১৯ জানুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ১১:২৪

ভুয়া নির্বাচন ও আইড়্যা যুক্তি

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

গত ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে নির্বাচনের নামে যে নজিরবিহীন ভোট ডাকাতি হয়ে গেছে, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পৃথিবীতে এমন ঘটনা আর কোনো দেশে ঘটেনি। এই নির্বাচনে সরকার মানুষের ভোটাধিকার সম্পূর্ণ কেড়ে নিয়েছে। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ - সব কিছুকে কব্জা করে অত্যন্ত ঘৃণ্য পরিকল্পনার মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করে নিয়েছে। এই ভোটাধিকার হরণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ভোটে কারচুপির কথা হয়ত কল্পনা করেছিল, কিন্তু এমন নীচ যে সে পরিকল্পনা হতে পারে, তারা তা কল্পনাও করতে পারেননি। অর্থাৎ আইন-শৃখলা বাহিনী ও প্রশাসনের মাধ্যমে সরকার আগের রাতেই যে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করে রাখবে, এটা কেউ ভাবেননি।

কিন্তু পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। আর তারই অংশ হিসেবে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের অনেক আগে থেকেই গ্রেফতার করা হচ্ছিল পাইকারিভাবে। অনেক ক্ষেত্রে আটক করা হচ্ছিল সম্ভাব্য প্রার্থীদেরও। নির্বাচনের মাস তিনেক আগ থেকেই প্রতিদিনই বিরোধী দলের তিন-চার শ’ নেতা-কর্মীকে আটক করতে থাকে পুলিশ। মামলা দেয়া হতে থাকে শ’য়ে শ’য়ে। কয়েক জনের নাম লিখে সেসব মামলায় বেনামে হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে আসামী করা হয়। পুলিশ বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে এই বলে শাসিয়ে আসে যে, তারা যেন নির্বাচনের কয়েক দিন আগে থেকেই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। তা না হলে গায়েবি মামলায় তাদের ফাঁসিয়ে দেয়া হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্রস ফায়ারেরও হুমকি দেয়া হতে থাকে। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল, বিরোধী দলের কর্মীসমর্থক ভোটারদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করা। এর আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল। আর তা হলো বিরোধী দল যাতে নির্বাচনে কোনো এজেন্ট দিতে না পারে। এতে কেন্দ্রে জালিয়াতি-চালিয়াতি যাই সরকার করুক, তার যেন কোনো প্রতিবাদ কেউ করতে না পারে।

এদিকে কেন্দ্রে যে জালিয়াতি-চালিয়াতি হবে, সে বিষয়ে আগে থেকেই অবহিত ছিল নির্বাচন কমিশন। আর সে কাজে নির্বাচন কমিশন নিজেকে সহযোগী হিসেবে উপস্থাপন করে। এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণে যাতে বিদেশিরা আসতে না পারে, তার জন্য নির্বাচন কমিশন ও সরকার কঠিন কড়াকড়ি আরোপ করে। নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতি হবে, এটা আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। আর তাই তারা আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছিল যে, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তারা কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। তখন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম এই বলে বগল বাজিয়েছিলেন যে, ইইউ না আসুক, নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে। বিষয়টা অনেকখানি নিশ্চিতই ছিল। কিন্তু সরকার শেষ মুহূর্তে তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। কারণ এটা নিশ্চিতই ছিল যে, সরকার যে ব্যবস্থাই নিক না কেন, বিদেশি পর্যবেক্ষকরা এ চালিয়াতি ধরে ফেলবেন। তাই তাদের আসতে দেয়া যাবে না। আর সে কারণেই শেষ মুহূর্তে এসে সরকার সেই সম্ভাব্য পর্যবেক্ষকদের ভিসা দিতে গড়িমসি করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না বলে ঘোষণা দেয়। হাঁপ ছেড়ে বাঁচে সরকার।

