২৫ জুলাই ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:২১

প্রায় ৬০০টি কেন্দ্রের সবগুলো ভোট পড়েছে কেবল নৌকায়!

সরদার আবদুর রহমান : গত বছর ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের টেবিল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিভিন্ন আসনের আওতায় প্রায় ৬০০টি কেন্দ্রে যতগুলো বৈধ ভোট পড়েছে তার সবই পেয়েছে কেবল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক। ধানের শীষ তো দূরের কথা, অন্য কোনো প্রতীকে কোনো ভোটই পড়েনি।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, এই কেন্দ্রগুলো ৭৫টি আসনের আওতায় রয়েছে। এই ৭৫টি আসনের ৭৪টিতে আওয়ামী লীগ এবং ১টিতে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি জয়ী হয়েছে। পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা এই কারিশমাকে ভোটের ইতিহাসে ‘চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর সাফল্য’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। অন্য প্রতীকে বিশেষত ধানের শীষে ভোট না পড়ার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বিএনপিকে দায়ী করে আসছেন। কিন্তু ৯০ ভাগ থেকে শতভাগ পর্যন্ত ভোট পড়লেও এজন্য বিএনপি কী করে দায়ী হলো তার জবাব মেলেনি।

ভোট কারিশমার কিছু নমুনা : সাতক্ষীরা-১ আসনের মদনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোটার ১,০৬০ জন। ‘বৈধ’ ভোট সংখ্যা ৮৬০টি- যার সবক’টিই পেয়েছেন নৌকার প্রার্থী। অন্য প্রতীকগুলো হলো ধানের শীষ, লাঙ্গল, হাতপাখা, আম, কাস্তে ও সিংহ। এসব প্রতীকের ঘরে কোনো ভোটই জমা হয়নি। একই আসনের কেরালকাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মোট ভোটার ২,৯৫৬ জন। এর মধ্যে ‘বৈধ’ ভোটের সংখ্যা ২,৫১৮টি। এর সবগুলোই পেয়েছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী। অন্য প্রতীকের ঘরে কোনো ভোটই জমা পড়েনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনের ৯১টি কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে খুবই ভয়াবহ অবস্থা দেখা যায়। অধিকাংশ কেন্দ্রেই ৮০ থেকে প্রায় শতভাগ পর্যন্ত ভোট কাস্ট হলেও প্রায় সবগুলোই গেছে নৌকার বাক্সে। অন্য প্রতীকের ঘরগুলো প্রায় শূন্য বা ২/১টি করে ভোট প্রাপ্তি দেখা যায়। যেমন, এখানকার আকানগর দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোটার ১,৬৪৬ জন। ‘বৈধ’ ভোটের সংখ্যা ১,৫৫২টি। এর সবগুলোই নৌকার বাক্সে পড়েছে। অন্য প্রতীকগুলো ছিলো ধানের শীষ, কাস্তে, হাত পাখা, লাঙ্গল, তারা ও সূর্য। এসব প্রতীকের ভাগে একটি ভোটও জোটেনি। উল্লেখ্য, এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৪.৯০ ভাগ। একই আসনের জয়কালিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোটার ৩,৭০৫ জন। ‘বৈধ’ ভোটের সংখ্যা ৩,৬৫১টি। সবগুলোই পড়েছে নৌকা মার্কায়। ধানের শীষসহ অন্য প্রতীকগুলোর তহবিল একেবারে শূন্য। এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৮.৬৫ ভাগ। একই আসনের পাহাড়িয়াকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোটার ৪,২৫১ জন। ‘বৈধ’ ভোটের সংখ্যা ৪,১০০টি। সবগুলোই পড়েছে নৌকা মার্কায়। ধানের শীষসহ অন্য প্রতীকগুলোর তহবিল একেবারে শূন্য। এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৬.৫৯ ভাগ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একই আসনের দরিকান্দি (মধ্য) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোটার ১,৩৭০ জন। ‘বৈধ’ ভোটের সংখ্যা ১,৩৪১টি। সবগুলোই পড়েছে নৌকায়। ধানের শীষসহ অন্য প্রতীকগুলোর ঘর শূন্য। এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৭.৮৮ ভাগ। একই আসনের ভেলানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোটার ৩,৩৫৫ জন। ‘বৈধ’ ভোটের সংখ্যা ৩,০৯৫টি। সবগুলোই পড়েছে নৌকা মার্কায়। ধানের শীষসহ অন্য প্রতীকগুলো কোন ভোটই পায়নি। এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৩.৫৬ ভাগ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একই আসনের মনাইখালি হাজি মহব্বত আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোটার ১,৩২২ জন। ‘বৈধ’ ভোটের সংখ্যা ১,২২৯টি। সবগুলোই পড়েছে নৌকায়। ধানের শীষসহ অন্য প্রতীকগুলোর ঝোলায় কোন ভোট পড়েনি। এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৩.১৯ ভাগ।

