১৭ জুন ২০১৯, সোমবার, ৭:১৬

১৬ জুন ১৯৭৫ : কালোদিবসের ইতিহাস

আশিকুল হামিদ : গতকাল, ১৬ জুন ছিল সংবাদপত্রের কালোদিবস। সরকারবিরোধী সাংবাদিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন দিনটিকে ‘সংবাদপত্রের কালোদিবস’ হিসেবে পালন করেছে। এর পেছনে রয়েছে ইতিহাস। দিনটির কারণ তৈরি করে গেছে স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় বসার পর থেকেই সরকারের সমালোচনা এবং বিরোধী রাজনীতিকে সহিংস পন্থায় দমনের পদক্ষেপ নিয়েছিল ওই সরকার। সরকারের বিরোধিতাকে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের পন্থায় রাষ্ট্র ও স্বাধীনতার বিরোধিতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর ফলে গণতান্ত্রিক বিরোধী দলের তো বটেই, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সুস্থ বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।

সরকারের উদ্যোগে দলীয় সন্ত্রাসকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, লালবাহিনী এবং জাতীয় রক্ষীবাহিনীসহ নানা বাহারী নামের বাহিনীকে বিরোধী দল দমনের জন্য লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল। পল্টন ময়দানের জনসভায় বিরোধী দলের ওপর ‘লাল ঘোড়া দাবড়ে’ দেয়ার হুমকি দিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। কর্মীদের বলেছেন ‘সুন্দরী কাঠের লাঠি’ হাতে নিতে। সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারকে হত্যার পর সংসদের ভাষণে জানতে চাওয়া হয়েছে, ‘কোথায় গেলো সিরাজ সিকদার?’

ক্ষমতাসীনদের অনুসরণ করেছিলেন তাদের সহযোগীরাও। আওয়ামী লীগের ‘বি’ টিম নামে পরিচিত দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি- সিপিবির নেতা মনি সিংহ বায়তুল মোকাররমের সমাবেশে সংসদের বাইরে বিরোধী দলের প্রধান নেতা মওলানা ভাসানীকে ‘টুকরা টুকরা’ করে ফেলার হুংকার দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে প্রকাশিত বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা গেছে, প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের মাত্র সাড়ে তিন বছরে বিরোধী দলের ৩০ থেকে ৩৭ হাজার নেতা-কর্মী প্রাণ হারিয়েছিলেন। তাদের হত্যা করা হয়েছিল।

রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি সংবাদপত্রের ওপরও প্রথম আওয়ামী সরকার প্রচ- দমনের অভিযান চালিয়েছিল। সরকার শুধু ১৯৬০ সালে সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান সরকারের প্রবর্তিত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স বহাল রাখেনি, ১৯৭৩ সালে সে কালাকানুনটিকেই ‘মুদ্রণযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স’ নামে প্রবর্তন করেছিল। এই অধ্যাদেশের আড়াল নিয়ে একদিকে সরকার বিরোধী সংবাদ প্রকাশনার ওপর নিয়ন্ত্রণ চাপানো হয়েছে, অন্যদিকে একের পর এক নিষিদ্ধ হয়েছে সংবাদপত্রের প্রকাশনা। ১৯৭২ সালেই মওলানা ভাসানীর ‘হক-কথা’ ছাড়াও নিষিদ্ধ হয়েছিল পাঁচটি সাপ্তাহিক- ‘গণশক্তি’, ‘লাল পতাকা’, ‘নয়াযুগ’, মুখপত্র’ ও ‘স্পোকসম্যান’। চট্টগ্রামের দৈনিক ‘দেশবাংলা’ এবং জাসদের দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ও নিষিদ্ধ হয়েছিল। ‘হক-কথা’ সম্পাদক সৈয়দ ইরফানুল বারী এবং দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ সম্পাদক কবি আল মাহমুদসহ কয়েকজন সম্পাদককেও গ্রেফতার করেছিল সরকার।

