২৬ জুলাই ২০১৯, শুক্রবার, ৪:৫৮

সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের মহামারীর মাঝে বসবাস

মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান : আমরা কেমন সমাজে বসবাস করছি? আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোন দিকে হাঁটছে ? এমন হাজারো প্রশ্নের অমিমাংসিত জবাব আমাদেরকে হতাশার আঁধারেই শুধু নিক্ষেপ করে। আমাদের আশা আর স্বপ্নগুলো কালো মেঘে ঢেকে গেছে। জীবন নদীর প্রতিটি বাঁকে বাঁকে ওৎ পেতে আছে বিষধর কালফনি। আমাদের আঙিনায় পিশাচের অট্টহাসি। হিং¯্র হায়েনার আনাগােনা আমাদের সামনে এবং পেছনে। রক্তচোষা ড্রাকুলা ওৎ পেতে আছে আমাদের লহু পানের তীব্র উন্মাদনায়। হিং¯্র হায়েনার আক্রমণ যত্রতত্র। আদর্শচ্যুৎ ও লক্ষ্যহীন জাতির মতো আমরা দিকভ্রান্ত। মঞ্জিল নির্ধারনে ব্যর্থতা আমাদেরকে এক এক সময় এক দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আজানা গন্তব্যে আমরা ছুটে চলছি। আলেয়াকে আলো ভেবে ছুটছি নিরন্তর। জীবনের মানে কি তা নির্ধারণে ব্যর্থতা আমাদের আজকের হতাশার কারণ তা বলা যায় নির্দ্বিধায়। জীবনবোধ, মানবতা, মনুষ্যত্ব আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। মানবীয় গুণ বৈশিষ্ট্যগুলো লুপ্ত করতে তৎপর এক দঙ্গল পিশাচ। মানবীয় সমাজে পাশবিকতার উল্লাস শিশু বৃদ্ধ সবাইকে আতঙ্কের সমুদ্রে নিক্ষেপ করছে। আতঙ্কের নগরে আমাদের দিন যাপন। ভয়ের মাঝে আমাদের নিদ্রা। হতাশার মাঝেই আমাদের পথচলা। একটি দেশ, একটি জাতি কি এভাবে সামনে অগ্রসর হতে পারে? বিবেকবান প্রতিটি নাগরিকের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। প্রতিবাদী কথাগুলো বোবা কান্নায় রূপ নিয়েছে। উন্নয়নের ডুগডুগির তালে তালে বাড়ছে সমাজের রক্তক্ষরণ এবং নৈতিক অবক্ষয়। কয়েকটি বড়ো বড়ো ভবন, ফ্লাইওভার, সেতুই শুধু উন্নয়ন নয়। জীবন মান, জীবনবোধ এবং বিশ্বাসের ভিত্তির উন্নয়ন সবার আগে প্রয়োজন। প্রতিটি নির্মাণক্ষেত্রে সাইনবোর্ডে লেখা থাকে ‘সেইফটি ফার্ষ্ট’ নিরাপত্তাই প্রথম। জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রম কোনো কিছুরই আজ নিরাপত্তা নেই। এরপরও দাবী করা হচ্ছে আমরা উন্নত হচ্ছি। কবরের চাকচিক্য মৃত ব্যক্তির কোনো কাজে লাগে না। কারাগারের পোলাও কোর্মা ফাঁসির দ-প্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে কোনা সুস্বাদু খাবার নয়। প্যান-প্যাসিফিক, সোনারগাঁ কিংবা রেডিসনের জলসা ঘরের লাখ টাকা মূল্যের ঝাড়বাতি বিদ্যুৎহীন ঘরের বাসিন্দার জন্য কোনো আনন্দদায়ক বিষয় নয়। ছেলেহারা মায়ের কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে আছে। অপহরণের পর হত্যা, পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যাসহ নানাবিধ সামাজিক অপরাধ শুধু বেড়েই চলছে। পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সব বয়সের নারীরা। অতি সম্প্রতি কন্যা শিশুরা নির্মম নির্যাতন এবং হত্যার শিকার হচ্ছে। বন্যার তোরের মতো এ পঞ্চাবন সকল নীতি নৈতিকতা এবং বন্ধনকে অতল সমুদ্রে ডুবিয়ে দিচ্ছে। পাশবিকতার এ ভয়ঙ্কর থাবা আমাদের সাধারণ বিবেকবোধকে ভোতা করে দিচ্ছে। মনুষ্য সমাজে বিবেকহীন এ পাশবিকতাকে সংজ্ঞায়িত করা দূরূহ ব্যাপার। মানুষ দুটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে সৃষ্টি, তা হচ্ছে হিউম্যানিটি এবং ন্যাশনালিটি। হিউম্যান বিং বা মানবিক সত্বাগুলো ন্যাশনালিটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানবিক সত্তার বিকাশের মাধ্যমে একটি সমাজের উন্নতি, অগ্রগতি, সাসটেইন করে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো আমাদেরকে এটাই নির্দেশ করে যে আমরা হিউম্যানিটি নয় ন্যাশনালিটিকে ধারণ করছি। এমন সমাজ কি আমরা চেয়েছিলাম? চলমান ঘটনা প্রবাহের কিছু চিত্র নিয়েই আজকে আমাদের আলোচনা:

