১৪ জুলাই ২০১৯, রবিবার, ১:৫৩

আর মাত্র ১১ বছর

আলমগীর মহিউদ্দিন

একটি প্রশ্ন বা চিন্তা সবাইকে আলোড়িত করেÑ কখনো সচেতনভাবে, আবার কখনো বা অচেতনভাবে। এর জবাব পাওয়ার চেষ্টাও নিরবচ্ছিন্ন। প্রশ্ন বা চিন্তাটি হলোÑ ‘মানুষ এ পৃথিবীতে আর কত দিন আছে?’

ইংরেজিতে তিনটি ধর্মকে ‘আব্রাহামিক রিলিজিয়ন’ বলা হয়। এর হিসাব করা হয় ইহুদিবাদের উৎপত্তির মধ্য দিয়ে। হজরত ইবরাহিম আ: প্রচার করেন এ ধর্ম। এর পরে আসে খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্ম। তাই এই তিন ধর্মের মাঝে অনেক মিল। এই তিন ধর্মেই মানবজাতির শেষ হওয়ার বর্ণনা প্রায় এক, অথচ কী অপূর্ব এদের মাঝে যুদ্ধ-হানাহানি-সঙ্ঘাত লেগেই আছে। যা হোক, আজকের আলোচনায় থাকবে ‘বর্তমান সভ্যতা আর কত দিন টিকবে?’

প্রথমে প্রশ্ন আসতেই পারে, ‘এর আগে কি কোনো সভ্যতা ছিল?’ আবার এর সাথে এ প্রশ্নও আসবে, ‘আসলে সভ্যতা কী?’ সম্প্রতি এ প্রশ্নগুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। এর কারণ কী?

এক কথায় ‘আবহাওয়া’। আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি সব সময় মানুষকে ব্যস্ত রেখেছে। তাই তাদের জীবনে এ বিষয়টি এত প্রভাব ফেলে। এখন একটু বেশি আলোচনার মূল কথা হলো, বোদ্ধাজনদের অনেক বক্তব্য এবং সতর্কতা বাস্তবে রূপ পায়নি। এটা স্বাভাবিক হলেও আলোচনার এবং চিন্তার শেষ নেই।

সম্প্রতি এর আলোচনার নতুন মোড় নেয়ার কারণ, বিজ্ঞানীদের বিশেষ সতর্কবাণী। তারা এক কথায় বলেছেন, সমগ্র মানবজাতিকে এখনই প্রতিটি পদক্ষেপ হিসাব করে ফেলতে হবে। নতুবা মানুষ নিজেই নিজেদের ধ্বংস করবে। এর অন্যতম প্রধান বাহন হবে আবহাওয়া। তারা বলেছেন, মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে আবহাওয়া উত্তপ্ত হচ্ছে। অতীতে এর গতি কম ছিল। এখন এর গতি বেড়ে গেছে মানুষের ভোগবাদের ফলে। ভোগবাদ বা জীবনধারণ ব্যবস্থার পরিবর্তন সেজন্য অত্যন্ত প্রয়োজন এবং যত সংক্ষিপ্ত সময়ের মাঝে তা করা যায়, ততই মানবসমাজের জন্য মঙ্গল।

এখন সমস্যা হলো বিড়ালের গলায় কে ঘণ্টা বাঁধবে? সতর্কতার চেষ্টা হোক বা না হোক, ঘটনার গতি থামবে না। তাই এর পরিণতিও অবশ্যম্ভাবী। তবে এটাও সত্য, এই বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার চেষ্টা যুগে যুগে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নানা আলোচনা ও অনুসন্ধান চলছে।

