২৮ জুলাই ২০১৯, রবিবার, ৩:৩৩

শুভঙ্করের ফাঁকি রফতানি আয়ে

পোশাক খাতে ব্যাক টু ব্যাক এলসিতে ৮০ শতাংশ খরচ বাদ দেয়া হয় না * ইপিবি যে রফতানি আয় প্রকাশ করে তা প্রকৃত আয়ের তুলনায় অনেক বেশি

পোশাক খাতে রফতানি আয়ের সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে কাঁচামাল আমদানির পেছনে। এ আমদানি ব্যয় ব্যাক টু ব্যাক এলসি নামে পরিচিত। এছাড়া আরও কয়েকটি খাত রয়েছে যেখানে রফতানি আয়ের একটি অংশ চলে যাচ্ছে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানির পেছনে। কিন্তু রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রতি বছর রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের যে তথ্য প্রকাশ করছে, তা থেকে ব্যাক টু ব্যাক এলসি ও কাঁচামাল আমদানি ব্যয় বাদ দেয়া হয় না। এটি বাদ দেয়া হলে প্রকৃত রফতানি আয়ের পরিমাণ আরও কম হবে।

এক হিসাবে দেখা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরে ওভেন ও নিট খাতে প্রকৃত রফতানি আয় হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ইপিবি দাবি করেছে ২ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবতা হল, ব্যাক টু ব্যাক এলসির প্রায় ১ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা বাদ দেয়া হয়নি। এদিকে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, প্রকৃত রফতানি আয়ের তথ্য বের করতে হলে অবশ্যই ব্যাক টু ব্যাক এলসির খরচ বাদ দিতে হবে। ইপিবি সেটি না করলে রফতানি আয়ের তথ্যে গোজামিল থেকে যাবে।

এছাড়া তারা মনে করেন, এ সংকট থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। এজন্য স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল উৎপাদনের ওপর জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান অবস্থায় কাঁচামাল উৎপাদনে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান কোনোদিন চীন ও ভারতের কাঁচামালের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ব্যবসা করতে পারবে না। তাই পোশাক শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করতে হলে সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারকে ন্যূনপক্ষে ১০ শতাংশ প্রণোদনা সহায়তা দিতে হবে।

একই সঙ্গে ওভেনের ব্যাক টু ব্যাক এলসিতে দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহারে সিলিং বেঁধে দিতে হবে। যা প্রাথমিকভাবে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ হতে হবে। অর্থাৎ রফতানিমুখী কোনো পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে কাঁচামাল আমদানির মোট চাহিদার এ পরিমাণ অবশ্যই স্থানীয়ভাবে কিনতে হবে। সেটি প্রাথমিক পর্যায়ে এ হারে হলেও সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সিলিং বাড়াতে হবে। বিশ্লেষকদের মতে, এভাবে সিলিং বেঁধে দিতে না পারলে এবং সুতা ও বস্ত্রকলের জন্য নগদ সহায়তার পরিমাণ না বাড়ালে আমাদের এ সেক্টর কোনোদিন সামনে এগোতে পারবে না।

পৃথিবীর যেসব দেশ ইতিমধ্যে পোশাক শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছে তার পেছনে রাষ্ট্রের এমন উদ্যোগ বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তারা যুক্তি দেখিয়ে আরও বলেন, কেননা সুতা কিংবা বস্ত্রকলের একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান করতে হলে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭শ’ কোটি বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু উদ্যোক্তা যদি সরকারের তরফ থেকে এ ধরনের অর্থ ও নীতি সহায়তার নিশ্চয়তা না পায় তাহলে কেন বিনিয়োগ করবে? সঙ্গত কারণে কাঁচামালের সক্ষমতার প্রশ্নে সরকারকে অবশ্যই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতেই হবে। এটি বাস্তবায়ন করলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে বড় ধরনের বিল্পব ঘটতে বাধ্য।

