২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ১১:০১

ধ্বংসস্তূপে লাশ খুঁজছেন স্বজনেরা

ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ করেছে সিআইডি : ৪৬টি লাশ শনাক্ত

ছোট্ট সানিন। বয়স সবেমাত্র পাঁচ বছর। মামার কোলে চড়ে এসেছে ঢাকা মেডিক্যাল মর্গে। ছোট্ট এই শিশুটির ফ্যাকাশে মুখ আর নির্বাক চাহনি। মাকে খুঁজছিল। শিশুটি তার মামাকে বার বার বলছিল, মামা আম্মু কোথায়? আম্মুকে দেখব। ভাগনীর এমন আবদারে মামা ইসরাফিল অঝোরে কেঁদেছেন, কোনো উত্তর দিতে পারেননি। ছোট্ট মেয়েটি জানে না তার মুখ থেকে নেয়া বাক্কাল কোষের ডিএনএ নুমনায় মাকে হয়তো পাওয়া যাবে তবে জীবিত নয়, পুড়ে অঙ্গার হওয়া। গত বুধবার দুই বোনকে বাসায় রেখে ওষুধ কিনতে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি সানিনের মা হালিমা। সানিনের পাঁচ মাস বয়সী ছোট্ট বোনও সারাক্ষণ কাঁদছে, মায়ের জন্য।

বড় ভাই সাজ্জাদ হোসেন দুলু খুঁজছেন ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে। তিনি বলেন, মা বলেছেন, মঞ্জুরে ছাড়া তুই ঢাকা থেকে আসিস না। কোথায় পাবো ভাইকে। মর্গে অঙ্গার হয়ে যাওয়া লাশগুলোর মধ্যে খুঁজেছি। খুঁজেছি চুড়িহাট্টার ধ্বংসস্তূপেও। কি নিয়ে বাড়ি যাবো, বলতে পারেন? এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল মর্গের সামনে কাঁদছিলেন তিনি।

এ দিকে পোড়া লাশের মধ্য থেকে গতকাল শুক্রবারও সোলায়মান হোসেন (২০) নামে একজনের লাশ শনাক্ত করে নিয়ে গেছেন স্বজনরা। দুপুরে নিহতের ভগ্নিপতি শফিকুল ইসলাম লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুরে যান। এভাবে ভগ্নিপতির কাঁধে শ্যালকের কফিন। বাবার কাঁধে সন্তানের কফিন। স্বামী হারিয়েছে স্ত্রীকে। সন্তান হারিয়েছে মাকে। ভাই হারিয়েছে ভাইকে। অবুঝ শিশু জানেই না তার বাবা আর নেই। এমন অসংখ্য বেদনাবিধুর গল্প জড়িয়ে আছে চকবাজার ট্র্যাজেডিতে।

এ দিকে গতকালও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের নিচতলার ধ্বংসস্তূপ থেকে এক শিশুর পোড়া হাত উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। গত রাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৪৬টি লাশ শনাক্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার ৪৫টি লাশ শনাক্ত করা হয়। বাকি একটা শনাক্ত করা হয় গতকাল। এ ছাড়া পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) দুইটি টিম ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছে। রাতে এ খবর লেখা পর্যন্ত ১৮টি লাশের বিপরীতে ৩০ স্বজনের ডিএনএ নমুনা নিয়েছে সিআইডি। এ ছাড়া গতকাল চুড়িহাট্টায় রাস্তার ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করছে সিটি করপোরেশন।

শিশু সানিনের বাবা সুমন বলেন, দুর্ঘটনাস্থল থেকে ২০০ গজ দূরে তাদের বাসা। নিজের ব্যাগের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চকবাজারেই। বুধবার রাতে আমার মেয়ে সানিন অসুস্থ ছিল। ওর জন্যই হালিমা ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে যান। যাওয়ার সময় বলেছিল, ওষুধ কিনেই ফিরবে বাসায়। কিন্তু ফেরা হয়নি।

বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ে সুমন বলেন, চুড়িহাট্টার আগুন আমাদের বাসা পর্যন্ত আসেনি। কিন্তু ভাগ্যই কি না হালিমাকে টেনে নিলো সেই আগুনের কাছে! আমার এই দুই শিশুর কী হবে? তাদের মাকে আমি এখন কোথা থেকে এনে দেবো?

