১৭ জুলাই ২০১৯, বুধবার, ১:৩৪

গণতন্ত্রের বিচ্যুতি ও নির্বাচন কমিশন

ইবনে নূরুল হুদা : দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিচ্যুতির অভিযোগ অতীতে বিরোধী দলের মুখেই বেশি বেশি শোনা যেত। কিন্তু সে অভিযোগের পরিসরটা এখন আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। অভিযোগটা এখন দেশীয় গন্ডি পেড়িয়ে আন্তর্জাতিক মহল পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সে অবস্থার আরও অবনমন ঘটেছে বলেই মনে হচ্ছে। এখন সরকার সংশ্লিষ্টদের মুখেও দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন এবং কমিশনের শীর্ষকর্তাদের মুখেও সে কথায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। যা আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থার মর্যাদাকে ভূলুন্ঠিত করেছে বলেই অভিযোগ। এমনকি তা সরকারসহ পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্রিয়াশীলতা ও কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিয়েছে।

যতই দিন যাচ্ছে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে অভিযোগের পারদ ততই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। সম্প্রতি এই বিষয়ে নতুন করে অভিযোগ উত্থাপন করেছে নাগরিক সংগঠন ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন’। সংগঠনটি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নানা অনিয়মের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার(সিইসি)সহ সংশ্লিষ্টদের দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি জানিয়েছে। সংগঠনটির ভাষায়, ওই নির্বাচনে ৩০০টি আসনের ৪০ হাজার ১৫৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। আর ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ১২৭টি কেন্দ্রে, ৯৮ শতাংশ ভোট পড়েছে ২০৪ কেন্দ্রে, ৯৭ শতাংশ ভোট পড়েছে ৩৫৮ কেন্দ্র এবং ৯৬ শতাংশ ভোট পড়েছে ৫১৬ ভোটকেন্দ্রে। সম্প্রতি ইসির দেয়া কেন্দ্রভিত্তিক ফল অনুযায়ী, ওই নির্বাচনে ৬৯টি কেন্দ্রে ১০০ শতাংশ ভোটগ্রহণ হয়েছে। এসব কেন্দ্রে শতভাগ ভোটগ্রহণ স্বাভাবিক নয় বলে স্বীকার করেছেন সিইসি নুরুল হুদা। তবে তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে এখন আর করার কিছু নেই। তার এই বক্তব্যে নির্বাচন কমিশন যে সাক্ষীগোপাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে তা খুবই স্পস্ট।

সুজনের দেয়া তথ্যমতে, গোপালগঞ্জ জেলার তিনটি আসনের ৩৮৭টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৩৯টি কেন্দ্রে প্রদত্ত (৬১.৭৫ শতাংশ) সব ভোট নৌকায় পড়েছে। যা অবিশ্বাস্য বলেই মনে করা হচ্ছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অধিক হারে ভোট পড়াকে প্রশ্নবিদ্ধ মনে করছেন আত্মসচেতন মানুষ। তারা বলছেন, নির্বাচনের দিনের ভোটের চিত্রের সাথে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়া স্বাভাবিক ঘটনা নয় বরং তা অবিশ্বাস্য।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে শুধু ভোটে সীমাহীন অনিয়মই নয় বরং নির্বাচন কমিশনও ফলাফল জালিয়াতি করেছে বলে সুজন অভিযোগ করেছে। জানা গেছে, ঢাকা-১০ আসনে তাৎক্ষণিক ফল ঘোষণায় ৬৯.৯২ শতাংশ ভোট পড়েছে জানানো হলেও কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে তা বেড়ে ৭৩.০৯ শতাংশ দেখানো হয়েছে। একইভাবে ঢাকা-১১ আসনে তাৎক্ষণিক ঘোষণায় ৬০.৪৬ শতাংশ কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে ৬২.৬৫ শতাংশ, চট্টগ্রাম-৮ আসনে তাৎক্ষণিক ঘোষণায় ৭৪.৪৪ শতাংশ কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে ৭৬.৭২ শতাংশ এবং গোপালগঞ্জ-৩ আসনে তাৎক্ষণিক ঘোষণায় ৯৩.২৪ শতাংশ কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে ৯৪.৩৩ শতাংশে উন্নীত হয় বলে সুজনের দাবি। দুই ফলের অনিয়ম তুলে ধরে বলা হয়, চট্টগ্রাম-১০ আসনে গণসংহতি আন্দোলনের প্রার্থীর বেসরকারি ফলাফলে প্রাপ্ত ভোট ‘শূন্য’ দেখানো হলেও কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে দেখানো হয়েছে যে ওই প্রার্থী ২৪৩টি ভোট পেয়েছেন। ব্যালট পেপার ও ইভিএমে ভোট প্রদানের মধ্যে ভোটের পার্থক্য ২৯.৩৮ শতাংশ উল্লেখ করে জানানো হয়, এবার নির্বাচনে ৩০০ আসনে মধ্যে ছয়টি আসনে সম্পূর্ণ ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হয়। ৩০০ আসনে গড় ভোট পড়েছে ৮০.২০ শতাংশ। এর মধ্যে ব্যালট পেপারে ভোট হওয়া ২৯৪টি আসনের গড় ভোট ৮০.৮০ শতাংশ হলেও ইভিএমে গড় ভোট পড়েছে ৫১.৪২ শতাংশ। যে ২১৩টি ভোট কেন্দ্রে ১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে দাবি করা হয়েছে। ৭৫টি নির্বাচনী এলাকার ৫৮৭টি ভোট কেন্দ্রে প্রদত্ত সকল ভোট নৌকা প্রতীকে পড়েছে। আর ধানের শীষে জয়ী ছয়টি আসনের মধ্যে চারটি আসনে অস্বাভাবিক কম ভোট পড়েছে।