ইপিবির তথ্যমতে, বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে মোট রফতানি আয় হয়েছে ৪ হাজার ৫৪ কোটি মার্কিন ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ৩ লাখ ৪২ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে পোশাক খাতে রফতানি আয় দেখানো হয় ৩ হাজার ৪১৩ কোটি মার্কিন ডলার বা ২ লাখ ৮৮ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা (২৫ জুলাইয়ের রেট অনুযায়ী ১ ডলার = ৮৪.৪৯ টাকা ধরে)। এ খাতের ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা যুগান্তরকে জানান, পোশাক খাতে ইপিবির দেয়া রফতানির এ হিসাব সঠিক নয়। কেননা, তারা ব্যাক টু ব্যাক এলসি বা কাঁচামাল আমদানির হিসাব বাদ দেয় না। আর বাস্তবে পোশাক খাতের জন্য বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়।

বিশেষ করে ওভেনে আমদানির পরিমাণ ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া নিট খাতে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। এখন বিদায়ী অর্থবছরে ইপিবি বলছে, ওভেনে রফতানি আয় হয়েছে ১৭২৪ কোটি মার্কিন ডলার বা ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। এর থেকে ব্যাক টু ব্যাক এলসি বাবদ ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১ লাখ ১৬ হাজার ৫২৮ কোটি টাকার কাঁচামাল কেনার খরচ বাবদ বাদ দিতে হবে। এটি বাদ দিলে বিদায়ী অর্থবছরে ওভেনে প্রকৃত রফতানি আয় দাঁড়াবে ২৯ হাজার ১৩২ কোটি টাকা।

অপরদিকে নিট খাতে ইপিবি রফতানি আয় দেখিয়েছে ১৬৮৯ কোটি মার্কিন ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ১ লাখ ৪২ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। এর থেকে ৩০ শতাংশ ব্যাক টু ব্যাক এলসি ব্যয় অর্থাৎ ৪২ হাজার ৮১১ কোটি টাকা বাদ যাবে। এ হিসাবে নিট খাতে গত অর্থবছরে প্রকৃত রফতানি আয় হবে ৯৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। এখন ওভেন ও নিট খাত মিলে প্রকৃত রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৯ হাজার ২৫ কোটি টাকা। অথচ ইপিবি দাবি করেছে, এ দুই খাত মিলে গত অর্থবছরে পোশাক খাতে রফতানি আয় হয়েছে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা।

কিন্তু ১ লাখ ৫৯ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকার ব্যাক টু ব্যাক এলসি বা কাঁচামাল আমদানি হিসাব ইপিবি বাদ দেয়নি। এছাড়া আরও যেসব খাত থেকে রফতানি করা হয় সেসব খাতেও কম-বেশি কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। সেটি বাদ দিলে প্রকৃত রফতানি আয়ের পরিমাণ আরও কমবে। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এভাবে প্রতি অর্থবছরে ইপিবির দাবিকৃত রফতানি আয় থেকে ব্যাক টু ব্যাক এলসির খরচ বাদ দেয়া হলে বিগত দিনের প্রতিটি অর্থবছরে প্রকৃত রফতানি আয়ের পরিমাণ আরও কম হতো।

এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি যুগান্তরকে বলেন, পোশাক খাতের জন্য এখনও আমাদের বিদেশ থেকে কাপড়, সুতা ও তুলাসহ বেশ কিছু কাঁচামাল আমদানি করতে হচ্ছে। তবে সরকার এ ব্যাক টু ব্যাক এলসি কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এ জন্য দেশীয়ভাবে আরও টেক্সটাইল মিল গড়ে তুলতে হবে। স্থানীয়ভাবে এসব উৎপাদন বাড়াতে পারলে ব্যাক টু ব্যাক এলসির পরিমাণ কমে আসবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশন (ইএবি) এবং বিকেএমইর সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি মো. হাতেম যুগান্তরকে বলেন, পোশাক খাতে ওভেন গার্মেন্টেসে রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশ ও নিটওয়্যারে ৩০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হচ্ছে ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে কাঁচামাল আমদানি করতে। ফলে মোট রফতানি আয় থেকে ব্যাক টু ব্যাক এলসি বাদ দেয়ার পর প্রকৃত রফতানি আয়ের পরিমাণ অনেক কম হবে। তিনি বলেন, ওভেনের জন্য কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে কেনার শর্ত জুড়ে দিতে হবে।