সম্প্রতি এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অস্ট্রেলিয়ার ‘ব্রেক থ্রু ন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট রেস্টোরেশন’। এ প্রতিষ্ঠানটি গভীর মনোযোগের সাথে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি লক্ষ করেছে। এই বিএনসিসিআর প্রতিষ্ঠান তার রিপোর্টে বলেছে, বিশ্বের আবহাওয়া উত্তপ্ত হচ্ছিল আদিকাল থেকেই। তবে প্রাকৃতিক অপূর্ব নিয়মে মানুষের বাসযোগ্য অবস্থার একটা স্থিতাবস্থা ছিল। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার প্রযুক্তি এবং এর নানা ব্যবহার এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে। মানুষের প্রযুক্তির ব্যবহার তার বর্তমান অবস্থায় একটু প্রশান্তি দিলেও তা প্রকারান্তরে তার ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলছে এবং এই কর্মকাণ্ড সমগ্র মানবজাতি তার অচেতনাবস্থায় অংশগ্রহণ করলেও এর মূলে রয়েছে স্বার্থলোভী ক্ষমতাবান ক্ষুদ্র গোষ্ঠী। সংখ্যাগুরু মানুষেরা এদের কাছে এখন অসহায়।
এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিটি দিন মানবসমাজ এই ধ্বংসের দিকে নিজেই এগিয়ে যাচ্ছে। বিরাট সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, ‘না ফেরার সময় সম্ভবত শুরু হবে ২০৪০ সালের মধ্যে।’ আর এ কথাও বলা হলো, ‘এর প্রতিবিধান কর্মকাণ্ড শুরু করতে হবে প্রতিটি মানুষকে ২০৩০ সাল থেকে।’ বোদ্ধাজনেরা বলছেন, ‘এটা একটা অসম্ভব অবস্থা। কারণ, বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে এই কর্মকাণ্ডে সচেতনভাবে জড়িত হতে হবে। আর এ জন্য অনেকের অনেক অতিপ্রিয় অভ্যাসÑ যেমন খাদ্যে, প্রতিদিনের আচার-আচরণে, উন্নয়ন কাজে ইত্যাদি ত্যাগ করতে হবে। অর্থাৎ দাবিটি ক্ষুদ্র মনে হলেও এর গভীরতা অনেক। তাই তারা এটা ‘অসম্ভব’ বলে হতাশ হয়ে পড়ছেন এবং সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলছেন, মানুষকে এখনই এই কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে হবে।
লক্ষণীয় ব্যাপার, বিশ্বের তিনটি প্রধান ধর্মই মানবসমাজকে এই সর্বশেষ পরিণতির কথা বারবার বলে ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত চেষ্টা করতে বলেছে। ইহুদি ধর্ম খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে, খ্রিষ্টীয় মতবাদ প্রথম শতাব্দীতে এবং ইসলাম সপ্তম শতাব্দীতে এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। বিশ্ব জনসংখ্যার ৩৭ শতাংশ খ্রিষ্টান, ২১ শতাংশ মুসলিম, ৫.২ ভাগ ইহুদি এবং অবশিষ্ট অন্যরা। এ হিসাব জাতিসঙ্ঘের। অন্য কথায়, বিশ্বের ৭০ শতাংশ মানুষই এই চারটি প্রধান ধর্মের অনুসারী। তাদের কাছে ধর্মের মাধ্যমেও সতর্কবাণী এসেছে। কিন্তু কখনোই এই সতর্কতাকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব না দেয়ায় মানবসমাজ অপ্রতিহত গতিতে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
মানুষের এমন কী কর্মকাণ্ড, যা তাদের ধ্বংস করতে যাচ্ছে? একটি উদাহরণই সম্ভবত যথেষ্ট। তা হলোÑ চেরনোবিলের ঘটনা। মানুষ প্রতিরক্ষা কিংবা নিরাপত্তা বলে যে ধ্বংস করেছে তা ইতিহাসের প্রতিটি শতাব্দীর অংশ।

সবচেয়ে বড় সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস। গত বছর তিনি গার্ডিয়ান পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘এখন সব মানুষকে একসাথে কাজ করতে হবে।’ এর কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন, খাদ্য উৎপাদন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জীবজন্তু হত্যা, রোগ, মহামারীসহ সব জীবনধ্বংসী অবস্থার মূলে রয়েছে মানুষের কর্মকাণ্ড। আবহাওয়া উত্তপ্ত হচ্ছে এর ফলেই।

আগামী কয়েক দশকের মধ্যে যদি প্রতিবিধানমূলক ব্যবস্থায় সমগ্র মানবজাতি যোগদান করে, তাহলে যে অবস্থার সৃষ্টি হবে তা শুধু ধ্বংসের এবং সে অবস্থা থেকে ফেরার কোনো পথই থাকবে না। এর সময়সীমা তারা ২০৩০ সাল বলে আশঙ্কা করেছেন। সে হিসাবে মানবজাতির হাতে আছে মাত্র ১১ বছর। বিশ্বমানব সমাজ এই অল্প সময়ে কী করে এক হয়ে তাদের নিজেদের আচার-ব্যবহার, এটা পরিবর্তন করবে? বিশেষ করে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলোকে কে নিয়ন্ত্রণ করবে?

আবহাওয়া তপ্ত হওয়ার পেছনে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ হলো প্রধান কারণ। এগুলো বিভিন্ন কলকারখানা থেকে আসে এবং এর সাথে যোগ দেয় মানুষের প্রশ্বাস। কলকারখানাসমৃদ্ধ দেশগুলোকে বলা হয় ‘উন্নত দেশ’। তবে এই উন্নত দেশগুলো মানবসমাজের ধ্বংসের উপাদান তৈরি করছে। এই উন্নত দেশগুলোকে কে বলতে পারবে যে, এই উপাদান যেন আর তারা তৈরি না করে? অনুন্নত দেশগুলোতে যেখানে গাছপালাগুলো এখনো মানুষের আবাসন, এই ধ্বংসকারী উপাদানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