সানিনের মামা ইসরাফিল বলেন, মর্গে আসার পর সানিন আস্তে আস্তে আমাকে বলে, মামা আজ কিন্তু মাকে নিয়েই বাসায় যাবো। মাকে ছাড়া বাসায় ফিরব না। তিনি জানান, কোলে রেখে সানিনের বাক্কাল কোষ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে সিআইডি।

নিখোঁজ আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ভাই সাজ্জাদ হোসেন দুলু গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল মর্গে ডিএনএ নুমনা দিতে এসে বলেন, ভাইকে তো খুঁজে পেলাম না। পোড়া লাশ উল্টে পাল্টে দেখেছি। কিন্তু ভাইকে মেলাতে পারিনি। মাকে গিয়ে কি জবাব দেবো। মা বলেছেন, মঞ্জুকে ছাড়া তুই ঢাকা থেকে ফিরবি না।

তিনি জানান, মঞ্জুর হায়দার মেডিকো নামে তাদের একটা ফার্মেসি ছিল চুড়িহাট্টায়। ২০০২ সালে সেটি ভাই মঞ্জুকে ছেড়ে দিয়ে অন্য ব্যবসা করতেন। এর পর থেকেই ওই ফার্মেসির ব্যবসা করত মঞ্জু। ভাইয়ের খোঁজে তিনি আর তার আরেক ভাই ডিএনএ নমুনার জন্য রক্ত দিয়েছেন। কথা বলতে গিয়ে সাজ্জাদ হোসেন দুলু একপর্যায়ে কেঁদে কেঁদে বলেন, রানা, রাজু, আনোয়ার, হিরা ও নাসিরকে খুঁজে বের করতে পারলেও ভাই মঞ্জুর লাশটা খুঁজে পেলাম না। যদি লাশটাও পেতাম তাহলে মনটাকে একটু বুঝানো যেত।

একজনের লাশ শনাক্ত : সোলায়মান হোসেন (২০) নামে একজনের লাশ গতকাল শনাক্ত করে নিয়ে গেছেন স্বজনেরা। সোলায়মানের বাবা মরহুম সোহরাব হোসেন। গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুরে। তিনি লালবাগ শহীদনগর বৌ বাজারে ভাড়া থাকতেন। লাশ শনাক্ত করেন নিহতের ভগ্নিপতি শফিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, সোলায়মান ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের সামনে ভ্যানগাড়িতে করে ঝালমুড়ি, টিকাসহ বিভিন্ন খাবার বিক্রি করতেন। বিক্রি শেষে দুর্ঘটনার রাতে ওই পথ দিয়ে বাসায় ফেরার পথে আগুনে মারা যান। সোলায়মানকে নিয়ে এ পর্যন্ত ৪৬টি লাশ শনাক্ত করে নিয়ে গেছেন স্বজনেরা। এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ৪৫টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে ঢাকা জেলা প্রশাসন।

ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের শনাক্তকরণের জন্য গতকাল ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা ১৮টি লাশের জন্য ৩০ স্বজনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে স্বজনদের রক্ত ও বাক্কাল কোষের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।

সিআইডির এসপি মোহাম্মদ রিয়াজুল হক বলেন, সিআইডির ক্রাইম সিন ও ডিএনএ ল্যাবের দু’টি টিম স্বজনদের নমুনা সংগ্রহ করি। এর আগে বৃহস্পতিবার যে ২১টি লাশ শনাক্ত করা যাচ্ছিল না সেসব লাশের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এ ক্ষেত্রে রক্ত হলে রিপোর্ট দ্রুত পাওয়া যায়। তবে পুড়ে যাওয়া লাশের রক্ত না পাওয়ায় লাশগুলোর দাঁত, হাড় এবং মাসলের টিস্যু থেকে ডিএনএর জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ধারণা করা হচ্ছে লাশের প্রোফাইল ও স্বজনদের ডিএনএ নমুনা নিয়ে প্রোফাইল সংগ্রহ করে মিলাতে প্রায় এক মাস লেগে যাবে।

সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের ডিএনএ অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যানালিস্ট নুসরাত ইয়াসমিন বলেন, আজকে স্বজনদের কাছ থেকে যে নমুনা নিয়েছি তা পরীক্ষায় খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। চার সপ্তাহের মধ্যে আমরা তা সম্পন্ন করতে পারব। তবে ঘটনাস্থল থেকে দগ্ধ লাশের যেসব নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে তা পরীক্ষা করা সময়সাপেক্ষ। একেকটা আলামতের ওপর তা নির্ভর করছে। একেকটার জন্য একেক ধরনের সময় লাগবে। সে ক্ষেত্রে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। তিনি বলেন, স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ ও স্যামপ্লিং সহজে করা গেলেও নিহতের লাশের সাথে ক্রসম্যাচ করা হবে কঠিন। এ জন্য ছয় মাস থেকে এক বছরও সময় লেগে যেতে পারে।

তিনি আরো বলেন, নমুনা হিসাবে আমরা রক্ত ও মুখের ভেতর থেকে বাক্কাল কোষ সংগ্রহ করেছি। এসব ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির বাবা-মা, সন্তান হলে ভালো হয়। আমরা ছেলে হলে তার বাবা-মা, বাবা-মা হলে তাদের সন্তান অর্থাৎ রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়দের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করছি।

যদি কেউ ডিএনএ নমুনা দিতে বাকি থাকে তারা মালিবাগে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে যোগাযোগ করতে পারবেন বলে জানান তিনি।

পোড়া হাত উদ্ধার : গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবনের নিচতলার ধ্বংসস্তূপ থেকে এক শিশুর পোড়া হাত উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন মাস্টার শাহজাহান সিকদার বলেন, মানবদেহের এ অংশটিকে আমরা কোনো শিশুর হাত হিসেবে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছি। 

চুড়িহাট্টার রাস্তা ধুয়েমুছে পরিষ্কার : উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণার পর থেকেই সেখানে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করার জন্য সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের তিনটি টিম কাজ করছিল। গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, মসজিদের সামনে পানি ছিটিয়ে ও ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। সিটি করপোরেশনের বড় একটি ট্রাকে পানি এনে রাস্তা ও আশপাশ পরিষ্কার করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবনের নিচতলা থেকে পুড়ে যাওয়া একটি শিশুর হাতের খণ্ড খুঁজে পান এক ব্যক্তি। এরপর সে দিকে ঘিরে ধরে লোকজন। অনেকেই তখন আফসোস করছিলেন। যে ভবনগুলোতে আগুন লেগেছে তার মাঝে একটি গোল চত্বর আছে। গোল চত্বরের একপাশে জড়ো করে রাখা হয়েছে আগুনে পুড়ে যাওয়া গাড়ি, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনের কাঠামো।

মসজিদের পাশেই ফায়ার সার্ভিসের অস্থায়ী কেন্দ্র। ঠিক তার পাশে গণমাধ্যমকর্মীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজনের ভিড়। পুরান ঢাকা ও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা এসব মানুষ আগুনের ভয়াবহতার চিত্র দেখতে এসেছেন। সবার চোখেই বিস্ময় আর শোকের চিহ্ন।

সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কাজ চলার সময় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এখানে ভবনগুলোর মধ্যে সুগন্ধির ক্যান ছাড়াও লাইটার রিফিল করার ক্যান ছিল। এগুলো অবশ্যই কেমিক্যাল।

জুমার দোয়ায় চুড়িহাট্টা মসজিদে কান্নার রোল : আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চুড়িহাট্টা জামে মসজিদটি। মসজিদের সামনের দিকের কিছু টাইলস খসে পড়েছে। ওই মসজিদে জুমার নামাজ শেষে ইমাম যখন মুনাজাত ধরেন, তখন মসজিদের বাইরেও অনেক মানুষের ভিড়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এসব মানুষও তখন ইমামের সাথে মুনাজাতে শরিক হন। ইমাম যখন মুনাজাত করছিলেন, তখন মসজিদের ভেতর থেকে মুসল্লিদের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। এ সময় চারপাশে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিল আর শুধু ইমামের দোয়ার আওয়াজ আর মুসল্লিদের আমিন আমিন বলে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/390492