২৫ জুলাই ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:৪৮

স্বদেশ ভাবনা

চলতি বন্যা অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে

চলতি বন্যায় দেশের অর্থনীতি সার্বিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হলেও এতে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে খাদ্যশস্যের উৎপাদন এবং শ্লথ হবে দারিদ্র্য হ্রাসের গতি।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো তাদের ঘর-বাড়ি, আসবাবপত্র, মজুদ খাদ্যশস্য, ক্ষেতের ফসল, গৃহপালিত হাঁস-মুরগি, মাছের খামার হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। এরা শিগগির গরিবদের কাতারে এসে দাঁড়াবে। ক্ষতিগ্রস্ত গরিবরা সব হারিয়ে অতি গরিবদের কাতারভুক্ত হবে।

বন্যার কারণে দাম বাড়বে খাদ্যশস্য, শাকসবজির। উচ্চমূল্যে প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করতে না পারায় খাদ্যনিরাপত্তার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে পড়বে অতি গরিবরা। সংক্ষেপে, চলতি বন্যার কারণে দারিদ্র্য হার হ্রাসের গতি কমবে।

গণমাধ্যম বন্যার হালনাগাদ খবর প্রচার অব্যাহত রেখেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (এনডিআরসিসি) সূত্রের বরাত দিয়ে ২১ জুলাই যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভয়াবহ বন্যায় এ পর্যন্ত দেশের ১৩ জেলার ৬৯ হাজার ৭০৮ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ কাঁচা-পাকা মিলে ৪ হাজার ১৭৮ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

১১ জেলার ৩ হাজার ১৫২টি শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ। স্মরণকালের এই ভয়াবহ বন্যায় এবার ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। এ পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ২১ জেলা বন্যাক্রান্ত হয়েছে। তবে এর মধ্যে ৮ জেলার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ১৯ জুলাই পর্যন্ত সরকারি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।

এদিকে পত্রিকাটির ২০ জুলাইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ২৮ জেলা কমবেশি বন্যাকবলিত। জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, নেত্রকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার। এছাড়া চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার জেলা বন্যায় আক্রান্ত।

প্রথম আলোর ২১ জুলাইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যায় ১ লাখ ৯০০ হেক্টর ফসলের জমি তলিয়ে গেছে। দ্য ডেইলি স্টারের ২১ জুলাইয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বন্যায় ৬০ হাজার হেক্টর জমির ধান ও শাকসবজি পানিতে ডুবে গেছে।

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলেছে, বন্যায় ২০ জুলাই পর্যন্ত দেশের ২৬ জেলায় ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ৩৯ হাজার হেক্টর জমির আউশ ফসল, ১১ হাজার হেক্টর আমন বীজতলা এবং ১০ হাজার হেক্টর জমির শাকসবজি।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের (ব্রি) এক সিনিয়র কর্মকর্তার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডুবে যাওয়া আউশ ফসলের ২০ শতাংশ সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, যার অর্থ হল গত অর্থবছরে উৎপাদিত আউশ ফসলের হিসাবে এবার বন্যায় আউশ ফসলের ক্ষতির দাঁড়াবে ২০ হাজার টন ধান। চালের আকারে এর পরিমাণ দাঁড়াবে কমবেশি ১৫ হাজার টনে।

এদিকে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস অনুযায়ী, দেশের উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চলে বন্যা দীর্ঘায়িত হতে পারে।

দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ক্যাপ্টেন এ বি এম তাজুল ইসলাম বলেছেন, ভারতের পাশাপাশি চীন থেকে বন্যার পানি পুরোদমে আসা শুরু করলে এবারের বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলে সরকার আশঙ্কা করছে।

এদিকে বন্যায় আক্রান্ত মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। ২২ জুলাই যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সীমাহীন দুঃখ-কষ্টে দিন কাটছে বানভাসি মানুষের।

বিভিন্ন স্থানে ত্রাণের জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে। ত্রাণের আশায় নৌকা দেখলেই ছুটে যান তারা। অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে দাঁড়িয়ে থাকেন।

সরকারিভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আশ্রয় কেন্দ্রে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও বাঁধে বা উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়া কিংবা বন্যার পানিতে আটকে পড়া মানুষ ত্রাণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও বলছেন, তারা পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ পাচ্ছেন না।

গবাদিপশু ও গোখাদ্য নিয়েও চরম বিপাকে পড়েছেন বানভাসি মানুষ। অনেকে কোরবানির ঈদের জন্য লালনপালন করা গরু লোকসানে বিক্রি করে দিচ্ছেন।

