাংশই ঢাকায় বসবাসকারী কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ জেলার অধিবাসী। কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়র আনোয়ার আলী জানান- কুষ্টিয়াবাসীর অহেতুক আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই। ইতোমধ্যে কুষ্টিয়া পৌরসভা সব এলাকায় মশক নিধনের কার্যক্রম শুরু করেছে।

বরগুনায় ১০ রোগী শনাক্ত : বরগুনা সংবাদদাতা জানান, বরগুনায় ১০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শনাক্ত করা হয়েছে। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের ডেঙ্গু আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করেন। আক্রান্তদের মধ্যে চারজন বর্তমানে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। জানা গেছে, ৮ জুন বরগুনার ক্রোক এলাকার সাদেক, ২২ জুন পিটিআই এলাকার সাইফুল্লাহ এবং ২৩ জুন হেউলিবুনিয়া এলাকার রাব্বি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাদের ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়া বিষয়টি নিশ্চিত করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। কিন্তু চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের অবস্থার অবনতি হওয়ায় ১০ জুন সাদেককে এবং ২৪ জুন সাইফুল্লাহ ও রাব্বিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নাইম বলেন, তিনি ঢাকায় থাকেন। কয়েক দিন হলো বাড়িতে এসেছেন। বাড়িতে আসার পর তিনি জ্বরে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। এরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসকরা তাকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানান। বর্তমানে তিনি এই হাসপাতালেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

যশোরে ২২ জন হাসপাতালে : যশোর অফিস জানায়, গত ১০ দিনে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ৩১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে গতকাল পর্যন্ত ২২ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ পর্যন্ত ছাড়পত্র নিয়েছেন ৯ জন। প্রতিদিন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হওয়ায় যশোরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের তথ্য মতে, গত ১০ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৩১ জন। গতকাল নতুন করে ভর্তি হন আটজন এবং আজ ভর্তি হয়েছেন দুইজন। এ পর্যন্ত মোট ৯ জন চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন।

মানিকগঞ্জে আক্রান্ত ১৯ : মানিকগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, মানিকগঞ্জে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। গত সাত দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ১৯ জন। এর মধ্যে থেকে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন দুইজন। আর উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে দুইজনকে। বাকি ১৫ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। মানিকগঞ্জের সাতটি উপজেলার মধ্যে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

কক্সবাজারে ১৩ জন শনাক্ত : কক্সবাজার সংবাদদাতা জানান, কক্সবাজারে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন শহরের মেধাবী ছাত্রী উ খিং নু রাখাইন ওরফে নুশাং। কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে গত শনিবার বিকেল পাঁচটার দিকে তিনি মারা যান। নুশাং রাখাইন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের (৪৮তম ব্যাচ) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। কক্সবাজার শহরের এন্ডারসন সড়কে তার বাড়ি। কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাক্তার মোহাম্মদ শাহ জাহান জানান, ১৫ জুলাই থেকে কক্সবাজার শহরে ১৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। তাদের জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। তবে রোববার পর্যন্ত তিনজন জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি আছেন। জরুরি বিভাগের এক চিকিৎসক না প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখন প্রতিদিন এক দুইজন করে জ্বর নিয়ে আসছেন, যাদের ডেঙ্গু হিসেবে শনাক্ত করা হচ্ছে।

নীলফামারীতে ২ জন হাসপাতালে : নীলফামারী সংবাদদাতা জানান, পরিতোষ চন্দ্র (২৮) ও আব্দুর রহিম (২৪) নামে দুই ব্যক্তি ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে নীলফামারী আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। পরিতোষ চন্দ্রের বাড়ি নীলফামারী সদর উপজেলার চড়াইখোলা ইউনিয়নের পশ্চিম কুচিয়ার মোড় গ্রামে এবং আব্দুর রহিমের বাড়ি একই উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে। তারা দুইজনই ঢাকা থেকে জ্বর নিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরেন বলে পরিবারের লোকজন জানান।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/428896/