২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শুক্রবার, ১২:৩১

সরু গলি ও পুরনো ভবনগুলোতে অনিয়ন্ত্রিত কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের আশঙ্কা বাড়ছে

মুহাম্মদ নূরে আলম : রাজধানীর পুরান ঢাকার সরু গলি ও পুরনো ভবনগুলোতে অনিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন কারখানায়, গোডাউন, আইন লঙ্ঘন করে রাসায়নিক দ্রব্য মজুদ, বৈদ্যুতিক ওয়্যারি আপডেট করা না হলে ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটতে পারে যেকোনো সময়। ঢাকায় যেসব অগ্নিকা- ঘটেছে তার অন্যতম কারণ পুরনো ভবনে সময়মত ওয়্যারিং না করা বলে জানিয়েছেন, ইলেকট্রিকাল সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করা সংগঠন ইসাব। অন্যদিকে ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড না মানা ও জনসচেতনতার অভাবকে দায়ী করছে ফায়ার সার্ভিস।

রাজধানীর বংশালের আলুবাজার এলাকায় ছোট পরিসরে রয়েছে অসংখ্য জুতা তৈরির কারখানা। ওই এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই একটি-দু’টি করে রয়েছে জুতার কারখানা। এসব কারখানায় জুতা তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয় কেমিক্যাল ও সল্যুসন গাম (আঠা)। তবে কারখানাগুলোতে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা না থাকা ও ঘিঞ্জি পরিবেশের কারণে প্রায় ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে ঘটছে মৃত্যুর ঘটনাও। স্থানীয়রা বলছেন, চকবাজারের আগুন লাগার পর এখন আলুবাজারের প্রতিটি বাসিন্দা এখন আতঙ্কে রয়েছেন। কারখানাগুলো এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া না হলে এ আতঙ্ক তাদের মন থেকে যাবে না।

এদিকে গত বুধবার রাতে রাজধানী ঢাকার পুরনো অংশের চকবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা: সোহেল মাহমুদ বেলা সাড়ে এগারটায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, তারা ৭৮টি মৃতদেহ পেয়েছেন। যদিও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কন্ট্রোল রুম থেকে বিবিসি বাংলাকে মৃতের সংখ্যা ৭০টি বলা হয়েছে।

অনুমতি নেই রাসায়নিক রাখার: ২০১০ সালের জুনে পুরনো ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের কারখানায় আগুন ধরে ১২৪ জন নিহত হয়েছিলেন। এরপর পুরনো ঢাকার আবাসিক এলাকায় রাসায়নিকের কারখানা বা সংরক্ষণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাহলে কিভাবে চকবাজারে রাসায়নিকের গুদাম থাকতে পারে? বিবিসি বাংলার এমন প্রশ্নের জবাবে ফায়ার বিগ্রেডের মহাপরিচালক আলী আহামদ খান বলেন, "নিষেধাজ্ঞার পরেও অনেকে হয়ত চোরাইভাবে রেখে ব্যবসাবাণিজ্য করে। কর্তৃপক্ষের অগোচরে কাজ করে তারা। কিন্তু এর পরিণতি হচ্ছে এ ধরণের ঘটনা।

এর আগে, ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি দিনগত রাত ২টার দিকে আলুবাজার এলাকার একটি জুতার কারখানায় আগুন লাগে। এ ঘটনায় ওই কারখানার তিন শ্রমিক দগ্ধ হন। পরে আল আমিন (২০) নামে কারখানার এক কারিগর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ওসমান (২৫) ও আবদুস সামাদ (২৭) নামে দুই কারিগর ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আলুবাজারের ওই কারখানাটিতে গিয়ে দেখা যায়, পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত জুতার কারখানাটি বাইরে থেকে তালা লাগানো। ভবনের পেছন দিকের জানালা দিয়ে দেখা গেছে, বেশকিছু কেমিক্যালের বোতল পড়ে আছে। ভবনের আশপাশে রয়েছে এখনও পোড়া গন্ধ।

