১ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১:৩২

অনুমতি ছাড়া সম্প্রচারে সাত বছরের জেল

সরকারের অনুমতি ছাড়া সম্প্রচার মাধ্যম পরিচালনায় জেল-জরিমানার বিধান রেখে এ আইনের খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করেছে সরকার। খসড়ায় দায়ী ব্যক্তিকে অনধিক ৭ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ কোটি টাকা জরিমানা এবং উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এরপরও একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে প্রতিদিনের জন্য সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের তৈরি ‘সম্প্রচার আইন-২০১৭’ নামের এ খসড়াটি শিগগির মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া খসড়ায় সম্প্রচার আইনের বিধিবিধান বা প্রবিধান লংঘন করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে। খসড়াটি মন্ত্রিসভার অনুমোদনসাপেক্ষে জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে বিল আকারে উপস্থাপনের প্রস্তুতি চলছে।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির ‘মিট দ্য রিপোর্টার্স’ অনুষ্ঠানে এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে সম্প্রচার আইন উত্থাপন করা হবে। একটি সম্প্রচার কমিশনও গঠিত হবে। ওই কমিশন ইলেকট্রুনিক ও অনলাইন গণমাধ্যমকে ছাড়পত্র দেবে, তা বাতিলও করতে পারবে। জানতে চাইলে তথ্য সচিব মরতুজা আহমদ রোববার নিজ দফতরে যুগান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রচার আইনের খসড়া প্রায় চূড়ান্ত। শিগগিরই অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে।’

খসড়া অনুযায়ী দেশের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা ও জনশৃংখলা বিনষ্ট হতে পারে এমন কিছু সম্প্রচার করা যাবে না। এছাড়া দেশের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার প্রতি হুমকি হবে এমন কোনো কিছু প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অশ্লীল, অশিষ্ট, মিথ্যা ও বিদ্বেষমূলক এবং দেশের সম্ভাব্য শান্তি, ঐক্য ও জনশৃংখলা বিনষ্ট হতে পারে এমন কোনো কিছু প্রচার করা যাবে না। কোনো প্রতিষ্ঠান এসব বিধান ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে সম্প্রচার কমিশন। পাশাপাশি সরকারের অনুমতি নিয়ে টিভি লাইসেন্স ও অনলাইন গণমাধ্যমের মালিকানা সর্বোচ্চ ৪৯ ভাগ হস্তান্তর করা যাবে। তবে তা সম্প্রচার কার্যক্রম শুরুর আগে নয়। এমনকি সম্প্রচার শুরুর এক বছরের মধ্যেও নয়। নির্ধারিত মেয়াদের পর হস্তান্তর করা যাবে। এর আগে করলেই লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। এছাড়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মালিকানা হস্তান্তর করা যাবে না।’ খসড়ায় বলা আছে, আইনটি বলবৎ হওয়ার পর অবিলম্বে সম্প্রচার কমিশন গঠন করতে হবে। কমিশনে একজন নারীসহ ৭ জন কমিশনার থাকবেন। কমিশনার নিয়োগ দিতে সরকার ৫ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে দেবে। ওই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কমিশনারদের একজনকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেবেন। চেয়ারম্যানের পদমর্যাদা হবে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারকের সমান এবং কমিশনাররা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকের পদমর্যাদা, পারিশ্রমিক ও সুবিধাদি পাবেন। কমিশন আইন ভঙ্গকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বা নিবন্ধন সর্বোচ্চ ১৪ দিনের জন্য স্থগিত করতে পারবে। তবে এর বেশি দিনের জন্য স্থগিত করতে হলে কমিশন তথ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠাতে পারবে। পাশাপাশি এই আইনের অধীনে কমিশন অপরাধের ধরন বুঝে সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা জরিমানা করতে পারবে। কমিশনের কাছে সংক্ষুব্ধদের অভিযোগ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে সরকার আইন বা বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত শাস্তি নিশ্চিত করবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল যুগান্তরকে বলেন, আইনের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী সম্প্রচার কমিশন গঠন করার কথা। আমাদের দাবি ছিল কমিশনের প্রধান হতে হবে কোনো অভিজ্ঞ গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ। কোনো আমলাকে এর প্রধান করা যাবে না। পাশাপাশি কমিশনকে নিয়ন্ত্রণ না করে স্বাধীনতা দিতে হবে, তারাই সম্প্রচার মাধ্যমের বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু আইনে কমিশন গঠনের কথা বলা হলেও এর পুরো কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে রাখা হয়েছে। বলে দেয়া হচ্ছে যে কমিশন এটা করতে পারবে, ওটা করতে পারবে না। এর শাস্তি এই, ওর শাস্তি ওই। অর্থাৎ কমিশনকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এ ছাড়া গণমাধ্যমসংক্রান্ত বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার সমন্বয় না করে সম্প্রচার আইন চূড়ান্ত করা হলে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন এই সাংবাদিক নেতা।