সরকারের তরফ থেকে এমন বাধ্যবাধকতা থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি টেক্সটাইল খাতের জন্য ন্যূনপক্ষে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দিতে হবে। তাহলে অনেকে এ খাতে শিল্প গড়ে তুলতে আগ্রহী হবে। এরফলে পোশাক শিল্পের জন্য আমাদের শুধু দর্জিগিরি করতে হবে না। আমরা পর্যায়ক্রমে স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারব।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রফতানি আয়ের অন্যতম খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার নেয়ার পর পণ্য তৈরি করতে ৮০ শতাংশই চলে যায় বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কাঁচামাল আনতে। এ বিবেচনায় প্রকৃত পক্ষে হিসাব করলে পোশাক রফতানিকারকরা মূলত দর্জির ভূমিকা পালন করছেন। কিন্তু এর থেকে বেরিয়ে এসে স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল উৎপাদন করতে না পারলে গৌরবের এ সেক্টর নিয়ে বেশি দূর যাওয়া যাবে না।

তারা বলেন, এজন্য সরকারকে ইতিবাচক পলিসি গ্রহণসহ গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের নীতি সহায়তা দিতে হবে। বিশেষ করে যারা স্থানীয়ভাবে পোশাক খাতের কাঁচামাল উৎপাদন করছেন তারা যেন সুলভ মূল্যে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারেন। সেজন্য সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন- সুতা ও কাপড়। কেননা, এখানে চোরাই পথে কিংবা বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে বিদেশি ও সুতা কাপড় ঢুকে পড়ছে। এটি অব্যাহত থাকলে পোশাক খাতের কাঁচামাল উৎপাদনকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।

তারা মনে করেন, এর থেকে বের হয়ে আসতে হলে পোশাক রফতানির কাঁচামাল দেশীয়ভাবে উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিশেষ করে তুলা ও সুতার উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে। আর এর দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। পাশাপাশি দেশীয় শিল্প সুরক্ষার স্বার্থে সুতা ও কাপড়ের কালোবাজার বন্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এভাবে আমাদের পোশাক খাতের সব ধরনের কাঁচামাল উৎপাদনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শক্ত ভিত গড়ে তুলতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম যুগান্তরকে বলেন, মোট রফতানি থেকে ব্যাক টু ব্যাক এলসি বাদ দিলে প্রকৃত রফতানি হিসাব কিছুটা কমবে। কিন্তু আমাদের দেশে আমদানিকৃত পণ্যে অভ্যন্তরীণ মূল্যসংযোগ কম হওয়ায় রফতানি আয় কম হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমদানিকৃত পণ্যে অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোগ বাড়াতে হবে।

এ গবেষকের মতে, রফতানি আয়ের বড় অংশ জুড়ে আছে তৈরি পোশাক। এখাতে তুলা ও সুতার ব্যবহার বেশি। এ জন্য দেশি তুলা ও সুতার উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়িয়ে মূল্য সংযোজন বাড়াতে পারে। আর এ উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। তাহলে ব্যাক টু ব্যাক এলসির পরিমাণও কমবে। অপরদিকে অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজনের পরিমাণও বাড়বে। তাই দেশীয় বস্ত্র খাতকে বাঁচাতে হলে সরকারি প্রণোদনা না বাড়ানোর কোনো গত্যন্তর নেই।

বিজিএমইএ সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক মোহাম্মদ নাসির যুগান্তরকে বলেন, ব্যাক টু ব্যাক এলসির পরিমাণ কমাতে হলে দেশের ভেতর টেক্সটাইল মিল, ফেব্রিক্স শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য সরকারকে স্থানীয়ভাবে পোশাক খাতের কাঁচামাল সংক্রান্ত শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে বিশেষ নজর দিতে হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/203957/