২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শুক্রবার, ২:২৭

এই অগ্নিকাণ্ড ‘মানবসৃষ্ট’

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবনগুলো ‘সেলফ মেইড এক্সপ্লোসিভ’ * আগুন ছড়িয়ে পড়ার জন্য দাহ্য পদার্থ দায়ী : ফায়ার সার্ভিস * নিমতলী থেকে শিক্ষা নিইনি : ডা. সামন্ত লাল সেন * কোনো গুদাম লাইসেন্সধারী নয় : বিস্ফোরক পরিদফতর * পৃথক কেমিক্যাল শিল্পপল্লীর বিকল্প নেই-আবু নাঈম মো. শহীদুল্লাহ

রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডকে ‘মানবসৃষ্ট’ ঘটনা বলে অভিহিত করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরান ঢাকার ভবনগুলো যেন সেলফ মেইড এক্সপ্লোসিভে (নিজ থেকেই বিস্ফোরকে রূপ নেয়া) পরিণত হয়েছে। যেকোনো সময় আবার ওই এলাকায় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে।

তাদের মতে, আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার জন্য ভবনগুলোতে রাখা দাহ্য পদার্থ দায়ী। এ সমস্যা সমাধানে পৃথক কেমিক্যাল শিল্পপল্লী তৈরির বিকল্প নেই। ৯ বছর আগে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ নিমতলী ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা না নেয়ার কারণেই চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির ঘটনা ঘটল।

এদিকে বিস্ফোরক পরিদফতর জানিয়েছে, পুরান ঢাকায় যেসব কেমিক্যালের গোডাউন আছে সবই অবৈধ। এসব গোডাউনের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, চকবাজারের অগ্নিকাণ্ড ‘মানবসৃষ্ট’ ঘটনা। ব্যবসা করার জন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। হাইকোর্টের আদেশও রয়েছে।

পুরান ঢাকায় যেভাবে কেমিক্যালের ব্যবসা চলে, সেটা কোনো আইনের মধ্যে পড়ে না। ব্যবসায়ীরা সরকারের নীতিমালা মেনে চললে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হবে। যারা এর জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারকে সুপারিশ করব।

তিনি বলেন, নিমতলী ট্র্যাজেডির পর ব্যবসায়ীদের নানা সুপারিশ করা হয়েছিল। ওই সব সুপারিশ আমলে নেয়া হয়নি। যে ঘটনা ঘটেছে তা একেবারেই মেনে নেয়া যায় না। এর চেয়ে কষ্টের ও মর্মান্তিক মৃত্যু আর হতে পারে না। এটা চরম মানবিক বিপর্যয়।

তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে গঠন করা তদন্ত কমিটি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ভুক্তভোগী পরিবার এবং প্রতক্ষ্যদর্শীদের সঙ্গে কথা বলবে। কমিটির সদস্যরা তদন্ত করে যে প্রতিবেদন দেবেন, সরকারের কাছে সেভাবেই সুপারিশ করা হবে।’

দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ার জন্য দাহ্য পদার্থকে দায়ী করেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক আলী আহমেদ খান বলেন, ‘পুরান ঢাকার সংকীর্ণ সড়কে ভবনগুলোর ছোট ছোট কক্ষে আগুন জ্বলতে থাকায় তা নেভাতে বেগ পেতে হয় অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর সদস্যদের। ভোরে একবার আগুন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনার পর আবারও তা ছড়িয়ে পড়েছিল।’

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক একেএম শাকিল নেওয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুরান ঢাকার ভবনে ভবনে বেআইনিভাবে প্লাস্টিক দানা ও কেমিক্যালসহ বিভিন্ন ধরনের দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণ করা হচ্ছে; যা সেলফ মেইড এক্সপ্লোসিভের (নিজ থেকেই বিস্ফোরকে পরিণত হওয়া) মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেকোনো সময় এমন বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পুরান ঢাকাকে অবকাঠামোগতভাবে নতুন করে সাজাতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে আরও বেশি মূল্য দিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘রাসায়নিকসহ বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন পুরোপুরি নেভাতে অনেক সময় লেগেছে। ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক তার থাকায় ও আশপাশে খোলা জায়গা না থাকায় অগ্নি নির্বাপণের কাজ কঠিন হয়।’ নিমতলীর ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘ওটা আমাদের ভালো একটা লেসন দিয়েছে, ওয়েক আপ কল দিয়েছে, সতর্ক হতে বলেছে। কিন্তু আমরা সতর্ক হইনি। তাই ফের একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটল।’