শিশুদের উপর নারকীয় বিভৎসতা : শিশুদের ওপর নারকীয় বিভৎসার ভয়াল থাবায় আমাদের বোধ এবং বোধোদয়ের অনুভূতিগুলো লোপ পাচ্ছে। বিবেকের সুপ্ত সেতারের তারগুলো ছিরে ফেরে যাচ্ছে। জীবন এবং জীবনবোধের মূল্যবোধগুলো খসে খসে পরে যাচ্ছে। আমরা এ কোন সমাজে বাস করছি? মুক্ত চিন্তার অবারিত স্পেসগুলো সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ছোটো ছোটো শিশুরা যে ভয়াল সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে তা দেখে হয়তো আজাজিলের পাশবতন্ত্রও মুখ লুকোয় আমাজনের আলোহীন গহীন অন্ধকারে। অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমাদের বিবেককে শুধু দংশনই করে না, মানুষ হিসেবে দানবীয় পরিচয়কে অতি ঘৃণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার ওয়ারীতে সাত বছরের শিশুটির ওপর পাশবিক নির্যাতনের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তারই ফ্ল্যাটের ওপর তলার এক বাসিন্দা। কয়েক মাস আগে রাজধানীর ডেমরাতে দুই কন্যা শিশুকে পাষবিক নির্যাতনের পর নির্মমভাবে হত্যা করেছে তারই প্রতিবেশীরা। গত ১০ জুলাই দুপুরে চুয়াডাঙ্গায় প্রথম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে বাড়ি নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে প্রতিবেশি আব্দুল মালেক। এ সব নির্যাতনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কন্যা শিশুরাই বেশী নির্যাতিত হচ্ছে। তবে ইদানীং ছেলে শিশুরাও নির্যাতিত হচ্ছে। স্কুলের শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীর ওপর পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েক যায়গায়। একটি কওমী মাদরাসার পুরুষ শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের সংবাদ সকল জাতীয় দৈনিক ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। দৈনিক সমকালের রিপোর্টে বলা হয়েছে ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে ৪৯৬টি শিশু পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বিবিসি বাংলার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে গত ছয় মাসে ৩৯৯টি শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে। মানুষের জন্য ফাউ-েশন নামে একটি এন জিও তাদের এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই ছয় মাসে বাংলাদেশে ৩৯৯ জন শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে। তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ধর্ষণের পর একজন ছেলে শিশুসহ মোট ১৬ জন শিশু মারা গেছে। ছয়টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ৪০৮টি সংবাদ বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি এই তথ্য দিয়েছে। প্রতিবেদনের বলা হয়েছে যে, অন্তত ৪৯টি শিশু (৪৭ জন মেয়ে শিশু ও ২ জন ছেলে শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে, গত ২০১৮ সালে সারা দেশে ৪ হাজার ৫৬৬টি শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৩৫৪টি শিশুর অপমৃত্যু এবং ৮১২টি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এছাড়া অপহরণ, নিখোঁজ ও উদ্ধার করা হয়েছে মোট ৫৭০টি শিশু। নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে ২৬২টি শিশু এবং অপঘাতে ৩৯৬ এবং বাল্যবিয়ে ১৭২টি শিশু নিয়াতনের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম ও মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত ২০১৮ সালে ৪১৮টি শিশু হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। ২০১৭ সালে ছিল ৩৩৯ জন। অর্থাৎ গত বছর ২৩.৩০ শতাংশ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ৮১টি শিশু নিখোঁজের পর হত্যা করা হয়েছে। আবার ৫৩টি শিশু বাবা মায়ের হাতেই খুন হয়েছে। ৩১টি শিশু অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে। আবার ৬০টি শিশু ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ৬টি শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাছাড়া, ২০১৮ সালে মোট ৮১২টি শিশু বিভিন্ন ধরনের যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ২০১৭ সালে ছিল ৮৯৪টি যা ৯.১৭ শতাংশ কম। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ৫৭১টি শিশু ১৭ সালে ৪৯৩টি শিশু। ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৯৪টি শিশু, যা ১৭ সালে ৭০টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। ২০১৮ সালে ২৮টি প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। যা ১৭ সালে ৪৪টি প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। আবার শারীরিক নির্যাতন বা এসিড হামলার শিকার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮ সালে মোট ১২ জন এবং ২০১৭ সালে তা ছিল ৯ জন। বাংলাদেশ মানবাধিকার ব্যুরোর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে সারা দেশে নারী ও শিশু পাশবিক নির্যাতনের ৪১৫ টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ১১৯টি শিশু এবং ১৬৮টি যুবতী ও কিশোরী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের কারণে ১২০ জন নারী ও শিশু মারা গেছে। নারী এবং শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন ব্যাক্তি ও সংস্থাগুলো এ ধরণের সমাজ বিধ্বংসী কাজগুলো বন্ধে নানান ধরনের পরামর্শ ও প্রস্তাবনা পেশ করেছে। সমাজে অন্যায় অনাচার বেড়ে যাওয়ার মূল কারণগুলো অনুসন্ধান না করে গৌণ সমস্যাগুলো মৌলিক সমস্যা মনে করে তা লোপনের চেষ্টা করা হয়। যার কারণে দিন দিন শুধু অপরাধের ধরণ এবং মাত্রা বাড়তে থাকে। নৈতিক উন্নয়ন এবং সুকৃতির বিকাশে যে বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়া দরকার তা না করে ভিন্ন চিন্তা এবং ভিন্ন প্রেসক্রিপশনে অবস্থার উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়। আমাশয়ের রোগীকে প্যারসিটামল ট্যাবলেট খাওয়ালে তার অবস্থা যা হয় আমাদের সমাজের অবস্থা তার চেয়ে ভালো বলা মুশকিল। শিশু নির্যাতন দিনে দিনে শুধু বেড়েই চলছে এর সমাধান কি? কিছু এনজিও এগুলো নিয়ে গবেষণা করে। গবেষণার একটি দিক হলো আমরা তাদের কাছে তথ্য উপাত্তগুলো পাই। কিন্তু সমাধান পাওয়া যায় না। অন্যায় অপরাধ বন্ধে যে নৈতিক শক্তির উদ্বোধন দরকার তা বর্তমান সমাজ পরিচালক, সমাজবেত্তা, সমাজ গবেষক, বিশ্লেষক এবং সমাজচিন্তকরা ভিন্ন মাত্রায় ভাবেন।