সরকারের অন্ধ তাঁবেদার নির্বাচন কমিশন তখন দেশীয় পর্যবেক্ষকদের নিয়ে পড়ে। নির্বাচন কমিশন সচিব সম্ভাব্য পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রতিনিধিদের ডেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের জন্য ফ্যাসিবাদী এক নীতিমালার কথা ঘোষণা করে। তাতে বলা হয়, নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরা একসঙ্গে একজনের বেশী বুথের ভেতরে যেতে পারবেন না। সেখানকার কোনো ছবি তুলতে পারবেন না। কোনো ভোটার বা নির্বাচনী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। তারা ব্রিটিশ রাজপ্রাসাদের দাড়োয়ানদের ন্যায় পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকবেন। ভেতর থেকে কোনো কিছু লাইভ প্রচার করতে পারবেন না। এইভাবে তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন। সরকার ও কমিশনের নির্দেশে হেলালুদ্দিন স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের এই মর্মে সতর্ক করে দেন যে যদি তারা নির্বাচন কমিশনের এই বিধিবিধান অমান্য করে তবে এনজিও ব্যুরোকে বলে তাদের নিবন্ধন বাতিলও করা হতে পারে। তাতে তারা সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। তাদের এনজিওটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। উল্লেখ্য, নির্বাচনে যারা স্থানীয় পর্যবেক্ষক হন, তারা সাধারণত এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সদস্য হয়ে থাকেন। সেই কারণে তাদের পক্ষে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ করার ছিল না। এই ব্যবস্থাটি এই কারণে করা হয়েছিল যে, সমস্ত সতর্কতার ফাঁক গলিয়ে তবু যদি কেউ নির্বাচনী বুথের ভেতরে পৌঁছে যান, তাহলে তিনি যেন সেখানকার অনিয়মগুলো কোনো অবস্থাতেই তুলে ধরতে না পারেন। এর আগের নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, সরকারের সমস্ত অপকর্ম ও দুর্নীতির চিত্র পর্যবেক্ষকরা সরাসরি সম্প্রচার পর্যন্ত করেছেন। যিনি ভোট দিতে পারেননি এবং যাদের ভোট দিতে বাধা দেয়া হয়েছে কিংবা লীগ কর্মীদের দেখিয়ে ভোট দিতে হয়েছে সেগুলো সরাসরি জনসমক্ষে চলে এসেছে।

নির্বাচন কমিশন সরকারের মাধ্যমে আগে থেকেই অবহিত ছিল যে, ভোট কেন্দ্রে ব্যাপক জালিয়াতি হবে। এখানে মনুষ্যত্ব বলে কিছু থাকবে না। বিবেক বলে কিছু থাকবে না। সকলেই চাবি দেয়া কলের পুতুলের মতো সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দেশ মোতাবেক কাজ করে যাবে। এ ব্যবস্থা সূচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য সরকার আগে থেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামের একটি আইন প্রণয়ন করে রেখেছিল। সেই আইনবলে কোনো ডিভাইসের মাধ্যমে কেউ এই ধরনের কোনো অনিয়মের চিত্র তুলে ধরতে পারবেন না। সাংবাদিকদের নির্বাচনী কেন্দ্রে যাবার যে প্রবেশপত্র দেওয়া হয় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে তাতেও অনুরূপ শর্ত আরোপ করা হয়। সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও পর্যবেক্ষকদের জন্য নির্ধারিত নীতিমালা বহাল ছিল।

এদিকে আবার যারা নির্বাচনী কর্মকর্তা বা সহকারী নির্বাচনী কর্মকর্তা ছিলেন তাদের মধ্যে সরকারী বেসরকারি কর্মকর্তারা যেমন ছিলেন, ছিলেন স্কুল কলেজের শিক্ষকেরাও। ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তারাও। তাদের সকলের প্রতি আগে থেকেই নির্দেশ জারি করা হয়েছিল যে, তারা যেন আগের রাতেই ৫০ শতাংশেরও বেশি ভোট নৌকার পক্ষে সীল মেরে ব্যালট বাক্সে রেখে দেন। নির্বাচনী কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা হয়েছিল তারা যেন নৌকার পক্ষের লোক হন। নৌকার পক্ষের বাইরে যারা ছিলেন তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে আগে থেকেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল যে পুলিশ প্রশাসনের নির্দেশের বাইরে যদি কিছু করার চেষ্টা করে তাহলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্রসফায়ারের ভয়ও দেখানো হয়।

এতেও সরকার ও নির্বাচন কমিশন নিশ্চিত হতে পারছিল না যে নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত হবে। আর তাই শেষ পর্যন্ত সীল মারার কাজটি সম্পন্ন ও তদারক করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর ৫০ শতাংশের সীমারেখা বজায় রাখতে পারেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ৮০ শতাংশ পর্যন্ত সীল মেরে দিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। পুলিশ সদরদপ্তর থেকে এসপিদের উদ্দেশ্যে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তাতে তাদের কাজের প্রশংসা করা হয়েছে। সে ভাষা পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন যে, পুলিশকে কী নির্বাচনী দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ কর্মকর্তরা এই প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন নির্বাচন সুষ্ঠু ও সফল করতে পুলিশ সদস্যরা ’বিনিদ্র রজনী’ যাপন করেছেন। আর সে কারণেই পুলিশ সদরদপ্তরগুলোতে নির্বাচন পরবর্তী বিশেষ ভোজ বা বড় খানার আয়োজন করা হয়। এখানে কোনো লুকো-ছাপা ছিল না। সেভাবেই একটি ’অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।

