২৬ জুলাই ২০১৯, শুক্রবার, ৪:৫৯

দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে সংখ্যালঘু উত্তেজনা ও বাংলাদেশ

অবলোকন

এশিয়ার অন্য অনেক অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়া ছিল শান্ত ও স্থিতিশীল একটি অঞ্চল। এখানে বিরোধ বৈরিতা ও প্রতিযোগিতা একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে ছিল। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) ও অন্য ক’টি আঞ্চলিক সংস্থার কাঠামোতে নিয়মিত আলোচনা ও মতবিনিময় এবং নেয়া পদক্ষেপ বিভিন্ন সময় সৃষ্ট উত্তেজনা ও বৈরিতার রাস টেনে ধরেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম লক্ষ করা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে। কোথাও তাদের উসকে দেয়া হচ্ছে, আবার কোথাও করা হচ্ছে দমনপীড়ন।

দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্ম, বর্ণ ও নৃতাত্ত্বিকÑ নানা ধরনের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রয়েছে। এই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাধারণ স্বার্থে বিশেষত ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতার জন্য একসাথে আন্দোলন সংগ্রাম করার ঐতিহ্য ছিল বিংশ শতকের প্রথম অর্ধশতাব্দী পর্যন্ত। স্বাধীনতা লাভের চূড়ান্ত সময়গুলোতে এর ব্যতিক্রম ঘটে। পাঞ্জাব ও বাংলার পাক-ভারতের অন্তর্ভুক্তিকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও সংঘটিত হয়। সম্প্রদায়গত এ বিরোধ পরবর্তীকালে কিছুটা নমনীয় হয়ে আসে। কিন্তু হায়দরাবাদ ও জুনাগড়কে ভারতের অন্তর্ভুক্তকরণ ও কাশ্মির নিয়ে যুদ্ধ-সঙ্ঘাতে ভারত-পাকিস্তান বিরোধ নতুন মাত্রা পায়।

সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো দক্ষিণ এশিয়ার ছোট-বড় বেশির ভাগ দেশেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বা উগ্র জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ প্রচেষ্টার সাথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জন বা দখলে রাখার যোগসূত্র থাকার কারণে, এর শেকড় বেশ গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো- স্নায়ুযুদ্ধের পর স্যামুয়েল পি হান্টিংটনের সভ্যতার দ্বন্দ্ব তত্ত্ব উপস্থাপনের পর এই থিওরির আলোকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সঙ্ঘাতের নতুন মেরুকরণের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দেয়া হান্টিংটনের এই তত্ত্বটি বিশ্ব পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ গতিধারার বিশ্লেষণ নাকি বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে তার তত্ত্বের আলোকে গতিদানের প্রচেষ্টাÑ এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে হান্টিংটনের সভ্যতার দ্বন্দ্ব তত্ত্বটি দেয়ার পর গত আড়াই দশকের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে বিশ্ব পরিস্থিতিকে একটি নির্দিষ্ট গতিপথে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই এটি সামনে আনা হয়েছে বলে মনে হতে পারে।

হান্টিংটনের তত্ত্বের পরে বেশ ক’টি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়Ñ যেগুলো পরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতিকে ওলটপালট করে দেয়। প্রথম ঘটনাটি হলো, ২০০১ সালের নাইন-ইলেভেনে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা। এ ঘটনার জের ধরে আলকায়েদা ও তালেবান শাসনের অবসানের নামে আফগানিস্তানে অভিযান পরিচালনা করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে। এই অভিযান চালানোর জন্য প্রেক্ষিত তৈরির বিষয়টি নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটানোর পেছনের কারণ ছিল কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেক বিশ্লেষকের। কারণ হিসেবে যুক্তি দেখানো হয়, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার সন্ধিস্থলের এ দেশটির ওপর নিয়ন্ত্রণ আমেরিকার জন্য অনেক কৌশলগত সুবিধা এনে দেবে বলে মনে করা হয়। প্রথমত, এখানে আমেরিকান সামরিক অবস্থান সৃষ্টি হলে তা মধ্যএশীয় প্রজাতন্ত্র ও রাশিয়ার কাছাকাছি পৌঁছার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। অন্য দিকে মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছা সম্ভব আফগানিস্তানে থাকলে।