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘এটা তো কেমিক্যাল গোডাউন। রাসায়নিক পদার্থ ছিল। ফলে ভবনে খুব দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে রাসায়নিক গুদাম, তার ওপর ওই ভবনের সামনে কয়েকটি গাড়ি ছিল, যেগুলো গ্যাসে চলে। আগুনের কারণে গাড়িগুলো বিস্ফোরিত হয়।

আরেকটি গাড়ি ছিল, যার ভেতর ছিল অনেক সিলিন্ডার। সিলিন্ডারগুলো হয়তো আশপাশের বাড়িতে ও হোটেলে গ্যাস সরবরাহের জন্য ছিল। ওই গাড়িতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এ কারণে মৃত ব্যক্তির সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেড়ে যায়। আগুন নেভানো কঠিন হয়ে পড়ে।

এ ধরনের আবাসিক এলাকা, জনবহুল এলাকার মধ্যে কেমিক্যাল গোডাউন থাকা উচিত না। এখনই সময় এগুলো সরিয়ে নেয়ার। পরিবেশ অধিদফতর, সিটি কর্পোরেশন এবং সরকারের অন্যান্য দফতর এসব গোডাউন সরানোর সিদ্ধান্ত নিলে পুলিশ সহযোগিতা করবে।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন নিহতের ঘটনা থেকে আমরা কোন শিক্ষা নিইনি। আর এ কারণেই চকবাজারের ঘটনাটি ঘটল।’

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ও জাতীয় শিল্প নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য আবু নাঈম মো. শহীদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেমিক্যাল শিল্পপল্লী আলাদা না করলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। একটা পল্লী তৈরি না হওয়া পর্যন্ত পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের দোকান সরানো যাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘কেমিক্যাল শিল্পপল্লী তৈরির বিষয়টি শিল্প মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে। এটা নিয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি করা হয়েছে। সেটির কাজ বেশি এগোয়নি। কেমিক্যাল শিল্পপল্লী তৈরির পরিকল্পনাটি ছিল খুবই সুবিন্যস্ত। যেখানে এই পল্লী হবে, সেখান থেকে সারা দেশে নৌ এবং সড়কযোগে রাসায়নিক পরিবহন করা যাবে। এটি হলে আর পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের গুদাম থাকত না। ব্যবসায়ীরাও এটা চেয়েছিলেন। তারা গোডাউন নির্মাণের জন্য অগ্রিম টাকাও দিতে চেয়েছিল।’

আবু নাঈম মো. শহীদুল্লাহ আরও বলেন, ‘পুরান ঢাকায় অনেক নেতা আছে। তাদের উচিত কোনো কেমিক্যাল সেখানে ঢুকতে না দেয়।’

বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক শামসুল আলম বলেন, ‘নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে ওই এলাকায় কেমিক্যাল ব্যবসার জন্য একটি লাইসেন্সও দেয়া হয়নি। ওই এলাকায় বিস্ফোরক পরিদফতরের লাইসেন্সধারী কোনো গুদাম এখন নেই। যে ভবনটিতে আগুন লেগেছিল সেটিতেও রাসায়নিক দ্রব্য ও দাহ্য পদার্থ রাখার অনুমতি ছিল না।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিক দানার আগুনও খুব ভয়াবহ হয়। যেখানে প্লাস্টিক ফাইবার, পারফিউম বা শত শত স্প্রে থাকে, সেখানে আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবেই। বিস্ফোরক পরিদফতর কেবল রাসায়নিকের গুদাম করার ক্ষেত্রেই লাইসেন্স দেয়। প্লাস্টিক বা রাবারের কারখানা করার ক্ষেত্রে বিস্ফোরক পরিদফতরের অনুমোদন প্রয়োজন হয় না।’

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/147161