কিন্তু এতকিছু করেও বিরোধী রাজনীতিকে নির্মূল করা দূরে থাকুক, দমন করাও সম্ভব হয়নি। সরকারের বিরুদ্ধে নতুন এক উপলক্ষ বা হাতিয়ারের যোগান দিয়েছিল ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল সে দুর্ভিক্ষে। দরকার যখন ছিল সকল দলকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালানো সরকার তখন তথাকথিত ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ ডাক দিয়েছিল। এর পরিষ্কার উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং সরকার বিরোধিতাকে সমূলে উৎখাত করা। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের মাত্র কয়েক মিনিট স্থায়ী অধিবেশনে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা ও নির্দেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সংশোধনীর আগে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সংশোধনী পাস করার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সে ছিল এক বিচিত্র অবস্থা।

চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং সকল রাজনৈতিক দল বাতিল ও বিলুপ্ত করে দেশে একটি মাত্র দল রাখার বিধান করা হয়। এই সংশোধনীর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি একমাত্র দল বাকশাল গঠন করেন। তার নির্দেশে তাকেই চেয়ারম্যান করে ৬ জুন বাকশালের ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের চেয়ারম্যান শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি দৈনিক ‘ইত্তেফাক’, দৈনিক ‘বাংলা’, ‘বাংলাদেশ অবজারভার’ ও ‘বাংলাদেশ টাইমস’ ছাড়া দেশের সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৬ জুন। সরকারের মালিকানায় নেয়ার ফলে এসব দৈনিকে ক্ষমতাসীনদের গুণকীর্তন ছাড়া অন্য কোনো খবর পাওয়া যেতো না। ওদিকে বেকার হয়ে পড়েছিলেন সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবীরা। জাতি বঞ্চিত হয়েছিল সঠিক সংবাদ জানার মৌলিক অধিকার থেকে। এ অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছিল সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর (১৫ আগস্ট, ১৯৭৫)।

গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ হলেও বাকশাল গঠনের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে যুক্তি কম দেখানো হয়নি। বলা হয়েছে, ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নাকি ‘মহৎ উদ্দেশ্য’ নিয়ে ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে বাকশাল গঠন করেছিলেন! অন্যদিকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু এসব যুক্তিকে সমর্থন করে না। যে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’র যুক্তি দেখানো হয়ে থাকে তার জন্য দায়ী ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বব্যাপী দুর্নীতি, কালোবাজারি ও চোরাচালানসহ প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা, রাজনৈতিক নির্যাতন ও হত্যাকান্ড এবং সবশেষে ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দরকার যখন ছিল ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান কিংবা জরুরি ভিত্তিতে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করা, ক্ষমতাদর্পী অওয়ামী লীগ সরকার তখন উল্টো রাজনৈতিক আন্দোলন ও সরকার বিরোধিতার পথ বন্ধ করে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর পর্যায়ক্রমে এগিয়েছিলেন বাকশালের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পথে, যার শিকার হয়েছিল দেশের সংবাদপত্রও।

সমগ্র এই প্রক্রিয়া ও কর্মকান্ডের উদ্যোক্তা, নির্দেশদাতা, নিয়ন্ত্রক ও লাভবান ছিল রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন সরকার। সর্বময় ক্ষমতাও ওই সরকারের হাতেই কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ বলা হলেও বাকশাল বাস্তবে আওয়ামী লীগেরই নামান্তর মাত্র ছিল (বাকশাল বলতে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বোঝানো হয়েছিল, ‘আওয়ামী লীগ’ নামটিকে বাদ দেয়া হয়নি)। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে যদি আওয়ামী লীগের ‘বি-টিম’ হিসেবে পরিচিত দুটি দল ন্যাপ (মোজাফফর) এবং সিপিবির লজ্জাকর পরিণতির উল্লেখ করা হয়। স্বাধীনতার পর প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই দল দুটি সরকারের লেজুড়বৃত্তি করেছে, ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে দল দুটিকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ‘ত্রিদলীয় ঐক্যজোট’ও গঠন করেছিলেন। কিন্তু ১১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেতৃত্বের অবস্থান পাননি এমনকি ‘কমরেড’ মনি সিংহ এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মতো দলীয় প্রধানরাও। এই দু’জনকেসহ দুই দলের মাত্র ছয়জনকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেয়া হয়েছিল, কিন্তু তাদের ক্রমিক সংখ্যা ছিল ৭০-এর ঘরে। ওদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামী জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীসহ অন্য কোনো নেতাকেও বাকশালে যোগ দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। সুতরাং ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ গঠনের যুক্তিকে রাজনৈতিক অসততা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