নড়াইল-২ আসনের বহুসংখ্যক কেন্দ্রের অবস্থাও প্রায় অনুরূপ। এই আসনের সরুশুনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোটার ১,৯৮১ জন। ‘বৈধ’ ভোটের সংখ্যা ১,৮৭২টি। সবগুলোই পড়েছে নৌকায়। ধানের শীষসহ অন্য প্রতীকগুলোর ভাগ্যে কোন ভোট জোটেনি। এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৪.৫৫ ভাগ। একই আসনের মাকড়াইলকে কে.এস ইনস্টিটিউশন কেন্দ্রের মোট ভোটার ২,৮৪৬ জন। ‘বৈধ’ ভোটের সংখ্যা ২,৬২৪টি। সবগুলোই পড়েছে নৌকা প্রতীকে। ধানের শীষসহ অন্য প্রতীকগুলো কোন ভোট পায়নি। এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৩.১১ ভাগ। একই আসনের শেখপাড়া বাতাসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোটার ১,৩৩৮ জন। ‘বৈধ’ ভোটের সংখ্যা ১,২২৬টি। সবগুলোই পড়েছে নৌকায়। ধানের শীষসহ অন্য প্রতীক কোন ভোট পায়নি। এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯১.৬৩ ভাগ। নড়াইলের একই আসনের নোয়াগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোটার ৩,৪২৭ জন। ‘বৈধ’ ভোটের সংখ্যা ৩,২৩৮টি। সবগুলোই পড়েছে নৌকায়। ধানের শীষসহ অন্য প্রতীকগুলোর ঘর শূন্য। এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৬.৪৪ ভাগ। একই আসনের দেবী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোটার ২,৪৯১ জন। ‘বৈধ’ ভোটের সংখ্যা ২,৪২০টি। সবগুলোই পড়েছে নৌকার ঘরে। ধানের শীষসহ অন্য প্রতীকগুলো শূন্য। এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৭.৩৫ ভাগ। এছাড়াও ধানাইড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তেঁতুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর বগজুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রভৃতি কেন্দ্রের একই চিত্র। এসব কেন্দ্রের ‘বৈধ’ সবগুলো ভোটই পড়েছে নৌকা মার্কায়। অন্যদের ঘর একেবারে শূন্য। এগুলোতে ভোটও পড়েছে ৯০ থেকে ৯৮ ভাগ পর্যন্ত।

সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের শোলাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোটার ২,০১৪ জন। ‘বৈধ’ ভোটের সংখ্যা ১,৯১৩টি। এর মধ্যে নৌকার ভোট ১৯০৯টি। বাকি ৪টি অন্যদের। এর মধ্যে ধানের শীষ ২ ভোট, গোলাপ ফুল শূন্য ভোট, সিংহ শূন্য ভোট, বাঘ ১ ভোট এবং কাস্তে ১ ভোট। বরিশাল-১ আসনের মাগুরা মাদারীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মোট ভোটার ১,৯২৫টি। ‘বৈধ’ ভোট পড়ে ১,৪৫৮টি। এর মধ্যে নৌকার ভোট ১,৪৫৫টি। বাকি ৩টি ভোটের মধ্যে হাতপাখা ২ ও গোলাপ ফুল ১টি। ধানের শীষের ঘর শূন্য।

তথ্যে আরো দেখা যায়, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর জেলার সব আসন, ফরিদপুর-১ প্রভৃতির অবস্থা প্রায় একই রকম। গোপালগঞ্জ জেলার ৩টি আসনের ৩৮৭টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৩৯টিতেই সব বৈধ ভোট নৌকায় পড়েছে। মাদারীপুর জেলার ৩টি আসনের ৩৭৬টি কেন্দ্রের মধ্যে ৬৮টিতে ‘বৈধ’ সব ভোট পেয়েছে নৌকা মার্কা।
তবে শূন্য ভোটের জন্য বিএনপিকে দায়ী করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম। তিনি একটি দৈনিককে বলেন, বিএনপি শুরু থেকেই পিঠটান দিয়েছে, প্রার্থীরাও মাঠ থেকে সরে গেছেন। তাঁরা আগাম পরাজয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন। অনেক জায়গায় মাঠেই নামেননি, কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট দেননি। তাই তাঁদের পক্ষের ভোটাররাও ওই কেন্দ্রগুলোতে ভোট দিতে আসেননি। কিন্তু বিএনপি যদি ভোট দিতেই না আসলো তাহলে ৯০ থেকে শতভাগ পর্যন্ত ভোট পড়লো কীভাবে এবং কারা এসব ভোট দিলো- তারও কোন জবাব মেলেনি। তবে বিএনপিসহ নির্বাচনী বিশ্লেষকগণ এই নির্বাচনকে বরাবরই ‘অস্বাভাবিক’ ও ‘মহাত্রুটিপূর্ণ’ বলে অভিযোগ করে আসছেন।

https://www.dailysangram.com/post/384049