উল্লেখিত তথ্যগুলো সুজনের কোন গবেষণার তথ্যউপাত্ত নয় বা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেও এসব তথ্য দেয়া হয়নি বরং এসব নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত তথ্য। বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা যখন বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক রিপোর্ট করে, টিআইবি থেকে শুরু করে অন্যান্য সংগঠন, তখন সরকার বা ইসির পক্ষে বলা হয় যে, তাদের তথ্যের উৎস সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্য দিয়ে সুজন যে বোমা ফাটিয়েছে তা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান খোদ নির্বাচন কমিশনকেই রীতিমত আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।

গত এক দশকে আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের মান একেবারে তলানীতে নেমে এসেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নিকট অতীতে ক্ষমতাসীনরা এসব অভিযোগ পাত্তা না দিলেও গত বছরের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার যে মর্যাদাহানী ঘটেছে সে ঢাক-ঢোল আর বিরোধী দলকে পেটাতে হচ্ছে না বরং এক্ষেত্রে এখন যন্ত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন সরকার সংশ্লিষ্টরাই। আর তার সাথে যুক্ত হয়েছেন খোদ নির্বাচন কমিশনের শীর্ষ কর্তারাও। কিন্তু তারা এজন্য অন্য কারো ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করলেও সুজনের দেয়া সাম্প্রতিক তথ্য সে বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী মহল, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সহ সর্বমহলে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। এমনকি সম্প্রতি নির্বাচনের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিয়ে সে কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন খোদ ১৪ দলের সাংসদ রাশেদ খান মেনন। তার কথায় স্পস্ট হয় যে, আমাদের দেশে নির্বাচনের মর্যাদাহানী হয়েছে। তিনি জাতীয় সংসদে বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ‘নির্বাচন নিয়ে জনগণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। মসজিদে মাইকে ঘোষণা দিয়েও ভোটারদের আনা যায় না। উপজেলা নির্বাচনেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এটা কেবল নির্বাচনের জন্য নয়, গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক’। এর আগেও তিনি বলেছিলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনে এবার রাতের বেলা ভোট হবে না। এখন দিনের বেলাতেই হবে ভোট ডাকাতি’। (বাংলা ট্রিবিউন, ৬ মার্চ ২০১৯)।

এ বিষয়ে সরকারের আরেক শরীক জাসদ নেতা শরীফ নূরুল আম্বিয়ার বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে বলেছেন, ‘ভোটের আগের রাতেই ভুয়া ভোটের মাধ্যমে ব্যালটবাক্স ভর্তি করে রাখাসহ নানা অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে’। (দ্য ডেইলি স্টার, ৫ ফেব্রুয়ারি- ২০১৯)। সরকারের অন্যমত শরীক ওয়াকার্স পার্টির এমপি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেমনের আত্মস্বীকৃতিই আমাদের দেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন, নির্বাচনী ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা ও নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতা বাস্তবচিত্রটিই ফুটে উঠেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মি. মেননের সংসদসদস্য হওয়া নিয়েও জনমনে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে।