‘সাময়িক কালের’ জন্য গঠন করা হয়েছিল ধরনের যুক্তিও গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি। কারণ, সে ধরনের কোনো কথা চতুর্থ সংশোধনীর কোথাও কিংবা বাকশালের গঠনতন্ত্রে ছিল না। গঠনতন্ত্রের বিভিন্ন ধারা-উপধারা বরং এ কথাই প্রমাণ করেছে যে, রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য নিয়েই বাকশাল গঠন করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ও কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন এবং সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন দেয়া থেকে বাকশাল, রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিটি বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতা ছিল শুধু চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের। তিনি এমন একজন চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন, যাকে নির্বাচিত করার কোনো পন্থা বা বিধানেরই উল্লেখ ছিল না বাকশালের গঠনতন্ত্রে। ছিল না সংবিধানেও। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে একথাই ঘোষণা করা হয়েছিল যে, শেখ মুজিব আজীবন রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের চেয়ারম্যান থাকবেন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের কখনো মৃত্যু ঘটতে পারে কিংবা তার অনুপস্থিতিতে অন্য কাউকে দলের চেয়ারম্যান বা দেশের রাষ্ট্রপতি বানানোর প্রয়োজন দেখা দিতে পারেÑ এমন চিন্তা বা অনুমানও বাকশাল গঠনকালে করা হয়নি।

উল্লেখ্য, চতুর্থ সংশোধনী পাস করার পর গণভোটেরও আয়োজন করা হয়নি। অথচ এ ধরনের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোতে জনমত যাচাই এবং গণভোট অনুষ্ঠান করা গণতন্ত্রে একটি অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। অন্যদিকে বাকশাল গঠন এবং চতুর্থ সংশোধনী পাস করার সময় এ ধরনের গণতন্ত্রসম্মত কর্তব্য ও পদক্ষেপের চিন্তাই করা হয়নি।

সময়ের পরিবর্তন হলেও দেশপ্রেমিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম সরকারের পথেই এগিয়ে চলেছে। এজন্যই রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি আক্রান্ত হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমও। দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে, এখনো দৈনিকটিকে প্রকাশ করতে দেয়া হচ্ছে না। আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কয়েকবার শুধু গ্রেফতার করা হয়নি, রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনও চালানো হয়েছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের দু’বার নির্বাচিত সভাপতি শওকত মাহমুদসহ আরো কয়েকজন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভিকেও নিষিদ্ধ করেছে সরকার। একযোগে অ্যাডভাইস বা পরামর্শের আড়ালে চাপানো হচ্ছে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা। তথ্য-প্রযুক্তি আইনের আড়াল নিয়ে অনলাইন পত্রিকাগুলোর ওপরও খবরদারি চালানো হচ্ছে।

অর্থাৎ বর্তমান সরকারও বাকশাল সরকারের মতোই সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। একই কারণে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমসেবীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও বাকশালের ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা মনে করি, ক্ষমতাসীনদের উচিত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া এবং সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে গণতন্ত্রের বিকাশকেও বাধামুক্ত করা।

http://www.dailysangram.com/post/379356