১৩ জুলাই ২০১৯, শনিবার, ১০:৫৮

আবজাল এবং হরিলুটের বাতাসা

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : হরিলুটের বাতাসা বলে একটা প্রবাদ চালু আছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের নামসংকীর্তন অনুষ্ঠানে বাতাসা নামক দুধ-চিনির তৈরি একপ্রকার মিষ্টান্ন ভক্তদের মাঝে প্রসাদ হিসেবে ছিটিয়ে দেয়া হয়। প্রসাদের এ বাতাসা যে যতো পারেন কুড়িয়ে বা লুটেপুটে নেন। তাই বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুটপাট হলে সেই লুটের মালকে ‘হরিলুটের বাতাসা’ বলা হয়ে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাম্প্রতিক বরখাস্তকৃত আবজাল যা পেরেছেন সেভাবেই লুটেপুটে নিয়েছেন। নিজের ভাগ্য গড়েছেন।

হ্যাঁ, বহুল আলোচিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের সেই আবজাল এখন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। তাও একা নন। পরিবারসহ। আছেন বহাল তবিয়তে রাজার হালে। ওখানেও তাঁর বাড়ি-গাড়িসহ কোনও কিছুরই অভাব নেই।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর কড়া নজরদারির মধ্যে কীভাবে এতো বড় রাঘববোয়াল দেশ ছাড়তে পারলেন সেটাই এখন ভীষণ ভাবাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।

এ জন্য কেউ কেউ শর্ষের মধ্যে ভূত থাকে এমন কথাও ভাবতে চান। কেন না রীতিমতো দুদকের শক্ত জাল ফেড়ে শিকার বেরিয়ে গেছেন।

কথায় আছে না, ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’। আবজালের ক্ষেত্রেও এখন সেরকম কিছু ঘটতে যাচ্ছে। দুদকের অনুসন্ধান শেষ। বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য গোপন করবার প্রমাণও মিলেছে।
উল্লেখ্য, আবজালের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানমের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ২৬৩ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। হতবাক হবার মতোই বিষয়।

যিনি চাকরিজীবনে মোট বেতন পেয়েছেন ১৭ লাখ টাকা, তার স্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এতো টাকা জমা হবার বিশ্বাসযোগ্য কোনও কারণ থাকতে পারে কি? এরপরও এসব তিনি আয়কর নথিতে প্রদর্শন করেননি।

সূত্র মতে, সম্পদের তথ্য গোপন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে শিগগির আবজাল দম্পতির বিরুদ্ধে দুদক মামলা করবে। তবে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, আবজাল সপরিবার বিদেশে অবস্থান করতে পারলে তাঁর টিকিটি স্পর্শ করা কঠিন হবে। মামলাটি শুধু আইনি পদক্ষেপের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।

সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আবজাল দম্পতি অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। এমন খবরে খোদ দুদকের কর্মকর্তারাই হতাশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা একটি দৈনিককে বলেন, সম্পদ অনুসন্ধানের শুরুতেই পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে ইমিগ্রেশনে তাঁদের পাসপোর্ট ব্লক করা হয়। এরপরও তাঁরা কীভাবে দেশ ছাড়তে সক্ষম হলেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

আবজাল দম্পতির সম্পদের অনুসন্ধান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদকের পরিচালক কাজী সফিকুল আলম বলেন, সন্দেহজনক ও অপ্রদর্শিত উৎস থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করায় তাঁর বিরুদ্ধে অর্থপাচার বা মানিলন্ডারিং আইনেও মামলা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনুসন্ধান কর্মকর্তা মামলার অনুমতি চেয়ে কমিশনের কাছে রিপোর্ট করেছেন।

সূত্র জানায়, চলতি বছর মার্চে দুদকের পৃথক দুটি অনুসন্ধান টিম আবজাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানমের দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী যাচাই শুরু করে। অনুসন্ধানে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীর সঙ্গে প্রকৃত অর্থ-সম্পদের ব্যাপক গরমিল পাওয়া যায়। কোটি কোটি টাকার সম্পদের তথ্য বেমালুম চেপে যান আবজাল দম্পতি।
আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানমের মালিকানাধীন রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ব্যাংক হিসাবের তথ্যও গোপন করা হয়। অনুসন্ধানে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ব্যাংক হিসাবে ২৬৩ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের তথ্য পায় দুদক।

দুদকের এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান রিপোর্টে বলা হয়, স্বামীর অবৈধ আয়কে বৈধ করবার পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্যাংক হিসাবসমূহে কখনও এসওডি, কখনও মেয়াদি হিসাব আবার কখনও সঞ্চয়ী হিসাব অথবা পে-অর্ডার ইস্যু করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে তিনি অপরাধ করেছেন।