এ দিকে, বিশ্বে মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। লিভিং প্লানেট রিপোর্টে (অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত) বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে ৯.৩ বিলিয়ন (প্রায় ৯৩ লাখ কোটি)। এর জন্য দরকার হবে বর্তমান পৃথিবীর তুলনায় ১.৬ আকারের বিশ্ব। নতুবা বর্তমান সভ্যতা ২০৫০ সালের মধ্যে বিলুপ্তির সম্মুখীন হবে। জাতিসঙ্ঘের আবহাওয়া প্রতিষ্ঠানের (আইপিসিসি) মতে, মাত্র ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে পৃথিবীর কয়েক কোটি লোকের জন্য জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়বে। এমন অবস্থা হয়তো এখন ভাবনাতেও আসছে না। একটি চিত্র পাওয়া গেছে। মাত্র ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস উত্তাপ বাড়লে পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলে যাবে। এখনই তা গলতে শুরু করেছে। যদি তাপমাত্রা আরো বাড়ে তাহলে এই বরফগুলো গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা ছয় ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে। তখন বর্তমান পৃথিবীর স্থলভাগের ৩৫ শতাংশ ডুবে যাবে। এক দিকে উচ্চতাপে জীবনধারণ হবে কঠিন, অপর দিকে বাসস্থানের জায়গা হবে প্লাবিত। এক কথায়, এটা মানবসভ্যতা বিলীন হওয়ার পথ।

ইউরোপে এর আগে কখনো এত উত্তপ্ত সময়ের আবির্ভাব ঘটেনি। স্পেন থেকে সুইজারল্যান্ড পর্যন্ত এই গরম বাতাস কখনো কখনো বইছে এবং আবহাওয়াবিদেরা বলেছেন, হয়তো তা ৪০ ডিগ্রিতে উঠতে পারে (যা বাংলাদেশসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশে সাধারণ বিষয়)। তাই ইউরোপীয় পিতা এবং অভিভাবকেরা শিশু ও বয়স্কদের যথাসম্ভব ঘরের ভেতরে অবস্থান করতে বলেছেন। ইউরোপিয়ানরা শঙ্কিত। কয়েকটি পত্রিকা খবরের শিরোনাম দিয়েছে ‘দোজখ আসছে’ (এল ইনফারনো ইজ কামিং)। সর্বশেষ, ১৯৪৭ সালে ইউরোপে কয়েক ঘণ্টার জন্য ৩৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা ছিল।

২০১৫ সালে প্যারিস আবহাওয়া আলোচনায় বিশ্বের দেশগুলো অংশগ্রহণ করে স্থির করেছিল, উত্তাপ কমানোর সব চেষ্টা করা হবে যেন তা ১.৫ ডিগ্রি নেমে যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (যারা পৃথিবীতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণে যুক্তরাষ্ট্রের পরই) কথা দিয়েছিল সর্বাত্মক চেষ্টার। তার নমুনা এখনো কিন্তু দেখা যায়নি। আবহাওয়াবিদেরা চিন্তিত যে, ইউরোপীয় এবং মার্কিন নেতারা আজো আবহাওয়া নিয়ে ভাবছেন না।
ফরাসি স্বাস্থ্যমন্ত্রী অ্যাগনিস বুজিন বলেছেন, ‘আমি সত্যিই চিন্তিত মানুষের জন্য। কারণ, তাদের বাইরে যেতে হচ্ছে।’ (অবশ্য বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের মানুষের কাছে এটা চিন্তার বিষয় নয়। তাদের এই অসম্ভব অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে এই উন্নত দেশগুলোর কলকারখানা)। বুজিনের চিন্তার কারণ আছে। কারণ, প্যারিসে এই গরমেও প্রতিদিনের মতো মানুষ বাইরে যাচ্ছে এবং নানা ব্যায়াম করছে। মিউনিখে এই এক সপ্তাহে গরমজনিত অসুখে ১৫ হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছে। তা ছাড়া, নানা স্থানে আগুন লেগে যায়। বুজিন বলেছেন, অন্তত ৫০ বার ফায়ার ব্রিগেড সদস্যরা এই আগুন নেভান।

অবশ্য এই অস্বাভাবিক অবস্থার একটি কারণ এমন তাপমাত্রায় তাদের বাস না করার অভ্যাস। বাংলাদেশে সে তুলনায় কোনো আগুনই লাগে না। এগুলো স্থানীয় প্রাকৃতিক ব্যবস্থা।

কিন্তু যে অবস্থার ইঙ্গিত এই রিপোর্টে দেয়া হয়েছে তা হলোÑ আগামী ১১ বছরের মধ্যে যে উত্তাপ আবহাওয়া ধারণ করবে, তা বাড়তেই থাকবে, কমবে না। কারণ কমার জন্য যে সামগ্রিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন, তার প্রস্তুতি এবং ইচ্ছা কোনোটিই দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে উন্নত বিশ্ব বলে পরিচিত শিল্পোন্নত দেশগুলো এ জন্য কোনো চেষ্টার নমুনা দেখায়নি। এটা অনেকের কাছেই বিস্ময়কর বলে মনে হবে। কারণ, তারাই পৃথিবীর মানুষদের উপদেশ দিয়ে থাকে। তারা জানে, হাতে মাত্র ১১ বছর। এখন বিশেষ সামগ্রিক ব্যবস্থা না নিলে, তারাও আক্রান্ত হবে, সম্ভবত সবার আগেই।

http://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/425002