২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ১১:০৮

পদক্ষেপ না নিলে পুরান ঢাকায় আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির শঙ্কা

অপরিকল্পিত অবকাঠোমোতে ভবন নির্মাণ ও রাসায়নিক কারখানার কারণে বার বার মৃত্যুপুরীতে পরিণত হচ্ছে পুরান ঢাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ছাড়াও ভবনে আগুন নিভানোর নিজস্ব ব্যবস্থা না থাকা, ভবনের মালিক ও রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ ব্যবসায়ীদের আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হওয়া ও অসচেতনায় ঘটছে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এর বইরে ভবন নির্মাণে অবকাঠামোগত সমস্যাও অনেক প্রকট। কোনো ভবন নির্মাণে বিন্দুমাত্র নিয়ম মানা হয়নি এ এলাকায়। বিশাল বিশাল ভবনে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত লোক বাস করলেও রাস্তার অবস্থা এত করুণ যে, অনেক রাস্তায় রিকশাও চলাচল করতে পারে না। যার কারণে যে কোনো বিপর্যয়ে ফায়ার সার্ভিস প্রবেশ কিংবা ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারে না। এতে করে প্রাণহানির ঘটনা বেশি ঘটে। অবকাঠামো পরিবর্তনসহ বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে এখনি পদক্ষেপ না নিলে এ এলাকা আরো ভয়াবহ পস্থিতিতে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।

খ্যাতনামা প্রকৌশলী, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ভিসি ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর মতেÑ মূলত, রাসায়নিকের গুদাম থাকার কারণেই পুরান ঢাকায় আগুনের ভয়াবহতা এত বেশি ছিল। তিনি জানান, নিমতলীর ঘটনার পর তারা এ এলাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের কারখানা সরিয়ে নিতে সরকারকে সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু সরকার তা করেনি। তাই এখনি পদক্ষেপ নেয়া না হলে আগামীতে আরো ভয়বহ পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

এর আগে নিমতলীর ঘটনার পর আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে পুরান ঢাকার জনবসতি থেকে কেমিক্যাল কারখানা, গুদাম ও দোকান সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে একাধিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর শিল্প মন্ত্রণালয়, বিস্ফোরক পরিদফতর, ফায়ার সার্ভিস ও পরিবেশ দফতর এ উদ্দেশ্যে মাঠে নামলেও দুই-তিন মাসের মধ্যে তাদের উৎসাহে ভাটা পড়ে। রাজধানীর পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা, দোকান এবং গুদাম সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত লাল ফিতায় আটকা পড়ে।

এ বিষয়ে দেশের একজন খ্যাতিমান স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, এ কারণেই এ প্রাণহানির ঘটনাকে ঠিক দুর্ঘটনা বলা যাবে না। এটি অবহেলিত হত্যাকাণ্ড। কারণ সংশ্লিষ্ট সরকারী সংস্থা, রাজউক, সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ভবন মালিক পর্যন্ত কেউ এর দায় এড়াতে পারবেন না। তিনি বলেন, আমরা জানি কোথায় সমস্যা, কী করণীয়। এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক। শেষে পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে। যাতে সরকারি সংস্থাগুলোও সংশ্লিষ্ট ছিল। কিন্তু শুধু বাস্তবায়নে যত সমস্যা।

তিনি বলেন, নিমতলী ঘঠনার পর ১৭টি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। তারমধ্যে ছিল রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। এর বাস্তবায়নে তাদের প্রত্যেকের করণীয়ও নির্ধারণ ছিল। কিন্তু ততে কোনো লাভ হয়নি। সংশ্লিষ্টরা নানা অজুহাত দেখিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে দেয়নি। যার ফলে সর্বস্তরের অবহেলা লোভ ও নিষ্ক্রিয়তায় আজকের এই ঘটনা। তিনি বলেন, এ রকম চলতে থাকলে আরো অজ¯্র ঘটনা ঘটতে থাকবে। কারণ এ এলাকাগুলোতে এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে শুধু আগুন লাগলেই অসংখ্য মানুষ মারা যাবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্যমতে, সিটি করপোরেশন দুই থেকে আড়াই হাজার লাইসেন্স দিলেও পুরানো ঢাকায় রয়েছে ২৪ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক দাহ্য বস্তুর গুদাম। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ বসত বাড়ি ভাড়া নিয়ে পরিচালিত হয়ে আসছে। ২০০ ধরনের ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের ব্যবসা রয়েছে এলাকাজুড়ে। এরমধ্যে রাজধানীর লালবাগ, ইসলামবাগ, হাজারীবাগ, কোতোয়ালি, চকবাজার, বংশাল, কামরাঙ্গীরচর, শ্যামপুর ও কদমতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় অলিগলিতেই রয়েছে হাজার হাজার কারখানা। অবৈধ কারখানার মধ্যে ব্যাটারি তৈরি, নকল ওষুধ, নিষিদ্ধ পলিথিনব্যাগ, প্লাস্টিক সরঞ্জাম, নকল বৈদ্যুতিক ক্যাবল, ঝালাই, খেলনা ও জুতা-স্যান্ডেলসহ শতাধিক পণ্য তৈরির কারখানা।

এ ছাড়া, কেমিক্যাল কারখানা, গুদাম পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদফতর, জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদফতর, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র বা লাইসেন্স গ্রহণের বিধান রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল কারখানা ও গুদাম পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সংস্থার (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান বলছেন, পুরান ঢাকাকে পরিবর্তন ছাড়া এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। কারণ, পুরান ঢাকা প্রথম থেকেই ঘিঞ্জিভাবে গড়ে উঠেছে। থাকার বাসায় কারখানা, গোডাউন ভাড়া দেয়ায় তা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাতে করে প্রতিটি বাসা আবাসিকের চরিত্র হারিয়েছে। কিন্তু নিমতলীর ঘটনার পর তা কোনোভাবেই ছাড় দেয়া ঠিক হয়নি। যারা ভাড়া দেন এবং নেন কেন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলো না। আর চকবাজারের ঘটনার পর আর কোনো যুক্তিই কিন্তু দাঁড় করানো যাবে না। সুতরাং, পুরনো ঢাকাকে নিরাপদ করতে হলে সরকারের কিছু পরিকল্পনা দিতে হবে। তাদের বসবাসযোগ্য জায়গায় আনতে হবে। নয়তো এ রকম ভয়াবহ ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/390474