শিশু অপহরণ : শিশু অপহরণ নিয়ে পিতা-মাতা এবং অভিভাবকরা এখন খুবই উদ্বিগ্ন। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও শিশু অপহরণ ও নিখোজের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি ব্যাপকহারে স্কুল ছাত্র-ছাত্রীরা নিখোজ ও অপহরণের শিকার হচ্ছে। এ মাসের শুরুর দিকে ঢাকার আইডিয়াল স্কুল এ- কলেজের মুগদা শাখার এক ছাত্রীকে স্কুল গেটের সামনে মাইক্রেবাসে করে অপহরণ করে যাবার পর সে কৌশলে মাইক্রোবাস হতে লাফ দিয়ে অপহরণকারীদের হাত থেকে রক্ষা পায়। নেত্রকোনা জেলা শহরে একই সপ্তাতে আধুনিক সদর হাসপাতালে নবজাতক শিশু চুরি ও মোক্তার পাড়ার হলি চাইল্ড একাডেমিক পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র নাফিস তানভীর নাফি ও ক্রিয়েশান স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র রিফাত হাসানকে নিয়ে এই তিনটি শিশু হারানোসহ তিনটি ঘটনা ঘটেছে। রাজশাহীতে এক স্কুলছাত্রীকে অপহরণের পর তাকে দিনাজপুর হতে উদ্ধার করা হয়েছে। সে বলেছে যে, তাকে যে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো তাতে আরো বেশ কয়েকজন স্কুলছাত্রী ছিলো। এভাবে হারিয়ে যাওয়া শিশুদের কিছু কিছু সৌভাগ্যক্রমে নিজ বুদ্ধির গুণে আত্মরক্ষা করতে পারছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে হারিয়ে যাওয়া শিশুদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। অপহরণ কাজের সাথে যারা জড়িত তারা একটি বিশাল নেটওয়ার্কের অধিকারী। এদের দ্বারা নানান সমাজবিরোধী কাজ সংগঠিত হয়। শিশু অপহরণের পর বিরাট অংকের মুক্তিপণ দাবী। টাকা দিতে না পারলে তাকে হত্যা করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুদেরকে পাচারকারী চক্রের হাতে তুলে দেয়া হয়। এ কাজে যারা জড়িত তারা অধিকাংশই মাদক এবং ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত। তাদেরকে আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থার ক্ষেত্রে রয়েছে রাজনৈতিক এবং আইনী দূর্বলতা। একইভাবে যারা এ কাজে জড়িত হয়, জড়িত হওয়ার পূর্বেই এর কারণ নির্ণয় করে তা প্রতিরোধের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই বললেই চলে।

প্রকাশ্য হত্যাকা- : বরগুনার রিফাত হত্যাকা-ে অবশেষে তার স্ত্রীকেও পুলিশ সন্দিগ্ধ হিসেবে গ্রেফতার করেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে এমন নির্মম হত্যাকা-ের পর হাইকোর্ট প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশের মানুষ তো এমন ছিলো না। হত্যাকা- দেখেও কেউ এগিয়ে এলো না কেন। এ ধরণের নির্মম হত্যাকা- কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সামাজিক এবং নৈতিক অবক্ষয়ের নি¤œ¯্রােতের ধারাবাহিকতা এটি। প্রকাশ্যে এবং পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। অতি সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার দিকে যদি নজর বুলই তবে দেখা যায় যে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। রিফাত হত্যাকা-ের রেশ না কাটতেই কুমিল্লায় একই পরিবারের তিনজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে এক প্রতিবেশী। এ মাসের শুরুর দিকে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে এক যুবককে। গাজীপুরের টঙ্গীর বিসিক ফকির মার্কেট এলাকায় নবম শ্রেণীর ছাত্র শুভ আহমদকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নেত্রকোনায় পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আবদুস সোবহান নামের এক অটোরিক্সা চালককে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত দুই খুনীকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে- রাসেল ও এমদাদ। এরা দু’জনই আবদুস সোবহানের প্রতিবেশী। চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে মীর হোসেন (২৮) নামে এক যুবককে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করেছে পাষ-রা। ৭ জুলাই সকালে উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ অলিনগর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। রাজশাহীতে মাদকের টাকা না দেয়ায় নিজ মাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে তারই ছেলে। নিহত মহিলার নাম সেলিনা বেগম। ঘটনার পর থেকে হত্যাকারী ছেলে আবদুস সালেক (৩২) পলাতক রয়েছে। ঝালকাঠি নলছিটি ও রাজাপুর থেকে যুবলীগ নেতাসহ দুইজনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ৮ জুলাই সকালে নলছিটি উপজেলার নলবুনিয়া গ্রামের বাড়ির কাছে মাঠ থেকে যুবলীগ নেতা বিল্লাল হাওলাদারের (৪৫) লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ৮ জুলাই কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ছেলের বৌয়ের হাতে শাশুড়ি খুনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় ঘাতক গৃহবধূ ও তার দুই ছেলেকে আটক করেছে পুলিশ। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের কল্যাণপুর বটতলা শ্মশানঘাটপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পাওনা টাকা চাওয়ায় বন্ধু ও তার পরিবারের লোকজনকে কুপিয়ে জখম করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চিলারং ইউনিয়নের ভেলাজান বাজারে এ ঘটনা ঘটে। এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অথবা সকল ঘটনার সারাংশও নয়। পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত অসংখ্যা সংবাদেও যৎকিঞ্চিৎ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরা হয়েছে। বাস্তব অবস্থা আরো বেশী ভয়াবহ। প্রতিদিন এক একটি লোমহর্ষক ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনশৃক্সক্ষলা বাহিনী ঘটনা ঘটার অনেক পরে উপস্থিত হয়। প্রকাশ্যে ঘটা ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে এমন কেন ঘটে এর কোনো সুস্পষ্ট জবাব পাওয়া দুষ্কর। সরকারের তরফে বলা হয়েছে কারো বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। বেডরুম পাহারা দেয়া না হোক। জেলার একমাত্র সরকারি কলেজের মূল ফটকের সামনে প্রকাশ্যে হত্যাকা- সংগঠিত হবার পর খুনীরা বীরদর্পে চলে যাওয়ার পর পুলিশ এসেছে। যা স্থানীয় সি সি টিভির রেকর্ড থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বিচারহীনতার এক ভয়াল সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে আমরা সামনে অগ্রসর হচ্ছি। আলোচিত হত্যাকা-গুলো ঘটেই চলছে কিন্তু এর সুষ্ঠু বিচারের কোনো আলামত দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেনি। সাগর রুনি হতে তনু হত্যাকা- পর্যন্ত। একের পর এক প্রকাশ্য হত্যাকা- থেমে নেই। অপরাধ সংগঠিত হবার পর প্রায়ই শোনা যায় অপরাধীরা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে লালিত পালিত ছিলো। বরগুনার রিফাত হত্যাকা-ে যারা জড়িত তারা সবাইই নাকি ক্ষমতাসীন দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়েছে। রাজনৈতিক স্বার্থে অপরাধীদের বেপরোয়ভাব, মাস্তানী এবং অন্যায় অপকর্মকে জাস্টিফাই করলে তারা আস্তে আস্তে বড়ো অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। ইতঃপূর্বে