১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট সংসদে বক্তব্য দেয়ার সময় পাকিস্তানকে ইহুদি রাষ্ট্রটির প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। পরে পাকিস্তানকে ভাগ করার প্রস্তাবনা নিয়ে ইসরাইলি প্রতিনিধি নেহরুর সাথে বৈঠক করেন বলেও জানা যায়। সঙ্গত কারণেই ধারণা করা হয়, পাকিস্তান ইসরাইলের লক্ষ্যবস্তু হয়েই আছে। ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় আরবদের পক্ষে পাকিস্তানের সক্রিয় ভূমিকা ইসরাইলের প্রতিপক্ষের তালিকায় পাকিস্তানকে আরো জোরালোভাবে সামনে নিয়ে আসে। ফলে পাকিস্তানে যখনই সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, তখনই ইসরাইলকে প্রতিপক্ষ দেশের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইসরাইলের সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রস্তাবের কথা তৎকালীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ উল্লেখ করেছিলেন। যদিও এই সহযোগিতা সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে গ্রহণ করা হয়নি। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি থাকলে ইসলামাবাদের ওপর এক ধরনের নজরদারির সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া আফগানিস্তানের সাথে চীন ও ইরানের সীমান্ত থাকার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে সক্রিয় এ দুই খেলোয়াড় দেশের সীমান্ত ঘনিষ্ঠ অঞ্চলে ওয়াশিংটনের অবস্থান তৈরি হয়। মনে করা হয় এর কৌশলগত মূল্য অনেক। আরো একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কৌশলগত অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে ভারতকে। আর ভারতের সাথে প্রত্যক্ষ বৈরিতা রয়েছে পাকিস্তান ও চীন দুই দেশেরই।

এসব হিসাব-নিকাশে গত দুই দশকের কাছাকাছি সময়ে আফগানিস্তানে আমেরিকান প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার বড় কারণ হলো, এ অঞ্চলের যেসব দেশ আফগানিস্তানের চার দিকে রয়েছে, সেসব দেশ আফগানিস্তানে আমেরিকান কর্তৃত্বের স্থায়িত্বের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ অবস্থান নিয়েছে। আফগানিস্তানে সামরিক সমাধানের পরিবর্তে রাজনৈতিক সমাধানে মার্কিন প্রশাসনের উদ্যোগ সেই বাস্তবতার প্রতিফলন বলে মনে হয়।

প্রশ্ন হলো দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন করে যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে, তার মূল কারণ কী হতে পারে। হান্টিংটনের তত্ত্বে দক্ষিণ এশিয়া ও সন্নিহিত অঞ্চলে চারটি সভ্যতার প্রাধান্য দেখানো হয়েছে। এর একটি হলো কনফুসীয় সভ্যতা, যার মধ্যে রয়েছে চীন, তাইওয়ান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুর। দ্বিতীয়টি হলো, হিন্দু সভ্যতা, যেটি ভারত ও নেপাল নিয়ে দেখানো হয়েছে। তৃতীয়টি হলো, বৌদ্ধ সভ্যতা যার অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়েছে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভুটান, মঙ্গোলিয়া ও তিব্বত অঞ্চলকে। জাপানি সভ্যতাকে হাইব্রিড চীনা সভ্যতা ও পুরনো অলটেক সভ্যতা হিসেবে ভিন্নভাবে দেখানো হয়েছে। এ অঞ্চলের অপর সভ্যতার ক্ষেত্র দেখানো হয়েছে মুসলিম অঞ্চলকে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান ও মধ্যএশীয় অঞ্চলের দেশগুলো এবং এর সাথে পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোকে অভিন্ন সভ্যতার অংশীদার দেখানো হয়েছে।

হান্টিংটনের যে তত্ত্বকে ভবিষ্যৎ বিশ্ব পরিকল্পনার অংশ বলে মনে করা হয়, সেই তত্ত্বের বাস্তবায়নকারীরা ইহুদিবাদের সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার বাইরে আরো দু’টি সভ্যতার যোগসূত্র তৈরি করতে চায় বলে মনে হয়। এ দু’টি সভ্যতার একটি হলো হিন্দু সভ্যতা, অন্যটি বৌদ্ধ সভ্যতা। ইহুদিবাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের যে ভিত্তি তার সাথে হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের মূল বিশ্বাসের কোনো মিল নেই। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের একটি বন্ধন তৈরি করা যেতে পারে বলে মনে করছে পরিকল্পনাকারীরা। এ কারণে হিন্দুত্ব ও বৌদ্ধত্ববাদের বিকাশকে কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা হয় দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে। মুসলিম দেশগুলোতে আলকায়েদা ও আইএসের উগ্রপন্থার রহস্যজনক বিস্তার দেখা গেছে। এটি হান্টিংটনের কথিত পাশ্চাত্য, হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতার সাথে ইহুদিবাদের বিশেষ মৈত্রী গঠনে সহায়ক হয়েছে বলে মনে হয়। এর ফলে মিয়ানমার থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত ইসরাইলের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নেটওয়ার্কের বিস্তার ঘটছে।

