প্রিয় দেশবাসী,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ এক কঠিন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, মৌলিক অধিকারসহ মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার আজ বিপর্যস্ত। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি এত চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আজ হত্যা, ধর্ষণ, খুন, চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী অপরাধের অভিযোগ উঠেছে। যারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করবে, তারাই আজ আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে চলেছে। প্রকাশ্যে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সমাজে মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল বিচারাঙ্গণের অবস্থা আজ সবার সামনে পরিস্কার। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তো দূরের কথা, তা আজ সরকারের ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবার অভিযোগ উঠেছে। দেশের জনগণের রাজনৈতিক অধিকার বলতে কিছু নেই। সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের মতামত প্রকাশ, সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক দল করার অধিকার স্বীকৃত থাকলেও সরকার তা হরণ করে নিয়েছে। সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিরোধীদল দমন, একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দেশকে রাজনীতিহীন করার পরিকল্পিত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদেরকে ফৌজদারী অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হচ্ছে। জনগণের প্রতি সরকারের কোন দায়-দায়িত্ব নেই। প্রতীয়মান হচ্ছে জনগণের দুর্ভোগ লাঘবের পরিবর্তে নানাভাবে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। দেশের জনগণ নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। গোটা দেশ আজ এক বৃহৎ কারাগারে পরিণত হয়েছে। জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনের মহোৎসব চলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে লুটেপুটে ফোকলা বানিয়ে ফেলা হচ্ছে।
জামায়াতকে নির্মূলের ষড়যন্ত্র
২০০১-২০০৬ মেয়াদে চারদলীয় জোট সরকারে জামায়াতের পক্ষ থেকে দুই জন মন্ত্রী অত্যন্ত সততা, দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে তিনটি মন্ত্রণালয় পরিচালনা করেছেন। জামায়াত নেতৃবৃন্দের সততা ও জামায়াতের অব্যাহত অগ্রযাত্রায় ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি বিশেষ মহল জামায়াতকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা আটতে থাকে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই রাজধানীর প্রকাশ্য রাজপথে সাপের মত পিটিয়ে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের হত্যা করে লাশের উপর নাচানাচি করা হয়। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দেশব্যাপী ভয়াবহ নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়। লগি-বৈঠার তান্ডব চালিয়ে সারা দেশে অর্ধ-শতাধিক জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীসহ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হত্যা করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী গঠিত সরকারকে কাজ করতে দেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের সৃষ্ট নৈরাজ্যের পথ ধরেই ওয়ান ইলেভেনের আগমণ ঘটে।
দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষিত হয়। সেনা সমর্থিত সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করে। শুরু হয় রাজনৈতিক দমন-পীড়ন। আওয়ামী লীগ এ সরকারকে তাদের আন্দোলনের ফসল হিসেবে দাবি করে। পরবর্তীকালে এই সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে নিরাপদ প্রস্থানের পথ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর একটি প্রহসনের নির্বাচনের আয়োজন করে। এই নির্বাচনে হাজারো অনিয়ম, কারচুপি, কেন্দ্র দখল ও জাল ভোটের মহোৎসব চলে। নির্বাচন কমিশন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর সদস্য ও আওয়ামী লীগ দলীয় সন্ত্রাসীদের সহযোগিতায় তারা জনগণের রায়কে নির্বাচনে পদাঘাত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দখল করে সরকার গঠন করে।
গণতন্ত্র হত্যা করার পদক্ষেপ
আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই নানা ধরনের গণবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করে। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের দোহাই দিয়ে সংবিধান সংশোধন করে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। নানান কায়দায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর চলে জুলুম-নির্যাতন। সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং এমনকি মানববন্ধনে বাধা দেয়া হয়। গণহারে গ্রেফতার অভিযান চালানো হয়। দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, সাংবাদিক, শিক্ষক, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ সরকারের আগ্রাসনের শিকার হয়। সবচাইতে বেশি জুলুমের শিকার হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবির।
জামায়াতকে নেতৃত্ব শূন্য করার জন্য জামায়াত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে কোন অপরাধ আবিষ্কার করতে না পেরে অবশেষে সরকার ১৯৭১ সালের মীমাংসিত ইস্যুটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে মিথ্যা অভিযোগে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে প্রহসনের বিচারের মুখোমুখি করে। অবৈধভাবে আইন সংশোধন করে ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও অবৈধ সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে এবং দলীয় লোকদের দ্বারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ায়ে এবং নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে একে একে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়। ইতোমধ্যে শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা, শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আওয়ামী সরকারের আমলে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের ওপর পরিচালিত সন্ত্রাসী তান্ডবের একটি খন্ড চিত্র নিচে তুলে ধরা হলো ঃ (২০০৯ সালের জানুয়ারী থেকে ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত)।
