১৭ জুন ২০১৯, সোমবার, ৭:১০

শহররক্ষা বাঁধ তুমি কার?

রাজশাহী পাউবো-ভাঙা রেকর্ড দু’জন দু’জনার

‘বিশেষ সমঝোতায়’ পানি ও বিদ্যুৎসহ ভবন নির্মাণ

রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন জিরো টলারেন্স নিয়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে। রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল নগরীর রেললাইনের পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে। যখন দেশের বিভিন্ন স্থানে নদীর দু’ধারের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রয়েছে, তখন রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ড পদ্মা তীর এবং শহররক্ষা বাঁধের অবৈধ দখলদারদের ব্যাপারে রহস্যজনক কারণে সুখনিদ্রায় রয়েছে।

এসব অবৈধ দখলমুক্ত করে নদী তীর ও শহররক্ষা বাঁধকে সুরক্ষার জন্য নগরীর বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান মানবন্ধন স্মারকলিপিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। আর পানি উন্নয়ন বোর্ড রয়েছে চুপচাপ। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ মানুষ বলছে, বিশেষ সমঝোতায় এসব হচ্ছে।

রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধের একদিকে চলছে সৌন্দর্য্য বর্ধনের কাজ, আর অন্যদিকে চলছে বাঁধ দখলের মহোৎসব। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, বাঁধের কোল বিক্রয় হচ্ছে। সেখানে অবৈধভাবে গড়ে উঠছে নানা স্থাপনা। দখলে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে শহর রক্ষা বাঁধ। পশ্চিমের শ্রীরামপুর থেকে শুরু হয়ে পূর্বে শ্যামপুর পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার জুড়ে চলছে দখলের কারবার।

এর আগে বাঁধের নীচে পাঠানপাড়া এলাকায় সিটি কর্পোরেশন দৃষ্টিনন্দন স্থাপন গড়ে তোলে নগরবাসীর বিনোদনের জন্য। বড়কুঠি ও ফুদকীপাড়া এলাকায় নানা স্থাপনা করে বিনোদনের ব্যবস্থা ও বাঁধ তীর সুরক্ষা করেছে। একটু ফুসরত পেলে নগরবাসী ছুটে যান পদ্মার এসব স্পটে। সিটি কর্তৃপক্ষ পদ্মার তীর ঘেঁষে ও বাঁধের ওপর পাকা রাস্তা করে দিয়েছে সাধারণ মানুষ যাতে পায়ে হেঁটে বা সকাল-বিকেল বায়ু সেবন করতে পারে। বাঁধের ওপর দিয়ে যাতে যানবাহন চলাচল করতে না পারে সেজন্য পিলার দিয়ে ব্যারিকেডও করা হয়।

বাঁধের ওপর রাস্তার পিলার নেই। চলে সাইকেল, মটরসাইকেল, অটোরিকশা। শ্যামপুর এলাকায় বালির ট্রাক দাপিয়ে বেড়ায়। বড়কুঠি থেকে শ্যামপুর পর্যন্ত শহর রক্ষা বাঁধ সরেজমিন প্রত্যক্ষ করে দেখা যায় বাঁধ দখল করে গড়ে উঠছে বিভিন্ন স্থাপনা। বিশেষ করে আলুপট্টি এলাকায় দৈনিক বার্তা অফিসের পেছনে বাঁধ সংলগ্ন পুকুর দখল করে ঘরবাড়ি উঠে গেছে। অস্তিত্ব নেই পুকুরটির।

শাহমখদুম কলেজ হতে তালাইমারী পর্যন্ত দখলবাজী আর বিক্রি চলছে সমানে। বাঁধের নীচে আগে পানি নিষ্কাশনের ত্রিশ চল্লিশ ফুট চওড়া ড্রেন ছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভাষায় নয়নজুলি। সিটি কর্তৃপক্ষ এ কাঁচা ড্রেনের মধ্যে তিন ফুটের একটা পাকা ড্রেন করার পর তার দুধার ভরাট ও দখল হয়ে ঘরবাড়ি দোকান পাট উঠেছে এবং এখনও উঠছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় এবং স্থানীয় নেতাদের ছবি সম্বলিত সাইনবোর্ড দিয়ে দখল করা হয়েছে। কেউ নৈশ বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড দিয়ে ভবন নির্মাণ করে পরে সাইনবোর্ড খুলে নিয়েছে।