গত এক দশকে ভারতে সঙ্ঘ পরিবারের প্রবলভাবে শক্তিধর হয়ে ওঠা এবং তাদের রাজনৈতিক ফোরাম বিজেপির পরপর দুই মেয়াদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে যাওয়ার পেছনে একটি সুগভীর বৈশ্বিক প্রচেষ্টার যোগসূত্র রয়েছে। বিজেপির ক্ষমতারোহণের পর ইসরাইলের সাথে সামরিক ও অন্যান্য পণ্য-সেবা বাণিজ্যের যে উল্লম্ফন ঘটেছে, তা এই দুই শক্তির দীর্ঘ মৈত্রীর ভিত্তি তৈরি করছে বলে মনে হয়। ইসরাইলের ইহুদিবাদের প্রধান কৌশল হলো মুসলিমবিরোধিতা। ভারতেও সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপির হিন্দুত্ববাদ জাগিয়ে তোলার জন্য মুসলিম জনগোষ্ঠী ও মুসলিম দেশগুলোর সাথে সঙ্ঘাতকে প্রধান কৌশলে পরিণত করা হয়েছে। এই কৌশলের প্রভাব দেশটির সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সার্বিক অবস্থানকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির নির্মাণ ইস্যুর পর গো-রক্ষা আন্দোলনকে হিন্দুত্ববাদ জাগিয়ে তোলার হাতিয়ার করা হয়েছে। এটিকে আরো সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য সামনে আনা হয়েছে নাগরিকত্ব পঞ্জি তৈরি বা এনআরসি ইস্যুটি। অনুপ্রবেশের ইস্যু তুলে কার্যত এর মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের লক্ষ্যবস্তু করার প্রয়াস দেখা যায়।

এনআরসির মাধ্যমে আসামে এর মধ্যে ৪০ লক্ষাধিক বাংলাভাষীকে সন্দেহভাজনের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে ভারতের পঞ্চম প্রেসিডেন্ট ফখরুদ্দিন আলি আহমদ এবং আসামের প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী আনোয়ারা তৈমুরের পরিবারও রয়েছে। ভারতের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, দেশটির প্রতি ইঞ্চি ভূমিকে এনআরসির আওতায় এনে অনুপ্রবেশকারী বের করে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। বিজেপিপ্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহসহ সরকারের প্রভাবশালী নীতিপ্রণেতাদের এ ধরনের বক্তব্য এবং উদ্যোগের সাথে মিয়ানমারের আরাকানে শত শত বছর ধরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের অনাগরিক ঘোষণা করে পাশের দেশে ঠেলে দেয়ার কার্যক্রমের সাথে মিল রয়েছে। ভারতের এই এনআরসি উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। সেই সাথে এ ধরনের যেকোনো উদ্যোগ পুরো আঞ্চলিক অস্থিরতা যেমন সৃষ্টি করবে, তেমনিভাবে রাষ্ট্রের মধ্যে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

