২৫ জুলাই ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:৩৮

পেঁয়াজের বাজারের নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই ভারতের হাতে

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে বেড়ে যায় পেঁয়াজের দাম। কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হচ্ছে কি না- তা যাচাইয়ে বাজার মনিটরিংয়ের সিদ্ধান্ত নেই সরকারের। কুরবানি ঈদ সামনে রেখে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়। অথচ এ বছর দেশে পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়েছে। এ ছাড়া পেঁয়াজের আরেক উৎস ভারতে দাম বাড়ার তেমন কোনো খবর নেই। এ কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে পেঁয়াজের সঙ্কট হওয়ার কোনো কারণ নেই। পেঁয়াজ আমদানিকারক বলছেন, ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজের ৩০০ থেকে ৪০০ ট্রাক বর্ডারের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকে। ঢাকার আমদানিকারকদের কাছে পেঁয়াজের বাজারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই ভারতের হাতে। কাস্টমসের কার্যক্রম বাড়াতে বাণিজ্য সচিব মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে হঠাৎ করে পিয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৪৫-৫০ টাকা, আমদানিকৃত ভারতীয় পেঁয়াজ ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি হয় খুচরা বাজারে। অথচ তার সপ্তাহখানেক আগেও এ পেঁয়াজ ২৫-৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রাজধানীর কাপ্তানবাজার, কারওয়ানবাজার ও ফকিরাপুল বাজার ঘুরে দেখা যায়, বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি বাজারে দাম বাড়ার কারণে খুচরায়ও বেড়েছে। তবে বাজারে পর্যাপ্ত পেঁয়াজের সরবরাহ রয়েছে। ক্রেতাদের অভিযোগ, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে কারসাজি করে পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হচ্ছে। প্রতি বছর কোরবানির সময় কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে দাম বাড়ানো হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে ২৪ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। কোরবানির ঈদে বাড়তি আরও প্রায় দুই লাখ টনের চাহিদা তৈরি হয়। মোট চাহিদার প্রায় ১৭ লাখ টন দেশে উৎপাদন হয়। বাকি সাত লাখ টন ভারতসহ অন্যান্য উৎস থেকে আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব মো. মফিজুল ইসলাম জানান, নিত্যপণ্য বিশেষ করে পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। পেঁয়াজের দাম বাড়ার বিষয়টি ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কেন পেঁয়াজের দাম বাড়ছে সে বিষয়টি যাচাইয়ে বাজার মনিটরিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তিনি বলেন, পেঁয়াজ আমদানি হয় ভারত থেকে। সেখানে কেজিতে ১-২ টাকা দাম বেড়েছে। ওই হিসাবে দেশেও এক থেকে দুই টাকা দাম বাড়ার কথা। কিন্তু ২৫ টাকার পেঁয়াজ ৫০ টাকা হয় কীভাবে? বাণিজ্য সচিব বলেন, কারসাজি করে দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ভোক্তা স্বার্থে দেশে আইন-কানুন ও বিধিবিধান রয়েছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া গেলে দোষীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেবে সরকার।

এদিকে পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে কাস্টমস কার্যক্রম আরও এক ঘণ্টা বাড়ানো-সংক্রান্ত চিঠি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সময়মতো না দেয়ায় একই মন্ত্রণালয়ের উপসচিবকে মিটিং থেকে বের দিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণায়ের সিনিয়র সচিব মো. মফিজুল ইসলাম।

গতকাল বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে পবিত্র ঈদুল আজহার প্রাক্কালে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন- পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মসলা ইত্যাদির মূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং গবাদি পশু পরিবহন সংক্রান্ত বিষয়ে অংশীজনদের নিয়ে আয়োজিত সভায় এ ঘটনা ঘটে। সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে এক পেঁয়াজ আমদানিকারক বলেন, ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজের ৩০০ থেকে ৪০০ ট্রাক বর্ডারের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকে। ঢাকার আমদানিকারকদের কাছে পেঁয়াজের বাজারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই ভারতের হাতে, আর বর্ডারে যারা কাজ করে তাদের হাতে। প্রতিদিন যদি ১৫০ থেকে ২০০ পেঁয়াজের ট্রাক সোনামসজিদ আর ভোমরা কাস্টমস দিয়ে প্রবেশ করতে দেয়া হয় তাহলে পেঁয়াজ নিয়ে ঈদের দিন পর্যন্ত একটুও মাথাব্যথা থাকবে না।

এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য সচিব মফিজুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে তো একটা মিটিং করেছিলাম। এরপরও কি বেশি বেশি ট্রাক ঢুকতে পারছে না? এমন প্রশ্নে ওই ব্যবসায়ী বলেন, আগে ৫০টি ট্রাক ঢুকতে পারতো এখন ৬০-৭০টি পারে। কিন্তু এখন দেড়শ থেকে ২০০ গাড়ি ঢুকতে পারলে সমস্যা হবে না। তখন পেঁয়াজ থাকবে ২০ থেকে ২২ টাকা। এরপর বাণিজ্য সচিব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিবকে উদ্দেশ করে বলেন, আমি যে কাস্টমস আরও এক ঘণ্টা বেশি খোলা রাখার জন্য চিঠি দিতে বলেছিলাম। সেটা কি দিয়েছেন? তখন উপসচিব আমতা আমতা করতে থাকেন। তারপর মফিজুল ইসলাম বলেন, কই চিঠিটা দেখান। উপসচিব বলেন, সাতক্ষীরার ডিসিকে দিতে বলা হয়েছে স্যার। এরপর সচিব বলেন, আমি তো আপনাকে দিতে বলেছি। দিয়েছেন কিনা? উত্তরে উপসচিব বলেন, দেয়া হয়নি স্যার। এর পরিপ্রেক্ষিতে সচিব বলেন, কেন দেন নাই, দেন নাই কেন? মিটিং থেকে আপনি উঠে গিয়ে চিঠি দিয়ে আসেন। এরপর উপসচিব জিন্নাত রেহানা মিটিং থেকে উঠে চলে যান।

এরপর মিটিং চলা অবস্থায়ই বাণিজ্য সচিব সাতক্ষীরার ডিসির সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। ডিসিকে সচিব বলেন, তোমাকে অনুরোধ করেছিলাম যে, পেঁয়াজের ট্রাক যেন বেশি করে ঢুকতে পারে সে জন্য কি করতে পারলা? ডিসি বলেন, ইতোমধ্যে এক ঘণ্টা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এর চেয়ে বেশি ট্রাক আসতে দিতে হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি চিঠি দিতে হবে। বৈঠক চলা অবস্থায় সচিব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়ার নির্দেশ দেন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক গবেষণায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেঁয়াজের উৎপাদন দেশে ৭৩ শতাংশ হলেও দামের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ভারতের হাতে। কেননা ঘাটতি পূরণে বাকি ২৭ শতাংশ আমদানি করা হয়। এতে মোট আমদানির ৭৯ দশমিক ৬৫ শতাংশই আসে ভারত থেকে। এ কারণে ভারতে উৎপাদন কম হওয়া, শুল্কারোপ, বন্দরের জটিলতার কারণে বাংলাদেশে দ্রুত দাম বেড়েছে যায়। তাছাড়া উৎসবভিত্তিক চাহিদা বৃদ্ধিও হঠাৎ পেঁয়াজের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভারতের পর চীন থেকে আনা হয় মোট আমদানির ১৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং খুব সামান্য আসে অস্ট্রেলিয়া, মিয়ানমার, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও অন্যান্য দেশ থেকে।

জানা যায়, দেশি পেঁয়াজের একটি বড় অংশই জোগান দিচ্ছে পাবনা, ফরিদপুর এবং রাজবাড়ী জেলা। পেঁয়াজের মোট সরবরাহের ৭২ দশমিক ৬৯ শতাংশ আসে দেশীয় উৎপাদন থেকে। ২৭ দশমিক ৩১ শতাংশ আসে আমদানির মাধ্যমে। ২০১৫-১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে পাবনায় পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ, ফরিদপুরে ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং রাজবাড়ীতে ১৩ দশমিক ১ শতাংশ। এছাড়া পর্যায়ক্রমে রাজশাহী, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, মানিকগঞ্জ এবং মাদারীপুরেও কিছু কিছু পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যারা পেঁয়াজ উৎপাদন করেন, তারা ১০০ টাকার পেঁয়াজ বিক্রি করলে পান ৪৩ দশমিক ৯ টাকা।
অন্যদিকে কমিশন এজেন্ট, আড়তদার পান ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ অর্থ, বেপারি ফড়িয়া পান ৭ দশমিক ১ শতাংশ, পাইকাররা পান ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং খুচরা বিক্রেতারা পান ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির আরও একটি কারণ হচ্ছে উৎসব। যে কোনো উৎসব হলেই দ্রুত দাম বেড়ে যায়। তাছাড়া বন্দরগুলোয় যখন কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয়, তখন কয়েকদিন সেখানে আটকা থাকলে পেঁয়াজের ওজন কমে যায়। ফলে আমদানিকারকরা দাম বাড়িয়ে এই লোকসান পোষাতে চেষ্টা করেন। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, পেঁয়াজের বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েক ধরনের দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগী গড়ে উঠেছে। এটাও পেঁয়াজের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ।

https://www.dailysangram.com/post/384056