আলুবাজার ছোট মসজিদের পেছনে সরু রাস্তা দিয়ে একটু সামনে গেলেই ৫৫/১-এ পাঁচতলা ওই ভবনটি। ভবনের মালিকের নাম রনি। নিচতলার তিনটি রুম ভাড়া নিয়ে ইয়াকুব শেখ গড়ে তোলেন কারখানা। কাঠের পাটাতন দিয়ে ঘরের ভেতরে তৈরি করা হয়েছে দুইতলা। ওপরে জুতা তৈরির কাজ চলে, আর নিচের অংশটি কারিগরদের বিশ্রামের জন্য। আগুনে নিচতলার একটি ঘর সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। এদিকে, ভবনের দুই পাশে রয়েছে দু’টি বৈদ্যুতিক খুঁটি। আগুনের তাপে ওই খুঁটিগুলিও কালো হয়ে গেছে। রাস্তার পাশের জানালার কাঁচগুলো আগুনের তাপে ফেটে গেছে।

ওই এলাকায় আরেক জুতার কারখানার মালিক মো. লোকমান জানান, আলুবাজারের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই জুতার কারখানা আছে। আর এসব জুতা তৈরির জন্য সল্যুসন গামসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। যেখানে জুতার কারখানা থাকবে সেখানে কেমিক্যাল ব্যবহার হবে, এটাই স্বাভাবিক। ঘটনাস্থলের পাশের ভবনের অন্য জুতার কারখানার কারিগর মো. মিশু বলেন, এসব কারখানাগুলোতে প্রায় সময় এমন অগ্নিকা- ঘটে। এই মাসেই বংশালে দু’টি কারখানায় আগুন লাগে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাটিতে কিভাবে আগুন লেগেছে তা জানি না। তবে কারখানায় জুতা তৈরিতে ব্যবহৃত সল্যুসন আঠা আর কেমিক্যালের কারণে আগুন বেড়ে যায়। ওইদিন সেখানে অন্তত ১৫ জনের মতো কারিগর ছিল।

এর আগে ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি বংশালের সাতরওজা এলাকায় একটি জুতার কারখানায় আগুন লেগে দুই শ্রমিক দগ্ধসহ তিনজন আহত হন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ২ ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

রাজধানীর বংশালে অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত জুতার কারখানা এসব এলাকায় প্রায়ই অগ্নিকা- কেন ঘটে?- জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মদ খান বলেন, আবাসিক এলাকায় কোনো কারখানা থাকার নিয়ম নেই। আবাসিক এলাকায় এসব জুতার কারখানা থাকলে ঝুঁকি থাকবেই, কমবে না। ঝুঁকি এড়াতে এসব কারখানা সরিয়ে নিতে হবে।

এসব জুতার, প্লাস্টিক, পলিথিন ব্যাগ কারখানায় যে সল্যুসন ও পেস্টিং ব্যবহার করা হয় সেগুলো দাহ্য পদার্থ। আগুলে পুড়লে এর বিষাক্ত ধোঁয়ায় মানুষ দ্রুত মারা যেতে পারে বলে জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, বংশ পরম্পরায় পুরান ঢাকার বংশালে এসব জুতার কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানা সরানোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তাই এ বিষয়ে মেয়র ও কাউন্সিলরদের সঙ্গে ফাসার সার্ভিসের আলোচনা করার কথা রয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে এগুলো সরানোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী প্রতিবছর খোদ রাজধানীতে চার হাজারের ওপরে অগ্নিকা- ঘটছে। এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে তারা পুরনো ভবনে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের সংস্কার ও নতুন ভবনের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করাকেই দায়ী করছেন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পরিচালক বলেন, ওয়ারিং গুলো অনেক পুরনো এগুলো পরিবর্তন না করা হলে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমাদের সচেতনতার দুর্বলতা রয়েছে। ইলেকট্রিকাল সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করা সংগঠন- ইসাব জানায়, নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাবে রাজধানীর সুউচ্চ ভবনগুলো অধিক অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে। ইসাব বলেন, ভবন গুলো ২০ থেকে ২৫ বছরের পুরনো। এগুলোর বৈদ্যুতিক ওয়ারিংগুলো এখন যদি আপডেট করা না হয় ঝুঁকি কিন্তু বাড়ছে। বিশ বছর ধরে ভবন বেড়েছে কিন্তু ফায়ার বিগ্রেডের লোকবল বাড়ে নাই। গত বিশ বছরে রাজধানীতে সুউচ্চ ভবন যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, সে হারে বাড়েনি ফায়ার সার্ভিসের দক্ষতা ও জনবল। মনে করছে ইলেকট্রিকাল সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি-সংগঠন ইসাব।

http://www.dailysangram.com/post/366046