সংখ্যালঘু ইস্যুটি সব সময় একটি রাষ্ট্রের জন্য সংবেদনশীল। এ ইস্যুটিকে সংখ্যালঘু দমন বা জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণের জন্য যেমন ব্যবহার করা হয়, তেমনিভাবে সংখ্যালঘুদের উসকে দিয়ে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার জন্যও ব্যবহার করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে সত্য। শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহ, ভারতের কাশ্মির ও দক্ষিণ-পূর্বাংশ বৃহত্তর আসামের বিদ্রোহ, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিবাহিনীর বিদ্রোহ, মিয়ানমারের জাতিগত গ্রুপগুলোর বিদ্রোহ, নেপালে মাধেসিদের আন্দোলন অথবা পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী বালুচ আন্দোলনÑ সব ক্ষেত্রে কিছু যুক্তিসঙ্গত সংক্ষুব্ধতার ইস্যু রয়েছে। আবার একই সাথে রয়েছে বাইরের উসকানিও।
বাংলাদেশের প্রিয়া সাহা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশ থেকে তিন কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘুর গুম-অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার যে অভিযোগ, সেটিও এক ধরনের উসকানি ও অস্থিরতাকে চাঙ্গা করে তোলার লক্ষ্যে করা বলে মনে হয়। বিজেপিপন্থী ভারতীয় পত্রিকা যুগশঙ্খের একটি রিপোর্ট এ ক্ষেত্রে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। যুগশঙ্খ পত্রিকার সাম্প্রতিক এক সংখ্যার কলকাতা সংস্করণের প্রধান শিরোনাম ছিলÑ ‘নিখোঁজ ৩.৭০ কোটি হিন্দু বাংলাদেশি ভারতেই’। এর সাথে সাব টাইটেল দেয়া হয় ‘শুধু জ্যোতি বাবুই নন, মমতা-বিপ্লবও তো বাংলাদেশি’। বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিকের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে রিপোর্টটি। যুগশঙ্খের প্রকাশিত রিপোর্টে অ্যাডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক দাবি করেন, প্রিয়া সাহার বক্তব্য সঠিক। তার কথায়, সরকারের বিভিন্ন হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিন কোটি ৭০ লাখ হিন্দু নিখোঁজ রয়েছেন, যাদের মধ্যে একটি বড় অংশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতি গোবিন্দ বলেন, আসামে প্রকাশিত নাগরিক তালিকায় বাদ পড়া প্রায় ৪০ লাখ নাগরিক তো বাংলাদেশ থেকে নিখোঁজ হওয়া মানুষই। তারা বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন আমরা স্বীকার করছি, এনআরসি থেকে বাদ পড়া ৪০ লাখ নাগরিক বাংলাদেশী ছিলেন। শুধু আসামেই নয়, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতসহ পুরো ভারতেই বাংলাদেশ থেকে নিখোঁজ তিন কোটি ৭০ লাখ নাগরিকদের বেশির ভাগই রয়েছেন। নিখোঁজ হিন্দুদের তালিকা সরকারই অর্পিত সম্পত্তি ‘ক’ এবং ‘খ’ তালিকায় গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে দাবি করে গোবিন্দ বলেন, প্রিয়া সাহার সত্য উচ্চারণে সবার গায়ে আগুন জ্বলছে কেন? অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় উল্লিখিত ব্যক্তিদের কেউ কি দেখাতে পারবেন? তারা কি মিসিং নন?
প্রিয়া সাহা বা গোবিন্দের বক্তব্যের সাথে ভারতের এনআরসি নিয়ে বক্তব্য সামনে আনা হলে এর গভীরতা অনুমান করা যাবে। গোবিন্দ তো প্রিয়ার চেয়ে আরো এক ধাপ এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু ও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতাকেও অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। এই মানদণ্ড প্রয়োগ করা হলে পশ্চিমবঙ্গের নেতৃস্থানীয় শিক্ষাবিদ রাজনীতিবিদ অনেককেই যে বাংলাদেশে পুশ করতে হবে তাই নয়, একই সাথে বিজেপির প্রবীণ নেতা এল কে আদভানিকেও তার জন্মস্থান করাচিতে ফেরত পাঠাতে হবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার সাথেও সংখ্যালঘু অস্থিরতার একটি যুগসূত্র রয়েছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়ন, সেখানে আরাকান আর্মির সাথে সেনাবাহিনীর লড়াই, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে পরস্পরবিরোধী গ্রুপগুলোর মধ্যে খুনোখুনি ও অস্ত্রসজ্জা এই অঞ্চলে নতুন এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টির আলামত। এর সাথে এই অঞ্চলে মাদকের ভয়ঙ্কর বিস্তারও উদ্বেগ সৃষ্টিকারী একটি বিষয়। অতীতে দেখা গেছে, কোনো অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের আগে সেখানে মাদক ও অবক্ষয়ের বিস্তার ঘটিয়ে যুবসমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশে এ রকম এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে মনে হয়। বিপদটি কোন দিক থেকে আসছে, অনুমান করা কঠিন। তবে সংখ্যালঘু অস্থিরতার পাশাপাশি রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা হারানো এবং রাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা বড় ধরনের উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। হ
mrkmmb@gmail.com

http://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/428054/