এ ছাড়া অজ্ঞাত উৎস থেকে ব্যাংক হিসাবে অপ্রদর্শিত ২৬৩ কোটি ৭৭ লাখ ৬৪ হাজার ৭২৩ টাকা জমাকরণ এবং পরে উত্তোলন করে পাচারে জড়িত ছিলেন রুবিনা খানম।

দুদক সূত্র জানায়, আবজাল হোসেন তাঁর সম্পদ বিবরণীতে ৬০ লাখ ৭ হাজার ৭২৫ টাকার ঘোষণা দেন। কিন্তু যাচাইকালে দেখা যায়, তিনি ১ কোটি ৬৫ লাখ ৪৩ হাজার ২১৫ টাকার সম্পদ গোপন করেছেন। দুদক তার ২ কোটি ২৫ লাখ ৫০ হাজার ৯৪০ টাকার সম্পদের খোঁজ পায়।

এ ছাড়া আবজালের মালিকানায় থাকা ১ কোটি ২৪ লাখ ২২ হাজার ২৯৭ টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্যও পাওয়া যায়। দুদকের অনুসন্ধান টিম দেখতে পায় কয়েকটি ব্যাংক হিসাব থেকে বিভিন্ন সময় ক্লিয়ারিং ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের অর্থ অন্যত্র সরিয়ে নেন আবজাল হোসেন।

স্থানান্তর করা অর্থের পরিমাণ ২০ কোটি ৭৪ লাখ ৩২ হাজার ৩২ টাকা। এসব অর্থ তাঁর জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ তিনি তাঁর চাকরিজীবনে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সর্বমোট বেতন পান ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ৩১২ টাকা। তিনি সব মিলিয়ে বেতন পেতেন ৩০ হাজার টাকা। অথচ চড়তেন হ্যারিয়ার ব্র্যান্ডের জিপে।

ঢাকার উত্তরায় তাঁর ও স্ত্রীর নামে বাড়ি আছে পাঁচটি। বাড়ি আছে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতেও। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় আছে অন্তত ২৪টি প্লট ও ফ্ল্যাট। দেশে-বিদেশে আছে বাড়ি-মার্কেটসহ অনেক সম্পদ।
দুদকের রিপোর্টে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন সরকারি চাকরিতে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল অর্থ-সম্পদ উপার্জন করেছেন।

আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানম তাঁর সম্পদ বিবরণীতে ৪ কোটি ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৩০০ টাকার সম্পদের ঘোষণা দেন। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, রুবিনা খানম বিশাল অঙ্কের সম্পদের তথ্য গোপন করে মিথ্যা বিবরণী উপস্থাপন করেছেন। যাচাইকালে তাঁর নামে ৯ কোটি ৮৬ লাখ ১ হাজার ৮০১ টাকার গোপনকৃত সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসে।

দুদক বলছে, আবজাল হোসেন তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বড় বড় কাজ করতেন। সরকারি চাকরি থেকে অবৈধভাবে ঠিকাদারি ব্যবসা করলেও স্বাস্থ্য অধিদফতর কোনওদিন এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। বরং আবজালের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে সবসময়ই সহায়তা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

সূত্র মতে, দুদকের কাছে সম্পদ বিবরণী জমা দেবার পরপরই আবজাল দম্পতি বিদেশে পালিয়ে যান। বর্তমানে তাঁরা অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অনেক আগেই বাড়ি কেনেন আবজাল। এখন সেখানেই পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।

আবজালের দেশছাড়ার খবরের সত্যতা নিশ্চিত না করলেও দুদক বলছে, এমন খবরে তারা কিছুটা হতাশ। কারণ আবজাল হোসেন সত্যি দেশছেড়ে থাকলে তাতে তদন্ত প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে শাস্তি নিশ্চিত করাও কঠিন হয়ে পড়বে। আবজাল যাতে কোনওভাবেই বিদেশ পালাতে না পারে সে জন্য আগেই ইমিগ্রেশনে চিঠি দেয়া হয়েছিল।

গত জুন মাসের ১০ তারিখ ইমিগ্রেশন থেকে দুদককে জানানো হয়, আবজাল হোসেন নামের কোনও যাত্রীর বিদেশ গমনের বিষয়ে কোনও তথ্য তাদের কাছে নেই। এরপর দুদক বাংলাদেশ বিমানে চিঠি দেয়।
কিন্তু বাংলাদেশ বিমান থেকে আবজালের বিমান ভ্রমণ সম্পর্কে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। শেষমেশ বাংলাদেশে কার্যক্রম চলমান আছে এমন সব বিমান সংস্থার কাছে চিঠি দিয়েছে দুদক। তাদের কাছ থেকে প্যাসেঞ্জার লিস্টও চাওয়া হয়েছে।

