২৪ জুলাই ২০১৯, বুধবার, ২:০৮

'ইলিফ চাই না কাম দেও বাহে'

'ইলিফের জইন্যে চেয়ারম্যান-মেম্বারের পাছোত বেড়াইতে শরম নাগে। শক্ত-সামর্থ্য জোয়ান মানুষ হামরা। ইলিফ চাই না, হামাক কাম দেও বাহে। হামরা কাম করি খাবার চাই।' বন্যার ত্রাণ নিয়ে সফিকুল ইসলামসহ বানভাসি অনেক মানুষের অভিব্যক্তি এরকম। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাটসহ উত্তরের বিভিন্ন জেলার অধিকাংশ বানভাসি মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে উঁচু রাস্তা বা বাঁধে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যে পরিমাণ ত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে পরিবারগুলো দিনে একবেলা হয়তো খেতে পারছে। বাকি দুই বেলা উপোস থাকতে হচ্ছে। অনেক জায়গা থেকে পানি কমতে শুরু করলেও ঘরের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। এ অবস্থায় ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে তাদের চলবে না। বানভাসিদের এখন দরকার কাজ। সে আক্ষেপ ঝরে পড়ছে কুড়িগ্রামের সফিকুলসহ উত্তরের বানভাসি মানুষের মধ্যে। সরেজমিন খবর পাঠিয়েছেন সমকালের সংশ্নিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৯ উপজেলার ৬০ ইউনিয়ন ও ৩ পৌরসভার ৮৯৪ গ্রামে প্রায় ২ লাখ ৩৯ হাজার পরিবারের সাড়ে ৯ লাখের মতো মানুষ বন্যার কবলে পড়েছে। ১১ দিন ধরে বাঁধসহ বিভিন্ন নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার পরিবার খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটের পাশাপাশি পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যায় চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে অনেক স্থানে।

কুড়িগ্রাম-যাত্রাপুর নদীবন্দর পাকা সড়কের জুম্মাপাড়া এলাকায় সড়কের ওপর ত্রিপল টানিয়ে স্ত্রী মেরিনা আর দুই পুত্র মেরাজ (৮) ও বর্ণকে (আড়াই বছর) নিয়ে মাথা গুঁজেছেন সাইফুল ইসলাম। বানের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বাড়িঘর ছেড়ে ১১ দিন ধরে

সড়কের পাশে আছেন। বাড়িঘরে এখনও হাঁটুসমান পানি থাকায় ফিরতে পারছেন না। তার মধ্যে ধরলা নদীতে আবার পানি বাড়ার খবর শুনে চোখেমুখে হতাশার ছাপ। তারপরও ত্রাণ নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। নেই কোনো আগ্রহ।

সাইফুল দিনমজুরি করে সংসার চালান। এ ছাড়া এক বিঘার মতো জমি আছে। তার মধ্যে ৬ শতাংশ জমিতে বাড়ি। এক বিঘা জমি বর্গা চাষ করেন। এবার আমন ধান আবাদের জন্য ৫ শতাংশ জমিতে ১০ কেজি গুটি স্বর্ণা ধানের বীজ ছিটিয়ে বীজতলা তৈরি করেছিলেন। সেই বীজতলা এখন পানির নিচে। ফলে উপযুক্ত সময়ে আমন আবাদ নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন।

সাইফুল জানান, তার ঘরে দুই মণ ধান আর আধা মণ চাল ছিল। হঠাৎ করে রাতের বেলায় পানি ঘরে ঢুকে পড়ায় জিনিসপত্রের সঙ্গে সেই ধান-চাল ভিজে গেছে। কোনো রকমে উদ্ধার করে আনলেও শুকানোর অভাবে ধান পচে গেছে। আর চালের কিছু অংশ ভেজে খেয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার তার কাছে আর কোনো চাল নেই। সকালে সবাই মিলে চিড়ামুড়ি খেয়েছেন। এরপর কী খাবেন, জানা নেই তার। তারপরও তিনি ত্রাণ নয়, কাজ চান বলে জানালেন।

চিলমারী উপজেলার ডাওয়াইটারী এলাকার দিনমজুর চান মিঞা (৫০) বলেন, 'কাম কাজ নাই। এলা হামরা কেইদোন করি বাঁচি? বাড়িত মোট ৫ জন খাওয়াইয়া। মোর একার কামাইয়ের ট্যাকা দিয়া সংসার চলে। কাম নাই, কামাইও নাই। বউ বাচ্চা নিয়া এক বেলা খায়্যা, আরেক বেলা উপাস করি দিন কাটাইতোছি।' তিনি আরও বলেন, 'রিলিফ তো স্থায়ী সমাধান নয়। যে পরিমাণ রিলিফ দেওয়া হচ্ছে, তা প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে পৌঁছাচ্ছে না।' শুধু সাইফুল বা চান মিয়া নয়, বন্যার্ত সবার অভিব্যক্তি প্রায় একই রকম। তারা এখন কাজ চান। চান কাজের বিনিময় খাদ্য।

এদিকে, ধরলা নদীর পানি বেড়ে কুড়িগ্রাম ফেরিঘাট পয়েন্টে আবারও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের পানিও বিপদসীমার ওপরে। নদ-নদীগুলোতে পানি বাড়া-কমা অব্যাহত থাকলেও বন্যাকবলিত এলাকাগুলো থেকে পানি সরছে না। ফলে জেলার অর্ধেক অংশ এখন পানিতে তলিয়ে আছে। চলমান বন্যায় কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলায় পানিতে ডুবে ও ডায়রিয়ায় গতকাল পর্যন্ত চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

এদিকে, গতকাল রংপুর বিভাগীয় কমিশনার কেএম তরিকুল ইসলাম চিলমারী উপজেলার থানাহাট, বালাবাড়ী, পাম্পের মোড় এলাকা পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিস চত্বরে তিনশ' বানভাসির মাঝে সরকারি ও একটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন। এ সময় কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভিনসহ স্থানীয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

প্রথম দফার বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও ভোগান্তি কমেনি লালমনিরহাটের বানভাসিদের। এবার নতুন আতঙ্ক বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ধসের। গত সাত দিনে আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নে গোবরধোন ২ নম্বর স্পার বাঁধের কিছু অংশ ধসে গেছে। সরেজমিন গতকাল মহিষখোচা গোবরধোন বাঁধ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মানুষের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। বাঁধের পূর্ব পাড়ের বাসিন্দা দিনমজুর তাহের বলেন, 'বাহে, এবার বুঝি হামার বাচান নাই। বাঁধ ভাঙ্গি গেলে সর্বনাশ হইবে।'

সোমবার গভীর রাত থেকে পাউবোর লোকজন স্থানীয়দের নিয়ে বাঁধ মেরামতে কাজ করছে। পাউবো জানায়, বাঁধের প্রায় ৩০ থেকে ৩২ মিটার অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধস ঠেকাতে এ পর্যন্ত তিন হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে।

গাইবান্ধায় ৩৬৯ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ : বন্যার কারণে গাইবান্ধায় সাত উপজেলার ৩৬৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩০৯টি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া নদীভাঙনে ইতিমধ্যে তিনটি প্রাথমিক ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বিলীন হয়েছে। বন্ধ থাকা বিদ্যালয়ের মধ্যে ২৮১টি প্রাথমিক, ৮৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা এবং চারটি কলেজ ও সিনিয়র মাদ্রাসা রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই দুর্গম চরে অবস্থিত। এ ছাড়া ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে আরও ১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গাইবান্ধা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

https://samakal.com/whole-country/article/19072023