ইদানীং প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহ অপর নির্বাচন কমিশনারদের কথাবার্তায়ও নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মের কথায় ফুটে উঠেছে। এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেছেন,‘... যদি ইভিএমে ভোটের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আর আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার সুযোগ থাকবে না।’ (প্রথম আলো, ৮ মার্চ ২০১৯)। তিনি আরও বলেছেন,‘কারা সেজন্য দায়ি, তাদেরকে কী করা যাবে সেই দীক্ষা-শিক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা-যোগ্যতা আমাদের কমিশনের নেই এবং সেভাবে বলারও সুযোগ কেনো নেই যে, কী কারণে হচ্ছে, কাদের কারণে হচ্ছে, কারা দায়ি।’ (বিডিনিউজ২৪.কম, ৮ মার্চ ২০১৯)।.

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কথায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গুরুতর অনিয়ম ও ইসির অসহায়ত্বই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু তিনি যে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ইভিএম-এর কথা বলেছেন তা মোটেই বাস্তবসস্মত নয়। কারণ, রাতে ব্যালটবাক্স ভর্তিকারীদের নির্বাচন কমিশন যদি কিছু বলতে না পারে, তাহলে ইভিএম মেশিনগুলো তারা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে-তা মোটেই বোধগম্য নয়। যারা রাতের বেলা বাক্স ভরেছেন, তারা ইভিএম মেশিনেও রাতে ভোট দিলে তা ঠেকানোও মেরুদন্ডহীন নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এ বক্তব্য ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র চেষ্টাই বলতে হবে।

রাতে ব্যালটবাক্স ভরা বিষয়ে সিইসি এখন যা বলছেন, নির্বাচনের পর একই কথা বলেছিলো টিআইবি। ৫০টি কেন্দ্রের মধ্যে তারা ৪৭টি কেন্দ্রে অনিয়ম পেয়েছিলো। টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী শতকরা ৬৬ ভাগ কেন্দ্রে রাতে ভোট দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিলো। সেই সময় টিআইবির গবেষণা সম্পর্কে ইসির বক্তব্য ছিল, ‘এটা কোনো গবেষণাই নয়। পূর্ব নির্ধারিত মনগড়া তথ্য দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে’। কিন্তু সিইসির এখনকার বক্তব্য আর টিআইবির প্রতিবেদনের মূল বক্তব্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না নির্বাচন কমিশনের কাছে তার সদুত্তরও।

গত ৩০ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে অনেক অভিযোগ থাকলেও নির্বাচন কমিশন কোন ক্ষেত্রেই কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। খুলনার একটি আসনে মোট ভোটারের চেয়ে প্রার্থীদের প্রাপ্ত মোট ভোট বেশি হওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। এই রিপোর্ট প্রকাশ করায় কথিত ‘অসত্য সংবাদ’ প্রকাশের দায়ে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমকর্মীকে গ্রেফতারও করা হয়েছিলো। কিন্তু, সংবাদটি যে অসত্য ছিলো না, ডয়চে ভেলেসহ অন্যান্য গণমাধ্যম তথ্য ও ভিডিওচিত্রের বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে। বগুড়ার কয়েকটি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো। এসব ঘটনাগুলোর কোনো তদন্ত নির্বাচন কমিশন করেছে-এমন তথ্য জানা যায়নি বরং এমন মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের পক্ষে নির্বাচন কমিশন সর্বকালের সবচেয়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বলে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিল।