দখলদারিত্বে জনপ্রতিনিধিরাও পিছিয়ে নেই। বিভিন্ন সমিতির নামেও সাইন বোর্ড ঝোলানো আছে। পঞ্চবটি হতে তালাইমারী পর্যন্ত বাজে কাজলার বড় পানির খালটি জাল দলিল করে মামলা দিয়ে দখল করার অপচেষ্টা কম হয়নি।

বাঁধের উত্তর পাশের রাজশাহী-নাটোর মহাসড়ক ফোর লেন করার কাজ শুরু করেছে সিটি কর্তৃপক্ষ। এর অংশ হিসাবে বাঁধের কোল ঘেষে ড্রেন ফুটপাথ নির্মাণ হয়েছে। বাঁধের উত্তর কোলে ফের দৃষ্টিনন্দন বাগান করার পরিকল্পনা রয়েছে। দক্ষিণ কোলেও পানির ড্রেনটিকে পূর্ব পশ্চিম লম্বালম্বি লেকসহ বেশ কিছু পরিকল্পনার কথা জানালেন সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক। তিনি মাল্টিমিডিয়ায় পরিকল্পনার বিষয়টা দেখান। যেটি বাস্তবায়ন হলে অন্যরূপ পাবে বাঁধ। অন্যদিকে বাঁধও সুরক্ষা হবে। সামাজিক পরিবেশের উন্নয়ন হবে। কেননা এখন বাঁধের ওপর হাঁটতে গেলে পাওয়া যায় গাঁজার উৎকট গন্ধ। বাঁধের নীচের বস্তিতে রয়েছে মাদকের আখড়া। ছিনতাইকারী মান্তানদের নিরাপত্তার আশ্রয়স্থল। সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অবৈধ দখলের কারণে কোন কিছু ঠিক রাখা যাচ্ছে না। সিটি কর্পোরেশন যে উদ্যোগ নিয়েছে তা সফল করার ক্ষেত্রে এসব অবৈধ দখলদাররা বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

এ বাঁধটি এখনো বন্যার হাত থেকে শহর টিকিয়ে রেখেছে। পদ্মা মরে গিয়ে তার বুকে উঁচু বিশাল বালিচর জমেছে। বিপদের কথা হলো, পদ্মারচর থেকে শহরের মাটি চার পাঁচ ফুট নীচে। সারা বছর পদ্মায় পানি না থাকলেও ফারাক্কার ওপারের বন্যা সামলাতে সবকটি গেট খুলে দেয়। তখন মরা পদ্মাও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। বরং আগের চেয়ে এখন ঝুঁকি বেশি।

অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ বলেন, সব কাগজপত্র থাকা সত্তে¡ও নির্মাণ করতে গেলে বিভিন্ন দফতর থেকে ভোগান্তি পোহাতে হয় বিদ্যুৎ পানি সংযোগ নিতে। অথচ বাঁধের ওপর স্থাপনাকারীদের কেউ কিছু বলে না। বিশেষ সমঝোতায় পানি, বিদ্যুৎসহ ভবন হয়ে যায়। যে বাঁধ নিয়ে এত কথা সেই বাঁধের মালিক পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সবাই দুষছেন বাঁধের এ বেহাল দশার জন্য। তাদের কারো কারো সাথে বিশেষ সমঝোতা ছাড়া এমন দখলবাজী সম্ভব নয়।

বরাবর পানি উন্নয়ন বোর্ড দায়সারা রেকর্ড বাজিয়ে বলেন, আমরা অবৈধ তালিকা করেছি। ২০১৫ সালে দখলদারদের পনের দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে তা সরানোর নোটিশ দিয়েছিল। কিন্তু ঐ পর্যন্ত। কেউ অবৈধ স্থাপনা সরায়নি। বরং আরো বেড়েছে। ২০০৭ সালে যৌথবাহিনী বাঁধের উপরের সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছিল। পরবর্তীতে পানি উন্নয়ন বোর্ড তা ধরে রাখতে পারেনি। এই না পারাকে সর্ষের মধ্যে ভুত আছে বলে অনেকে মন্তব্য করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড রাজশাহী অফিসের সংশ্লিষ্টরা ভাঙা রেকর্ডের মতো বলে চলেছেন, আমরা তালিকা করেছি। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে। বাঁধের ওপর কোন স্থাপনা আইন অনুযায়ী বৈধ নয়। কিন্তু বাস্তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

https://www.dailyinqilab.com/article/213460