সূত্র বলছে, আবজাল দম্পতির সবসম্পদ দেখভাল করছেন তাঁর আত্মীয়স্বজন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরে কর্মরত তাঁর কয়েকজন অনুগত শ্যালক ও ভাসতে আবজালের পক্ষে প্রভাবশালী মহলে তদবির শুরু করেছেন। বিদেশে বসে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রভাবশালী একজন ঠিকাদারও তাঁর পক্ষে কাজ করছেন। কেউ কেউ গুণ গাইছেন। হ্যাঁ, গাইবেনইতো। অনেকেই নুন খেয়েছেন। গুণ গাইতে হবে না?

এ কারণে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি বড় অংশ মনে করে, যতই তদন্ত-অনুসন্ধান হোক না কেন আবজালের কিছুই হবে না। কারণ এর আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোনও দুর্নীতিবাজের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। মামলা হলেও ফাঁকফোকর দিয়ে তিনি বেরিয়ে যাবেন।

সূত্র আরও বলছে, দুদকের অনুসন্ধান শুরুর পরপরই আবজাল হোসেন তাঁর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে দেন। এরপর তিনি ভুয়া রেজিস্ট্রেশনের একাধিক নম্বর ব্যবহার করেন। তবে তাঁর ফোনালাপ বিশ্লেষণ করে দুদক জানতে পারে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে তিনি দুদকের অনুসন্ধান নিয়ে কথাবার্তা বলেন। এ ছাড়া সরকারের প্রভাবশালী মহলেও নিজেকে বাঁচাতে নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন।
প্রসঙ্গত, আবজাল হোসেনের বয়স এখন ৪৫। বাড়ি ফরিদপুর সদর। ১৯৯২ সালে তিনি তৃতীয় বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। এরপর আর পড়ালেখা করেননি। ওই সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে দৈনিক মজুরিভিত্তিক বদলি কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন।

পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হলে আবজালের ভাগ্য খুলে যায়। এরপর তাঁকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ক্যাশিয়ার পদে পোস্টিং দেয়া হয়। ১৯৯৮ সালে তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরে বদলি হয়ে আসেন। পদোন্নতি পেয়ে হন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা।

এমন ভাগ্যবান আবজাল কি কেবল স্বাস্থ্য অধিদফতরের বরখাস্তকৃত আবজাল একাই? না। এই আবজালদের সংখ্যা অনেক। অসংখ্য। সুযোগ পেলেই রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পদ লুট করে রাতারাতি ধনকুবের বনে যান। সুইজ ব্যাংকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যাংকে টাকা রাখেন। অঢেল সম্পদ দেশে-বিদেশে জমা করেন। হরিলুটের তথ্য ফাঁস হলে কিছুদিন হৈচৈ হয়। মামলা-মোকদ্দমাও চলে। প্রতিষ্ঠান থেকে বরখাস্ত করা হয় আবজালদের। এতে কী হয় তাঁদের? চাকরিতে বহাল থাকলে যা বেতন হিসেবে পেতেন, তার কয়েক সহ¯্র গুণ অর্থ আফজালরা আগেই মেরে দিয়ে ধনকুবেরে পরিণত হন। লুটের মাল ছিটিয়ে অনেককেই আফজালেরা সহজে বস করতে পারেন। তাই তাঁদের তেমন কিছু হবার নজিরও সৃষ্টি হয় না। আমরা এমনই দুর্ভাগা জাতি। সব লুটেরা বাটপার আমাদের জ্ঞাতি। আফজালদের কিছু হবে কেমনে?

স্বাস্থ্য অধিদফতরের আবজাল কি একজনই? হাজার হাজার আবজাল আছেন সর্বত্র। তাঁদের সঙ্গী-সহযোগীরও অভাব নেই। লুটেরা আবজাল হতে লেখাপড়া বা বিদ্যাবুদ্ধির তেমন দরকার নেই। টেনেটুনে মেট্রিক-ইন্টারমিডয়েট হলেই চলে। ব্যাংকের হিসেবে খুলে সেটা পরিচালনা করতে পারলেই কেল্লা ফতে। হরিলুটের বাতাসা একাউন্টে কেবল জমতেই থাকবে।

https://www.dailysangram.com/post/382547