২৭ জুলাই ২০১৯, শনিবার, ১১:৩৬

আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত

বাহিনী ও বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা থেকেই নৃশংসতা

দেশে বিচারহীনতা এবং বিচারব্যবস্থা ও আইনশ্খৃলা বাহিনীর প্রতি জনগণের অনাস্থা থেকেই মানুষ নিজ হাতে আইন তুলে নিচ্ছে ফলে ঘটছে বিভিন্ন নৃশংস ঘটনা। কথিত অপরাধের গুজবে গণপিটুনিতে হত্যাসহ শাস্তি দিচ্ছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থার ওপর যখন মানুষের আস্থা থাকে না তখন গুম, খুনসহ গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটতে দেখা যায় বলে মনে করেন ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট গুম খুন, চরম রাজনৈতিক রক্তাক্ত প্রতিহিংসা, বিচারহীনতা ও ভোটাধিকার হরণসহ বিভিন্ন কারণে দেশের মানুষ বিশেষ করে যুবসমাজের মধ্যে চরম অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা ও উন্মাদনা বিরাজ করছে। এসব কারণেই গণপিটুনির মতো নৃশংস ঘটনা ঘটছে। আর এই গণপিটুনি আইন করে থামানো যাবে না। এ জন্য রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর দায়িত্ব রাষ্ট্রের, রাজনীতিবিদদেরই।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সারা দেশে ব্যাপক হারে হত্যা, গুম, ধর্ষণ, গণপিটুনিসহ বিভিন্ন অপরাধ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গুম, খুনের মহাপ্লাবন চলছে। বিশেষ করে ইদানীং গণপিটুনি করে মানুষ হত্যার যে প্রবণতা, এতে প্রমাণ হয় জনগণের মধ্যে একটি অস্থিরতা বিরাজ করছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনাস্থার কারণেই জনগণ আইন নিজ হাতে তুলে নিচ্ছে। এর থেকে রক্ষা পেতে হলে রাজনৈতিকভাবে সত্যিকার অপরাধী যেভাবে আইনের আওতা থেকে বাইরে রয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এর থেকে দেশকে মুক্ত করতে না পারলে আমরা অনিশ্চিত পরিস্থিতির দিকে যাব। তাই এ মুহূর্তে বর্তমান সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনা কোনো অবস্থায় যেন কোনো অপরাধী আইনের আওতার বাইরে না থাকে।

খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, দেশে নির্বাচিত সরকার না থাকায় জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নেই। সেই কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের সর্বস্তরে দায়িত্ব পালনে অবহেলা দেখা দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশের মানুষের জান মাল রক্ষার জন্য তাদের যে জনগণের ট্যাক্সের অর্থে বেতনভাতা পাচ্ছে এই উপলব্ধি তাদের মধ্যে আসতে হবে। সবরকম রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। তিনি বলেন, বিচারহীনতার কারণেই আজকে মানুষ নিজ হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। কথিত অপরাধের গুজবে গণপিটুনিতে হত্যাসহ শাস্তি দিচ্ছে।

হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি ফয়সাল মাহমুদ ফয়েজি বলেন, গণপিটুনির একটি গণ মনস্তাত্ত্বিক দিক রয়েছে। এক শ্রেণীর মানুষের অর্থবিত্ত ও রাষ্ট্রীয় সুবিধাদি একচেটিয়ার কারণে সাধারণ মানুষ একদিকে যেমন অর্থনৈতিক বঞ্চনায় হতাশাগ্রস্ত। আরেক দিকে অবাধ প্রচারমাধ্যমে ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তির কারণে বিলাসবহুল জীবনের হাতছানিতে উন্মাদ প্রায় মানসিক অবস্থা। এর সাথে যোগ হয়েছে রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট গুম, খুন, চরম রাজনৈতিক রক্তাক্ত প্রতিহিংসা ও বিচারহীনতা ও ভোটাধিকার হরণ। এসব কিছু মিলিয়ে দেশের মানুষ বিশেষ করে যুবসমাজের মধ্যে এক চরম অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা ও উন্মাদনা বিরাজ করছে। এসবই গণপিটুনির কারণ। এই গণপিটুনি আইন করে থামানো যাবে না। এ জন্য রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের।
সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহমেদ বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা না থাকার কারণে মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। আর মানুষের আইন হাতে তুলে নেয়া একটা দেশের জন্য অশনি সঙ্কেত। তিনি বলেন, প্রচলিত বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা নষ্ট হয়ে গেলে এমনটা ঘটে। আর এই পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। আমাদের দেশে আগে এভাবে গুম খুনের কথা শোনা যেত না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইন হাতে তুলে নেয়ার কথা শোনা যেত না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। একটা-দুইটা নয়, ক্রসফায়ারে ঘটনা যত্রতত্র দেখা যাচ্ছে। এভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মানুষ হত্যা ও গুম হওয়ায় তাদের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে।

ইকতেদার আহমেদ বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থার ওপর যখন মানুষের আস্থা থাকে না তখন এসব গুম, খুনসহ গণপিটুনির মতো এসব ঘটনা ঘটতে দেয়া যায়। মানুষ গুম হয়ে যাচ্ছে, ক্রসফায়ারে হত্যা করা হচ্ছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত বিচার পাচ্ছে না। এসব কারণেই মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/428402/