মূলত আমাদের দেশে অস্বচ্ছ গণতন্ত্র ও নির্বাচনী সংস্কৃতি চালু হয়েছে বলে এখন জোরালো অভিযোগ। কারণ, গণতন্ত্রের কোন সংজ্ঞার সাথেই আমাদের দেশের গণতন্ত্রের সাদৃশ্য পাওয়া যায় না। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাস গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন, গণতন্ত্র এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থা, যেখানে শাসনক্ষমতা কোনো শ্রেণি বা শ্রেণিসমষ্টির ওপর ন্যস্ত থাকে না বরং তা সমাজের সদস্যদের ওপর ন্যস্ত থাকে। হিনস হাও-এর মতে, রাজনৈতিক দৃষ্টিতে গণতন্ত্র বলতে এমন এক মতবাদকে বোঝায়, যেখানে জনগণ রাষ্ট্রকে তার ইচ্ছামতো এমন এক জবরদস্তি শক্তি প্রদান করে, যার আনুগত্য করতে ভূখন্ডের সব মানুষ বাধ্য হয়। অ্যারিস্টটলের মতে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধনী মানুষের চেয়ে গরিব মানুষের ক্ষমতা বেশি হবে। কেননা তারা সংখ্যায় অধিক। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটবে।

গণতন্ত্রকে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন বলে আখ্যায়িত ও প্রচার করা হলেও আমাদের দেশে চলছে বিশেষ শ্রেণির শাসন। যেখানে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের তেমন কোন প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বস্তুত, আমাদের দেশের গণতন্ত্র এখন গোষ্ঠীতন্ত্রে রূপ নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশে মাঝে মাঝে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও আমরা একটা সংকীর্ণ বৃত্তের মধ্যেই আটকা পড়েছি। অবশ্য একথা ঠিক যে, প্রায় ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কার্যকর নেই এবং তা বাস্তবসম্মতও নয়। নির্বাচনে ৩ জন প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটে হার যদি যথাক্রমে ৪০, ৩৫ ও ২৫ হয় তাহলে প্রচলিত গণতন্ত্র অনুযায়ি ৪০% ভোট প্রাপ্ত প্রার্থী বিজয়ী হন। এখানে ৬০% ভোটারের মতামতের কোন মূল্যায়ন হয় না।

মুলত সে কারণেই গণতন্ত্রের সর্বজনীন কোন সংজ্ঞা এখনও আবিষ্কার হয়নি। প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ, ওয়েস্টমিনস্টার, জ্যাকসনিয়ান, উদারনৈতিক, ধর্মীয়, তৃণমূল, অংশীদারি, সামাজিক, ডেমার্কি বা লট্টোক্রেসি বা লটারিভিত্তিক গণতন্ত্রসহ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রায়োগিক দিক থেকে এ পর্যন্ত গণতন্ত্রের ৩২টিরও বেশি প্রকারভেদ দেখা যায়। পরিস্থিতির প্রয়োজনেই এসব প্রকারভেদের জন্মলাভ ও বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু আমাদের দেশে যে ধরনের গণতন্ত্র চালু আছে তা কোন সূত্রের মধ্যে ফেলানোর সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। আমাদের প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক শাসন তো দুরের কথা সরকার পরিচালনায় সাধারণ মানুষ ন্যুনতম অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নি¤œমুখী বললে অত্যুক্তি হবার কথা নয়। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে গণতন্ত্রের র‌্যাকিং প্রকাশ করে আসছে। ক্যাটাগরি চারটি হলো পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, হাইব্রিড শাসন ও কর্তৃত্বপূর্ণ শাসন। ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনেও গণতন্ত্রের গোলকধাঁধার নানা চমকপ্রদ তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৬৭টি দেশকে নিয়ে প্রকাশিত সর্বশেষ র‌্যাংকি-এ ২০১৬ সালে বিশ্বের মাত্র ১৯টি দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র চালু ছিল। ৫৭টি দেশে গণতন্ত্রের অবনমন ঘটেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে অবনমন হয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের র‌্যাংকিং-এ প্রায় ২৫০ বছরের পুরনো আমেরিকান গণতন্ত্রের পদাবনতি হয়েছে। দেশটি ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ দেশের শ্রেণি থেকে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ শ্রেণিতে নেমে গেছে। অন্যান্য কারণের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভাবনীয় বিজয়ের কারণে আমেরিকান গণতন্ত্রের পদাবনতি হয়েছে বলে ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সূচকে উল্লেখ করা হয়েছে। যা সত্যিই বিস্ময়কর।

অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন এক ট্রাম্পের তুরুপে ২৫০ বছরের পুরনো আমেরিকান গণতন্ত্র পূর্ণ গণতন্ত্র শ্রেণি থেকে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রে অবনমন ঘটেছে। অন্যদিকে মাত্র ১৯টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে প্রথম সারির গণতান্ত্রিক দেশ হলো সুইজারল্যান্ড। অথচ পৃথিবীর গরীব রাষ্ট্রের শিক্ষা, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত শত শত কোটি মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে দুর্নীতিবাজরা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে অর্থবিত্ত জমা করে। এরপরও সুইজারল্যান্ড পূর্ণ গণতন্ত্রের হাতে গোনা কয়েকটি রাষ্ট্রের মধ্যে শীর্ষ তালিকাভুক্তদের অন্তর্ভুক্ত! সুইজারল্যান্ডে দুর্নীতি ও গণতন্ত্র সহাবস্থান করতে পারলেও তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রেগুলো তার পুরোপুরি ব্যতিক্রম। আর আমাদের দেশে দুর্নীতি ও গণতন্ত্রহীনতার অভিযোগ একেবারেই সমান্তরাল।

গণতন্ত্র সূচকে ভারত দ্বিতীয় ক্যাটাগরি অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। আর বাংলাদেশ তার নিচের ক্যাটাগরি হাইব্রিড শাসনের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হয়। ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের র‌্যাংকিং অনুযায়ী ২০১৫ সালের গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশ হাইব্রিড ক্যাটাগরিতে ৮৬তম অবস্থানে ছিল। আর ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। ২০১৭ সালের সূচকে বাংলাদেশের বড় অবনতি হয়েছিল। পিছিয়ে গিয়েছিল আট ধাপ। ১৬৫টি দেশ ও ২টি ভূখন্ডের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হয় ৯২তম। ২০১৮ সালের সূচকে বাংলাদেশ ৪ ধাপ এগিয়ে হয়েছে ৮৮তম। কিন্তু মিডমাইট ইলেকশনের অভিযোগ ও স্বীকৃতি থাকার পরও কীভাবে এই ৪ ধাপ উন্নতি হলো তা-ই হচ্ছে এবারের সূচকের বড় গোলকধাঁধা।

যাহোক, এবার সূচকে চার ধাপ এগোলেও বাংলাদেশকে আগেরবারের মতো ‘হাইব্রিড শাসনব্যবস্থার’ বিভাগে রাখা হয়েছে। ‘হাইব্রিড’ বলতে এমন ব্যবস্থাকে বোঝানো হয়, যেখানে প্রায়ই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। বিরোধী দল এবং বিরোধী প্রার্থীদের ওপর সরকারের চাপ নৈমিত্তিক ব্যাপার। দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার এবং দুর্বল আইনের শাসন। নাগরিক সমাজ দুর্বল। বিচারব্যবস্থা স্বাধীন নয় এবং সাংবাদিকদের হয়রানি এবং চাপ দেওয়া হয়। মূল্যায়নের ১০ পয়েন্টের মধ্যে এবার বাংলাদেশের স্কোর ৫ দশমিক ৫৭। আগের বছর ছিল ৫ দশমিক ৪৩।

বিশ্বের অনেক দেশে রাজনৈতিক-শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকুক আর না থাকুক, বংশপরম্পরায় পরিবারের সদস্যরা শাসনক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকছেন। নানা কারণে সম্মোহিত মানুষদের ভোটে উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে। রাজতন্ত্রের আধুনিক সংস্করণ বলে মহল বিশেষে অভিযোগ করা হলেও গণতন্ত্র নামেই অভিহিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন ও ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য গণমানুষের ভোটাধিকার হরণও আমাদের দেশের গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। আর এই কর্মযজ্ঞে অংশ নিয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। কমিশনের বিরুদ্ধে নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মসহ নির্বাচনে ফলাফল জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে বেশ জোরালো ভাবেই। কিন্তু এ বিষয়ে কমিশনের পক্ষে কোন গ্রহণযোগ্য জবাব আমরা জানতে পরিনি। মূলত বর্তমান নির্বাচন কমিশন আমাদের জন্য একটি গোলকধাঁধার গণতন্ত্রই উপহার দিয়েছে। তাই এই অশুভ বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে আসা মোটেই সহজসাধ্য নয়, যদি রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকে!

https://www.dailysangram.com/post/383047