সংগঠিত প্রতিটি ঘটনার পেছনের ইতিহাস এমনই যার কারণে অপরাধ কমার পরিবর্তে দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উপসংহার : অপরাধের ভয়াবহতা নিয়ে নানান মত এবং নীতিবাক্যের কথা আমরা প্রায়ই শুনে আসছি। সমাজ এবং রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্যায়, অনাচার, জুলুম, নির্যাতন, সন্ত্রাস, শোষন, বঞ্চনা, লুটপাট, দুর্নীতি, বিচারহীনতা এবং গণতন্ত্রহীণতার যে সংস্কৃতি চালু রয়েছে। তা প্রতিরোধে যে নৈতিক ও আদর্শিক শক্তির প্রয়োজন তা বাস্তবায়নের আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীলরা কতটুকু সাহসী ভূমিকা রাখতে পারবে তার ওপর নির্ভর করবে আমরা হত্যা, ধর্ষণ, খুন অপহরণের হাত থেকে কতটুকু নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারবো। সাহসী এবং সক্ষম নেতৃত্বের জন্য একটি বিপ্লবী আদর্শকে ধারণ করতে হবে। যে আদর্শের প্রাবল্য গোটা সমাজ-সংস্কৃতির বুনিয়াদকে নতুনভাবে গড়ে তুলবে। প্রচলিত সিস্টেম এবং নিয়ম-নীতি দ্বারা আর যাই হোক চলমান অন্যায় দূর করা সম্ভব নয়। যেখানে মানুষের কথা বলার অধিকার সংকুচিত, মত প্রকাশের অধিকার তালাবদ্ধ, প্রতিবাদের মহাসড়কে কাটাতারের বেষ্টনী, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের গলিপথগুলো বন্ধ করে দেয়া। বিচারকরা স্বাধীন কিনা এ প্রশ্ন যখন সর্বত্র ঘুরপাক খায়। এমন একটি অবস্থায় শুধু কিছু শ্লোগান আর তত্ত্বকথা দিয়ে সমাজ বিধ্বংসী এ সাইক্লোন বন্ধ করা যাবে না। নয়ন ব-রা যেমন একদিনে তৈরী হয়নি একইভাবে সমাজের প্রতিটি স্তরে যে মানবতা বিধ্বংসী ভয়ানক ক্যান্সার সমাজদেহকে অষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে তাও একদিনে তৈরী হয়নি। মৃতপ্রায় এ সমাজদেহকে নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া মানে ক্যান্সারকে বুকের মাঝে পুষেই বাঁচার চেষ্টা করা। একদিকে নৈতিক শক্তির কথা বলা হবে অপর দিকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি অর্থনীতি হতে ধর্মকে বিদায় করে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা নামক ধর্মহীন আদর্শের ভিত মজবুত করা হবে। এমন সমাজে এর চেয়ে ভালো কিছু কিছু কিভাবে আশা করা যায় ? আজ থেকে সারে চৌদ্দশত বছর পূর্বে যেসকল ব্যক্তিরা কুসংস্কার, মূর্খতা এবং কুপম-ুকতা এবং চরম অমানবিক চরিত্র ধারণ করার কারণে নিজ কন্যা সন্তানকে হত্যা করতেও দিধা করতো না। তারাই যখন ইসলাম নামক আলোকের সন্ধান পেলো তারা শুধু নিজ সন্তানই নয় গোটা নারী জাতির সম্মান, সকল শিশুদের জীবন গোটা মানবতার অধিকার রক্ষায় নিজ জীবন বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি। যে তরবারী এক সময় ডাকাতি, লুটতরাজ আর নারীর জীবন হরণে ব্যয়িত হতো সে তরবারী সানা থেকে হাজরা মাওত পর্যন্ত মানবতার মুক্তির জন্য ঝলসে উঠেছে। একটি ঘোষণা, একটি আদর্শ, একটি বিশ^াস এবং একটি চেতনার মাধ্যমে গোটা দুনিয়ার ইতিহাস পাল্টে দেয়া হয়েছিলো। অন্ধকারচ্ছান্ন সমাজ নামে যার পরিচিত ছিলো তাদের সমগ্র জীবনব্যাপী এক সর্বপ্লাবী বিপ্লবের মাধ্যমে পৃথিবীর ইতিহাস পাল্টে দিয়েছিলো যে আদর্শ, বিশ^াস ও চেতনা আজকে আমার যে সমস্যা পাহাড় নিয়ে চিন্তিত, ব্যথিত তার একমাত্র সমাধান জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ এবং সমাজ ও রাষ্ট্র্রের সকল স্তরে তার বাস্তবায়ন।

https://www.dailysangram.com/post/384117