অনেক পোলিং কর্মকর্তা তাদের সিনিয়রদের কাছে এ কথা বলতে গিয়ে বিবেকের দর্শনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। তারা বলেছেন, এটা কেমন করে হলো? কেমন করে করি? কিন্তু শেষ পর্যন্ত করতে বাধ্য হয়েছেন। শিক্ষা, বিবেক, মনুষ্যত্ববোধ সবকিছু সরকার যেমন বিসর্জন দিয়েছে তেমনি নাগরিকদেরও বিসর্জন দিতে বাধ্য করেছে। মানবতার এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের বিচার হয়তো কোনোদিন হবে। আমরা আগাম বলে রাখি যেন সেই বিচারে অসহায় নিরপরাধ মানুষদের কোনো শাস্তি না হয়। বিবেকের দর্শনে যারা দংশিত হয়েছেন, যারা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন, সেই সব মানুষের কথা একদিন নিশ্চয় জনসমক্ষে বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হবে। ইতিমধ্যে বাম গণতান্ত্রিক জোট এই নির্বাচন নিয়ে তাদের গণশুনানি করেছে। সেখানে ৮৪ জন প্রার্থী শত শত তথ্য প্রমাণ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন, কীভাবে নির্বাচনে ভোট ডাকাতি হয়েছে সে কথা জানিয়েছেন। প্রায় ৮ ঘণ্টা ধরে শত শত মানুষ সেই নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার কথা নিঃশব্দে শুনেছেন। মানবতা ও বিবেকের এই পরাজয় কারো জন্য শুভ হবে না।

কিন্তু ফ্যাসীবাদ যা করে, এখন তাই ঘটছে। মগজ ধোলাই হয়েছে ফ্যাসীবাদ সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের। সরকারের তারা উচ্ছিষ্টভোগী। সামান্য উচ্ছিষ্টের জন্য ঘেউ কুকুরের মতো তারা একে অপরের ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে। তারা বলার চেষ্টা করছে কেন হেরে গেল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপি। যেখানে নির্বাচনই হয়নি, সেখানে হেরে যাওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন? যেসব উচ্ছিষ্টভোগী তথাকথিত বুদ্ধিজীবী একসময় বলতেন, বিএনপি বড় রাজনৈতিক দল, তাদের জনসমর্থন আছে, তারা রাতারাতি ভোল পাল্টে এখন বলতে শুরু করেছেন যে, বিএনপি যে ৪-৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে, তার একমাত্র কারণ বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল। আজব কোশেশ! ১৯৯৬ সালে জামায়াত আর আওয়ামী লীগ মিলে একসঙ্গে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। মওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও শেখ হাসিনা পাশাপাশি বসে বিএনপির বিরুদ্ধে কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। আন্দোলন করেছে। তখন জামায়াত যুদ্ধাপরাধী ছিল না। যেই না জামায়াত বিএনপির সাথে জোট বাঁধলো তখনই তারা দলেবলে যুদ্ধাপরাধী হয়ে গেল। আর সেই ’যুদ্ধাপরাধীদের’ সঙ্গে জোট বাঁধার কারণে বিএনপি একেবারে গো হারা হেরেছে। কোনো কারচুপি দুর্নীতি হয়নি। নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠুু হয়েছে।

এসব কথা যারা বলছেন, তাদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ওহ! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ইতর চরিত্র এই খানে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের মত পথ থাকবেই। কিন্তু তারা ক্লাসরুমে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত এই ভেদ যদি করেন তাহলে কী শিক্ষা তারা দেবেন! কী তাদের নীতি নৈতিকতা! কী তাদের বিবেক বোধ! আর এই যদি হয়, তাহলে জাতির ভবিষ্যৎ ঘোর অন্ধকার। তাই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়, ’সত্যকে আজ হত্যা করে অত্যাচারীর খাঁড়ায়/ নাই কি রে কেউ সত্যসাধক বুক খুলে আজ দাঁড়ায়?’ নিশ্চয় সত্য সাধক আছে। নিশ্চয় তারা বুক খুলে দাঁড়াবে। সত্যকে সত্য বলবে।

http://www.dailysangram.com/post/361462