আইনের খসড়ায় টিভি লাইসেন্স ইস্যু ও অনলাইন গণমাধ্যমের নিবন্ধন দিতে সম্প্রচার কমিশনের একক কর্তৃত্বের কথা বলা হলেও মূল ক্ষমতা রাখা হয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়ের হাতেই। কমিশনকে শুধু সুপারিশ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। খসড়ার ১২(ঙ) নম্বর ধারায় সম্প্রচার লাইসেন্স ও অনলাইন গণমাধ্যমের নিবন্ধন এবং যন্ত্রপাতির লাইসেন্স প্রদানে একক কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে সম্প্রচার কমিশনকে। অন্যদিকে কমিশনের ক্ষমতাসংক্রান্ত ১২(ঙ) নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘টেলিভিশন, বেতার, ইন্টারনেট টিভি বা রেডিও বা অন্য কোনো ধরনের প্রচার মাধ্যম যথা ডিজিটাল বা ভিন্ন ধরনের সম্প্রচার মাধ্যম ও সম্প্রচার যন্ত্রপাতির জন্য সম্প্রচারকারীর অনুকূলে লাইসেন্স ইস্যুর জন্য সুপারিশ করা এবং সরকারের অনুমোদনক্রমে তা ইস্যু করা।’ অর্থাৎ তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া সম্প্রচার কমিশন কোনো লাইসেন্স ইস্যু বা অনলাইন গণমাধ্যমের নিবন্ধন দিতে পারবে না। তারা শুধু সুপারিশ করতে পারবে।

এ প্রসঙ্গে মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, লাইসেন্স ইস্যু ও বাতিল করার ক্ষমতা না দিয়ে শুধু সুপারিশ করার ক্ষমতা দিলে কমিশন স্বাধীন হয় কি করে? কমিশনকে কাজ করার স্বাধীনতা দিতে হবে। এই সাংবাদিক নেতার বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে একই সংগঠনের মহাসচিব ওমর ফারুক বলেন, প্রস্তাবিত আইনটির খসড়ায় আমরা যে সব প্রস্তাব দিয়েছিলাম তার অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। গণমাধ্যমসংক্রান্ত বিদ্যমান আইনগুলোর বিভিন্ন ধারার সঙ্গে সম্প্রচার আইনের কোনো কোনো ধারা সাংঘর্ষিক। তাই আমরা মনে করি আইনটি মন্ত্রিসভায় পাঠানোর আগে গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পরামর্শ নেয়া উচিত। নইলে এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ আইন হবে, যা কোনোক্রমেই কাম্য নয়।

প্রস্তাবিত খসড়া অনুযায়ী আদালত কর্তৃক দুই বছর বা তার বেশি মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিরা এই আইনের অধীনে টিভি লাইন্সেস বা কোনো গণমাধ্যমের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। তবে দণ্ড থেকে মুক্তিলাভের ৫ বছর পর তিনি আবেদন করতে পারবেন। এ ছাড়া আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত এবং কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপি ব্যক্তি আবেদন করার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না।

সম্প্রচার আইনের খসড়া চূড়ান্ত