সরকারি হিসাবে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) আউশ চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৭ লাখ টন (সূত্র : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৯)।

গত অর্থবছরের তুলনায় ১৫ হাজার টন কম আউশ চালের উৎপাদন চলতি অর্থবছরের মোট চাল উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

দেশে চাল উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আমন। তবে আমন আবাদ অনেকটা প্রকৃতিনির্ভর। প্রলয়ঙ্করী বন্যা এবং ভয়ানক খরায় আমনের আবাদ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অনেক নজির রয়েছে।

২০০৭-০৮ অর্থবছরে পর পর দুটি প্রলয়ঙ্করী বন্যায় আমনের উৎপাদন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে এবং খাদ্যনিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে না ফেলতে তৎকালীন সরকার বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে গিয়ে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হয়।

সরকারি হিসাবে চলতি বন্যায় এ পর্যন্ত ১১ হাজার হেক্টর আমন বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে কোনো কোনো পত্রিকায় বলা হয়েছে, সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এবং আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী চলতি সপ্তাহে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে।

এমনটি হলে উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের নদ-নদীর পানি আবার বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাবে। এতে অন্যান্য ক্ষতিসহ জমির ফসল ও আমন বীজতলার আরও ক্ষতি হতে পারে।

উল্লেখ্য, শ্রাবণ মাস আমন ধানের চারা রোপণের ভরা মৌসুম। আমন বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে আমনের আবাদ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে, যা আমনের উৎপাদন ব্যাহত করতে পারে।

সরকারি হিসাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে উৎপাদিত ৩ কোটি ৩৮ লাখ ছয় হাজার টন চালের তুলনায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ বেড়ে ৩ কোটি ৬২ লাখ ৭৯ হাজার টনে দাঁড়ায়।

আর সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে সরকার চাল উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে ৩ কোটি ৬৪ লাখ ৫৯ হাজার টন (সূত্র : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৯)। তবে অনুকূল আবহাওয়ার কারণে গত অর্থবছরে চালের উৎপাদন ৩ কোটি ৭০ লাখ টনে দাঁড়ালেও প্রবৃদ্ধির হার হবে ২ শতাংশের কাছাকাছি।

বন্যার কারণে চলতি অর্থবছরে আমন উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হলে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার আরও হ্রাস পেতে পারে, যা অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ কাঁচা-পাকা মিলে ৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়। এসব ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত চলতি অর্থবছরের পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।

বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনঃনির্মাণ ও মেরামতে যে অর্থ ব্যয় হবে, তা চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতের উন্নয়নমূলক বাজেটের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।

বন্যাকবলিত মানুষ হারিয়েছে তাদের বাড়ি-ঘর, মজুদ খাদ্যশস্য, ক্ষেতের ফসল, খামারের মাছ এবং পালিত হাঁস-মুরগিসহ অনেক কিছু। এতে জনসংখ্যার শ্রেণিগত কাঠামোতে ঘটবে পরিবর্তন। নিম্নবিত্তরা তাদের ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, ক্ষেতের ফসলসহ অনেক কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়বে। অতি গরিবদের কাতারভুক্ত হবে সবহারা গরিবরা। ২০০৭ সালের নভেম্বরে সিডর ঘূর্ণিঝড় এবং ২০০৯ সালের মে মাসে আইলা ঘূর্ণিঝড়ে এটা প্রমাণিত হয়েছে। এতে দারিদ্র্য হার হ্রাসে বর্তমানের নিম্নগতি আরও শ্লথ হবে। উল্লেখ্য, সরকারি তথ্যানুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর দারিদ্র্য ১ দশমিক ৭ শতাংশ হারে কমলেও ২০১০ থেকে ২০১৬ সময়কালে তা কমেছে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে (সূত্র : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রণীত হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে-২০১০, ২০১৬)। অর্থাৎ দারিদ্র্য হ্রাসের গতি নিম্নমুখী।

তাই সরকারের উচিত হবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নবিত্তরা প্রয়োজনীয় সরকারি সাহায্য না পেলে সব হারিয়ে দরিদ্রদের কাতারে এসে দাঁড়াবে, যা দারিদ্র্য হার হ্রাসে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

অনুরূপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পরিবারগুলো সরকারি সহায়তা না পেলে অতি দরিদ্রদের কাতারে এসে দাঁড়াবে, যা অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করবে।

ক্ষতিগ্রস্ত অতি দরিদ্ররা সরকারি সাহায্য না পেলে খাদ্যনিরাপত্তার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। এমনিতেই বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অসন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/202989/