জামায়াতের প্রতি জনগণের ভালবাসা
শত জুলুম-নিপীড়ন সত্ত্বেও দেশের জনগণের জামায়াতের প্রতি তাদের ভালবাসা, সহানুভূতি বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। সরকারের চক্রান্ত উপেক্ষা করে জনগণ জামায়াতকে তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় স্থল হিসেবে বেঁছে নিয়েছে। হাজার কারচুপি সত্ত্বেও ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচন, ২০১৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীদের সফলতা তার প্রমাণ। জামায়াতের ভোটার সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার জামায়াতের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে দায়িত্ব পালন করতে দিচ্ছে না। নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলদেরকে গ্রেফতার করে বছরের পর বছর অন্যায়ভাবে কারাগারে আটক করে রাখা হয়েছে।
এ কথা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, জনগণ স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ পেলে জামায়াতকেই মনে-প্রাণে তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দল হিসেবে বেঁছে নেবে। সরকার জামায়াতের অগ্রগতির মধ্যে তার রাজনৈতিক পরাজয় দেখতে পেয়ে জামায়াতের ওপর অব্যাহতভাবে আগ্রাসী হামলা পরিচালিত করছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মিথ্যা মামলায় দলীয় লোকদের দ্বারা সাজানো সাক্ষ্য প্রদান করে জামায়াত ও শিবির নেতৃবৃন্দকে বিভিন্ন মেয়াদে দ-িত করা হচ্ছে। জামায়াত নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের বাড়ি, ঘর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর ও লুটতরাজের ফলে জনগণ জামায়াতের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি জনগণের এ সহানুভূতি ও ভালবাসাই জামায়াতকে সরকারের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা জোগাবে। দুর্বৃত্তদের সকল অপকর্মের সাক্ষী এ দেশের জনগণ সুযোগ মত তাদের বিচারের রায় প্রদান করবে।
জামায়াতকে নিষিদ্ধের ষড়যন্ত্র
সরকারের মন্ত্রীগণ সদম্ভে ঘোষণা করছেন যে, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে। তাদের এ ঘোষণা অসাংবিধানিক এবং বেআইনী। জামায়াত একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জামায়াত ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। জামায়াত নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। জামায়াত মনে করে নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার গঠন ও পরিবর্তন হওয়া দরকার। তাই নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করাসহ নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে জামায়াত বিশ্বাস করে। যেহেতু এ সরকার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না এবং জনগণের প্রতি সরকারের কোন আস্থা নেই, তাই তারা কোন পদ্ধতির ধার ধারে না। কোন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব মানতে তারা রাজি নয়। তাদের এ মানসিকতা গণতন্ত্র বিরোধী ও বাংলাদেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের অধিকারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অবশ্যই দলটি বরাবর এ রোগে আক্রান্ত। অতীতে তাঁরা আওয়ামী লীগসহ সকল দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল কায়েম করেছিল। তারা জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার যে স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশের জনগণ তা কখনো বাস্তবায়িত হতে দেবে না। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে ইসলামী আন্দোলনকে কখনো দমন করা যাবে না। সকল জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়ণ উপেক্ষা করে ইসলামী আন্দোলন অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ। অতীতে যারাই দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছেন, তারা নিজেরাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন। কাজেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র করে জনগণের মন থেকে কখনো জামায়াতকে মুছে ফেলা যাবে না।
দেশ রক্ষার আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হোন
প্রিয় দেশবাসী,
জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে বাংলাদেশ আমার আপনার এবং সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের। গুটি কয়েক অসৎ, লুণ্ঠুনকারী ও সুবিধাবাদী চক্রের হাতে এ দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া যায় না। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার যে প্রক্রিয়া চলছে তার বিরুদ্ধে আমাদেরকে সোচ্চার হতে হবে।
দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার পরিবর্তে, অশান্তি সৃষ্টি করার কাজে ব্যবহার করছে। দেশের আদালতগুলো সরকার শতভাগ আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চায় বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকারের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য আদালতগুলো বিরোধীদলের নেতাকর্মীদেরকে বিচারের নামে প্রহসন করে শাস্তি দেয়ার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশের সীমান্ত অরক্ষিত। দেশের সম্পদ আওয়ামী ক্যাডাররা লুটপাট করে নিচ্ছে। উন্নয়নের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের কোষাগার থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। দেশের শিক্ষাঙ্গণে ভয়াবহ নৈরাজ্য বিরাজ করছে। সরকারের অফিস দলীয় অফিসে রূপান্তরিত হচ্ছে। পেশাদারিত্বের পরিবর্তে মেধাহীন দলীয় ক্যাডারদেরকে পদোন্নতি দিয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহ দখল করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের বাইরে কারো কোথাও কোন স্থান নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশ মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হবে এবং বসবাসের অনুপযোগী হয়ে দাঁড়াবে। এ অবস্থা বন্ধের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। দেশের এ নাজুক পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ রক্ষার আন্দোলনে সোচ্চার হওয়ার জন্য আমরা দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।